দক্ষিণ কোরিয়ার ‘সিক্রেট’
ভয়ানক সংক্রামক ভাইরাস কোভিড-১৯। এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব কার্যকরভাবে মোকাবিলা করা যায় কীভাবে তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ দক্ষিণ কোরিয়া। গত সপ্তাহে এক সাক্ষাৎকারে দ্য ডেইলি স্টারের মোহাম্মদ আল-মাসুম মোল্লার সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত দক্ষিণ কোরিয়ার রাষ্ট্রদূত হু কং-ইল। তার দেশ কীভাবে এ পরিস্থিতি সফলভাবে মোকাবিলা করতে পেরেছে এবং কীভাবে তা বাংলাদেশের জন্য সহায়ক হতে পারে সে সম্পর্কে হওয়া আলোচনাটি তুলে ধরা হলো দ্য ডেইলি স্টারের পাঠকদের জন্য।
দ্য ডেইলি স্টার: দক্ষিণ কোরিয়ার বর্তমান পরিস্থিতি কেমন?
হু কং-ইল: দক্ষিণ কোরিয়ার কোভিড-১৯ মহামারিটি মূলত দেশের একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে এবং একটি নির্দিষ্ট ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে বেশি বলে লক্ষ্য করা গেছে। কালক্ষেপণ না করে পরীক্ষার মাধ্যমে সংক্রমিতদের দ্রুত চিহ্নিত করা হয়েছে। ভাইরাসটি যাতে আরও বিস্তার করতে না পারে সেজন্য সংক্রমিতদের সংস্পর্শে যারাই এসেছে দ্রুত তাদের খুঁজে বের করা হয়েছে। এখন দক্ষিণ কোরিয়ার পরিস্থিতি অনেকটাই স্থিতিশীল।
২৯ ফেব্রুয়ারি একদিনে সর্বোচ্চ ৯০৯ জন নতুন রোগী সনাক্ত হয়েছিল। এরপর থেকেই খুব দ্রুত এই সংখ্যা কমতে শুরু করে। বর্তমানে প্রতিদিন নতুন নিশ্চিত সনাক্তের পরিমাণ প্রায় ৩০ এ নেমে এসেছে। যার মধ্যে প্রায় ৫০ শতাংশ দেশের বাইরে থেকে সংক্রমিত হয়েছে। ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত কোরিয়ায় কোভিড-১৯ রোগীর সংখ্যা ১০ হাজার ৫৩৭ জন। যার মধ্যে সুস্থ হয়ে উঠেছেন সাত হাজার ৪৪৭ জন এবং মারা গেছেন ২১৭ জন।
আমরা এখনও এ বিষয়ে সতর্ক দৃষ্টি রাখছি। কারণ, দেশের কিছু জায়গায় এখনও সংক্রমণ ছড়াচ্ছে এবং দেশের বাইরে থেকে যারা আসছেন তাদের মধ্যে সংক্রমণ পাওয়া যাচ্ছে।
দ্য ডেইলি স্টার: ভাইরাসটি ছড়িয়ে পরা রোধে আপনাদের সাফল্যের সিক্রেট কি?
হু কং-ইল: কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণের জন্য দ্রুততম সময়ে পরীক্ষার মাধ্যমে সংক্রমিতদের খুঁজে বের করা এবং প্রাথমিক পর্যায়েই তাদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। সেই সঙ্গে সামাজিক দূরত্ব ও অন্যান্য ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রে সক্রিয়ভাবে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয়েছে।
কোরিয়ান চিকিৎসকদের উদ্ভাবিত একটি পদ্ধতি হলো ‘ড্রাইভ থ্রু টেস্টিং স্টেশন’। গাড়ি থেকে না নামিয়েই চালকদের পরীক্ষা করা হচ্ছে। এতে করে আমরা নমুনা সংগ্রহের জন্য প্রয়োজনীয় সময় ১০ মিনিটেরও নিচে নামিয়ে আনতে পেরেছি এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের রোগীদের সংস্পর্শে আসা সীমাবদ্ধ করতে পেরেছি।
বেশ কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতালে করা আরেকটি পদ্ধতি হলো ফোনবুথের মতো পরীক্ষা সুবিধা। যার মাধ্যমে সম্ভাব্য রোগীদের সামনে যেতে হচ্ছে না স্বাস্থ্যকর্মীদের। তারা একটি এক্রেলিক প্যানেলের ভেতরে বসে নমুনা সংগ্রহ করেন। ইনচিয়ন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ‘ওপেন এয়ার ওয়াক থ্রু’ পদ্ধতিতে পরীক্ষা স্টেশন চালু করা হয়েছে। এখানে বায়ু চলাচলের জন্য প্রাকৃতিক বাতাস ব্যবহার করা হয়।
দ্য ডেইলি স্টার: এ বিষয়ে দক্ষিণ কোরিয়া কীভাবে বাংলাদেশকে সহায়তা করতে পারে?
হু কং-ইল: কোভিড -১৯ এর প্রাদুর্ভাবের পর থেকে বাংলাদেশ ও দক্ষিণ কোরিয়া সরকার নিবিড়ভাবে কাজ করে যাচ্ছে। দেশ দুটির সার্বিক পরিস্থিতি, অভিবাসন ও উড়োজাহাজ চলাচলের নীতি এবং সম্মিলিতভাবে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সম্ভাব্য ব্যবস্থা নিয়ে কাজ করা হচ্ছে।
নিজ দেশে মহামারিটি প্রতিরোধ করার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টার মধ্যেই দক্ষিণ কোরিয়ার সরকার বন্ধুপ্রতিম দেশগুলোর কাছ থেকে টেস্ট কিট, পিপিই ও আর্থিক সহায়তার অসংখ্য অনুরোধ পাচ্ছে এবং তা পর্যালোচনা করছে। আমরা বাংলাদেশসহ আমাদের বন্ধুপ্রতিম দেশগুলোর সঙ্গে সক্রিয়ভাবে আমাদের সফলতার কৌশল এবং প্রযুক্তিগত সক্ষমতা শেয়ার করে নিচ্ছি। একই সঙ্গে এই কঠিন সময়ে বাংলাদেশের যেন প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জামাদি নিশ্চিত হয় তার কার্যকর উপায় খুঁজছি।
দ্য ডেইলি স্টার: কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ সরকার এই মুহূর্তে কি করা উচিত?
হু কং-ইল: সবচেয়ে উত্সাহজনক ব্যাপার হচ্ছে, বাংলাদেশ সরকার এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তাদের যা আছে তার শতভাগের সর্বোত্তম ব্যবহার করছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী হাসিনা কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে দেশব্যাপী লড়াইয়ে পুরোপুরি নিযুক্ত রয়েছেন বলে দেখা যাচ্ছে। প্রায়ই তিনি জনসমক্ষে আসছেন বিভিন্ন ঘোষণা ও নির্দেশনা নিয়ে।
বিশেষভাবে আমি পরীক্ষা বাড়ানোর উপর গুরুত্ব দিতে চাই। সেটা শুধু রাজধানীতে না, একেবারে প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত বাড়াতে হবে। এতে করে সরকার আরও সঠিক চিত্র দেখতে পারবে। পরীক্ষার ফলাফলের উপর ভিত্তি করে রোগী সনাক্ত ও তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে নিজেদের সক্ষমতা বাড়াতে পারবে। দক্ষিণ কোরিয়ার অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে যে প্রচুর পরিমাণে পরীক্ষা করা এই ভাইরাস মোকাবিলায় সফলতার একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
এর পাশাপাশি জনগণের সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, মাস্ক পরা, ঘন ঘন হাত ধোয়াসহ সরকারি নির্দেশাবলীর কঠোরভাবে মেনে চলা উচিত ভাইরাসটির বিস্তার রোধ করতে।
দ্য ডেইলি স্টার: এই ভাইরাস বাংলাদেশে কাজ করা দক্ষিণ কোরিয়ান প্রতিষ্ঠানগুলোকে কিভাবে প্রভাবিত করছে?
হু কং-ইল: বাংলাদেশে কাজ করা বেশিরভাগ দক্ষিণ কোরিয়ান প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশ অনুসারে অস্থায়ীভাবে অফিস এবং কারখানা বন্ধ করে দিয়েছে। এর মধ্যে অনেক প্রতিষ্ঠান রয়েছে পোশাক তৈরি খাতের। দীর্ঘ ছুটির কারণে এই অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যে বেশিরভাগ স্থানীয় শিল্পের মতোই দক্ষিণ কোরিয়ান প্রতিষ্ঠানগুলোও তারল্য সংকটের ঝুঁকির মুখোমুখি।
দক্ষিণ কোরিয়ান প্রতিষ্ঠানগুলোর বাংলাদেশ সরকারের ঘোষিত সর্বশেষ আর্থিক প্রণোদনা প্যাকেজের মাধ্যমে কর অবকাশ এবং স্বল্প সুদে ঋণ পাওয়া জরুরী। স্থানীয় ও বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোকে এই কঠিন সময়ে অবশ্যই বাঁচিয়ে রাখতে হবে যাতে তারা ব্যবসা চালিয়ে যেতে পারে।
দ্য ডেইলি স্টার: ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে অর্থনীতিতে কি প্রভাব পরতে পারে এবং কীভাবে দক্ষিণ কোরিয়া বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে সহায়তা করতে পারে?
হু কং-ইল: কোভিড-১৯ মহামারি রপ্তানি শিল্প, চাকরি, ক্ষুদ্র ব্যবসা এবং খাদ্য নিরাপত্তাসহ বিস্তৃত ক্ষেত্রে বিশ্ব অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
আমরা এখনও জানি না, এই বৈশ্বিক মহামারি কত দিন স্থায়ী হবে। তবে অনেকদিন হবে তা নিশ্চিত। আমরা ভাইরাসটিকে যত তাড়াতাড়ি পরাজিত করতে পারব, তত তাড়াতাড়ি আমাদের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার শুরু করা যাবে। বিশ্বস্ত বন্ধুত্বপূর্ণ দেশ হিসেবে, এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে দক্ষিণ কোরিয়া বাংলাদেশের পাশে থাকবে এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহায়তা দেওয়া অব্যাহত রাখবে।
দ্য ডেইলি স্টার: এই সংকট কাটিয়ে ওঠার বিষয়ে বাংলাদেশের জনগণকে কিছু বলতে চান?
হু কং-ইল: দক্ষিণ কোরিয়া বিশ্বকে দেখিয়েছে যে রোগ সনাক্ত এবং সঠিক জায়গায় সম্পদের সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে কোভিড-১৯ এর বিস্তার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। বাংলাদেশ সরকারও দেশব্যাপী ছুটি এবং তার কঠোর বাস্তবায়ন করছে। দ্রুততার সঙ্গে জনস্বাস্থ্য নির্দেশনা এবং একাধিক প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। আমি বাংলাদেশের জনগণকে পরামর্শ দিতে চাই, সফলভাবে সংকট কাটিয়ে উঠতে সরকারের উপর যেন ভরসা রাখে এবং সরকারের দেওয়া সব নির্দেশাবলী যেন যথাযথভাবে অনুসরণ করে।
Comments