করোনাভাইরাস রোধে রোহিঙ্গা শিবিরে বিশেষ ব্যবস্থার দাবি জানিয়ে ২৫ নাগরিকের বিবৃতি
করোনা মহামারিকালে প্রশংসনীয় ও বিরল মানবিক আচরণের প্রেক্ষাপটে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের খাদ্য-স্বাস্থ্যের অধিকার, অবাধ তথ্যপ্রবাহ ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং প্রয়োজনীয় চলাচলের স্বাধীনতা রক্ষাসহ বিশেষ ব্যবস্থা নিতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আবেদন জানিয়েছেন দেশের ২৫ বিশিষ্ট নাগরিক।
আজ সোমবার দেওয়া এক বিবৃতিতে তারা এ আবেদন জানান।
বিবৃতিতে বলা হয়, করোনা মহামারিকালে গণহত্যাসহ অপরাপর নৃশংস অপরাধগুলোর শিকার প্রায় ৪০০ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে বাংলাদেশ ভূখণ্ডের নৌ-সীমানা থেকে উদ্ধার করার জন্য বাংলাদেশের জনগণ, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অংশীদারগুলো ও রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা ও সাধুবাদ জানাই। একইসঙ্গে, করোনা মহামারিকালে প্রশংসনীয় ও বিরল মানবিক আচরণের প্রেক্ষাপটে আমরা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের খাদ্য-স্বাস্থ্যের অধিকার, অবাধ তথ্য প্রবাহ ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং প্রয়োজনীয় চলাচলের স্বাধীনতা রক্ষা করার জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আবেদন জানাই।
সাম্প্রতিক উদ্ধার হওয়া রোহিঙ্গা, উদ্ধারকারী ও পরবর্তীতে গণমাধ্যমের বরাতে আমরা জানতে পেরেছি— মানব পাচারকারীদের সহযোগিতায় অনধিক পাঁচ শ রোহিঙ্গা শরণার্থী দুই মাস যাবত মালয়েশিয়ায় ও থাইল্যান্ডে নৌপথে পৌঁছানোর চেষ্টা করেন এবং দুঃখজনকভাবে মালয়েশিয়ায় ও থাই, উভয় কর্তৃপক্ষই তাদের নৌকা প্রবেশে বাধা দেয়। দীর্ঘ দুইমাস যাবত নৌপথে যাত্রা চলাকালীন কমপক্ষে ২৮ জন রোহিঙ্গা মারা গেছেন এবং অনেকেই খাদ্য ও শুপেয় পানির অভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন বলে জানা গেছে। মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে রাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক ও জাতীয় আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন আমাদেরকে উদ্বিগ্ন করেছে।
বর্তমান করোনাভাইরাস পরিস্থিতি মাথায় রেখে সঠিক পদ্ধতিতে তাদের প্রয়োজনীয় সময়ের কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করা ও কোয়ারেন্টিন শেষে নিজ আশ্রয়শিবিরে ফেরত যেয়ে যেন কোনোরকম বৈষম্যর শিকার না হয়, সেদিকে বিশেষ নজর রাখতে হবে। বিশেষত নারী ও শিশুরা যেন কোনোভাবেই নিরাপত্তাহীনতার শিকার না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। সেই সঙ্গে পাচারকারিদের দেশীয় আইনে গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক বিচার করতে হবে। অবৈধ মানবপাচার বিষয়ে হটলাইন চালু করাসহ অবৈধ পথে মানবপাচার বন্ধে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা বাড়াতে হবে।
কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শিবিরে অতি-ঘনবসতির কারণে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের আশঙ্কায় আমরা উদ্বিগ্ন। বাংলাদেশে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১ হাজার ১১৬ জন মানুষ বসবাস করে। কিন্তু, রোহিঙ্গা শিবিরে প্রতি বর্গকিলোমিটারে প্রায় ৭০ হাজার মানুষের বসবাস। স্বাভাবিকভাবেই এখানে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার যে বাধ্যবাধকতা রয়েছে, তা মেনে চলা সম্ভব নয়। ফলে কোনোভাবে রোহিঙ্গা শিবিরে কোভিড-১৯’র সংক্রমণ হলে তা মারাত্মক গতিতে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। আমরা জানি, সরকার এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা সত্ত্বেও এখনো শিবিরগুলিতে পর্যাপ্ত চিকিৎসা সেবা, বিশুদ্ধ পানি এবং পয়ঃনিষ্কাশন সুবিধার অভাব রয়েছে। যদি রোহিঙ্গা শিবির অঞ্চলে করোনাভাইরাসের নিয়ন্ত্রণহীন প্রাদুর্ভাব ঘটে, তবে এটি স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যেও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়বে।
প্রায় ১১ লাখ নিবন্ধিত রোহিঙ্গাদের মাঝে শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে খাদ্য, আশ্রয় ও চিকিৎসা সেবা চলমান রাখতে করোনা সংক্রমণের এই সময়ে সংশ্লিষ্ট সকল কর্মীর শিবিরে প্রবেশাধিকার বজায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ। যাতে করে পরিষেবার অভাবে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা বা মৃত্যু না ঘটে। এই সময়ে বাংলাদেশ সরকারের আন্তর্জাতিক এবং জাতীয় মানবিক সাহায্য দানকারী সংস্থা ও রোহিঙ্গা নেতৃত্বাধীন গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে কোভিড-১৯ সম্পর্কে সঠিক ও প্রয়োজনীয় তথ্য পৌঁছে দিতে এবং শিবিরগুলোতে এবং সংলগ্ন এলাকার মানুষের মধ্যে ভাইরাসের সংক্রমণের ঝুঁকি কমানোর জন্য নিবিড়ভাবে সহযোগিতা করে কাজ করা দরকার।
করোনাভাইরাস মহামারিটি বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই রোগের সংক্রমণটি বাড়তে শুরু করেছে। উখিয়া ও টেকনাফ অঞ্চলে মোবাইল ও ইন্টারনেট যোগাযোগের নিরবিচ্ছিন্ন সংযোগ না থাকায়, মানবিক সহায়তায় নিয়োজিত কর্মীদের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত তথ্য সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা সম্পর্কে জানা যাচ্ছে না এবং যারা এদের সংস্পর্শে কাজ করছেন তাদের ঝুঁকি বাড়ছে। একইসঙ্গে প্রতিরোধমূলক কর্মকাণ্ডের গতি কমে যাচ্ছে। এই বিধিনিষেধের ফলে বর্তমানে স্থানীয় জনগণের মাঝে করোনাভাইরাস উপসর্গগুলো বিদ্যমান থাকলেও তাদের পক্ষে রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) হটলাইন নম্বরে যোগাযোগ করা কষ্টসাধ্য হচ্ছে।
বর্তমানে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী (বিশেষ করে নারী, বয়োবৃদ্ধ), চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীসহ জনস্বাস্থ্যে নিয়োজিত ব্যক্তি, মানবাধিকার ও মানবিক সহায়তায় নিয়োজিত সরকারি এবং বেসরকারি কর্মী এবং বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের জীবন বাঁচাতে মোবাইল ও ইন্টারনেট যোগাযোগের মাধ্যমে তথ্যের নিরবিচ্ছিন্ন প্রবাহ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সংক্রমণটির প্রকোপ রোধের জন্য প্রয়োজনীয় নিয়মাবলী, বিকাশমান মহামারির সময় সর্বাধিক নির্ভরযোগ্য এবং হালনাগাদ নির্দেশিকা দ্রুত ইন্টারনেটের মাধ্যমে রোহিঙ্গা জনসাধারণের সেবায় নিয়োজিত স্বাস্থ্যকর্মীদের নিকট পৌঁছে দেবে। একইসঙ্গে তা রোহিঙ্গাদের নেতাদের সঙ্গে সমন্বয় করতেও সহায়তা করবে। প্রতিবন্ধী, বয়স্ক ব্যক্তি ও শিশুসহ শরণার্থী শিবিরে যারা সবচেয়ে বেশি দুর্বল ও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছেন, তাদের রক্ষার জন্যে এটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
এখানে উল্লেখ্য যে, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী করোনাভাইরাস থেকে মুক্ত থাকার জন্য, বিশ্বস্ত ও আস্থার জায়গা না থাকার ফলে, বিভিন্ন প্রকার গুজবের ওপর নির্ভর করছেন এবং শিকার হচ্ছেন স্থানীয়দের বিদ্বেষমূলক আচরণের। রোহিঙ্গা শরণার্থীরা সংক্রমণে আক্রান্ত হওয়ার আগেই, আমরা সরকারকে শরণার্থী, স্থানীয় জনগোষ্ঠী ও সহায়তা কর্মীদের মানবাধিকার ও জনস্বাস্থ্য রক্ষার স্বার্থে কক্সবাজার জেলার রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরের আশেপাশে চলমান মোবাইল ইন্টারনেট বিধিনিষেধ প্রত্যাহার করার আহ্বান জানাই। মোবাইল ও ইন্টারনেট যোগাযোগ প্রবাহ ক্রমবর্ধমান করোনাভাইরাস মহামারি থেকে রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি স্থানীয় জনগণ ও সহায়তাকর্মীদের সুরক্ষা ও কল্যাণে কাজ করবে।
আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি— সরকার ও মানবিক সহায়তার কাজে নিয়োজিত সংগঠনগুলো ও কর্মীরা উপরোক্ত দাবি ও আহ্বান মনোযোগের সঙ্গে শুনবেন এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে তৎপর হবেন। যাতে করে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের পাশাপাশি স্থানীয় অধিবাসীদের স্বাস্থ্যের অধিকার, মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও তথ্য প্রবাহ এবং প্রয়োজনীয় চলাচলের স্বাধীনতা রক্ষা করা যায়। আমরা বিশ্বাস করি, উপরোক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা কোভিড-১৯ মোকাবিলায় শক্তি, সাহস ও দক্ষতা তৈরিতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে এবং এই সুরক্ষাগুলো বাংলাদেশের সামগ্রিক জনস্বাস্থ্যের পক্ষেও উপকারি হবে।
বিবৃতিতে সই করেছেন— গবেষক ড. মেঘনা গুহঠাকুরতা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. রিদোয়ানুল হক, সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক ড. পারভীন হাসান, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর পিস অ্যান্ড জাস্টিসের নির্বাহী পরিচালক ড. মঞ্জুর হাসান, একশন এইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবীর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম, কোস্ট ট্রাস্টের নির্বাহী পরিচালক রেজাউল করিম চৌধুরী, নারী অধিকার আন্দোলন কর্মী মাহীন সুলতান ও অ্যাডভোকেট কামরুন নাহার, নাগরিক উদ্যোগের প্রধান নির্বাহী জাকির হোসেন, মানবাধিকারকর্মী মোহাম্মদ নূর খান, আমেরিকান ইউনিভার্সিটির শিক্ষক কাজী ওমর ফয়সাল, লেখক রেহনুমা আহমেদ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সায়েমা খাতুন, নরওয়ের অসলো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ড. মুবাশের হাসান, শিক্ষক ও গবেষক ড. স্বপন আদনান, আইনজীবী মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল নোমান, আইনজীবী রুহি নাজ, লেখক, গবেষক ও মানবাধিকার কর্মী হানা শামস আহমেদ, লেখক ও গবেষক পারসা সানজানা সাজিদ, আইনজীবী ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মোহাম্মদ সাইমুম রেজা তালুকদার, মানবাধিকারকর্মী ফরিদা আক্তার, গবেষক ও মানবাধিকারকর্মী রেজাউর রহমান লেনিন এবং মানবাধিকানকর্মী শিরীন প হক।
Comments