চট্টগ্রামে লে অফ ৬৫ কারখানা, প্রক্রিয়াধীন আরও ৩০

করোনার প্রভাবে চট্টগ্রামের দুটি রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের (ইপিজেড) ৬৫টি কারখানা ৩০ থেকে ৪৫ দিনের লে অফ ঘোষণা করেছে। লে অফের জন্য প্রক্রিয়াধীন রয়েছে আরও ৩০টি কারখানা। এই ৩০টি কারখানাও অনুমোদন পেয়ে গেলে জেলার মোট কারখানার প্রায় অর্ধেকই হয়ে যাবে লে অফ।

করোনার প্রভাবে চট্টগ্রামের দুটি রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের (ইপিজেড) ৬৫টি কারখানা ৩০ থেকে ৪৫ দিনের লে অফ ঘোষণা করেছে। লে অফের জন্য প্রক্রিয়াধীন রয়েছে আরও ৩০টি কারখানা। এই ৩০টি কারখানাও অনুমোদন পেয়ে গেলে মোট কারখানার প্রায় অর্ধেকই হয়ে যাবে লে অফ।

কারখানার মালিকপক্ষ লে অফের কারণ হিসেবে কার্যাদেশ না থাকা, পণ্য জাহাজীকরণ করতে না পারা এবং আর্থিক দুরবস্থাসহ বিভিন্ন কারণ দেখিয়েছেন। লে অফে যাওয়া এসব কারখানার মধ্যে দেশি, বিদেশি ও যৌথ মালিকানার তৈরি পোশাক ছাড়াও জুতা, তাঁবু, ইলেক্ট্রনিক্স পণ্য তৈরির কারখানও রয়েছে।

চট্টগ্রাম ইপিজেড ও কর্ণফুলী ইপিজেডের তথ্য মতে, আজ মঙ্গলবার পর্যন্ত এ দুটি ইপিজেডের ৯৫টির মতো কারখানা লে অফের জন্য আবেদন করেছেন। এসব কারখানায় প্রায় দুই লাখের মতো শ্রমিক কাজ করেন। যাচাই-বাছাই শেষে ইতিমধ্যে ৬৫টি কারখানাকে লে অফের জন্য অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ কর্তৃপক্ষ (বেপজা)।

ইপিজেড কর্তৃপক্ষ বলছে, লে অফের অনুমোদন পাওয়া কারখানার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কারখানা হচ্ছে, রিজেন্সী গার্মেন্ট লিমিটেড, কেনপার্ক (বিডি) লিমিটেড, ইউনিভোগ গার্মেন্ট কোম্পানি লিমিটেড, নিউ এরা লিমিটেড, এক্সেলসিওর সুজ লিমিটেড, ফ্যামিলিটেক্স (বিডি) লিমিটেড, মেরিম কো লিমিটেড, মেরিমো লিমিটেড, এমজেডএম (সিইপিজেড) লিমিটেড, প্যাসিফিক জিন্স লিমিটেড, প্যাসিফিক অ্যাক্সেসরিজ লিমিটেড এবং বাংলাদেশ স্পিনার্স এন্ড নিটার্স (বিডি) লি।

এ দুটি ইপিজেডে ১৮৭টি প্রতিষ্ঠানে প্রায় আড়াই লাখ শ্রমিক কাজ করেন। এর মধ্যে লে অফ পাওয়া এবং আবেদন করা প্রতিষ্ঠানগুলোতেই কাজ করেন প্রায় দুই লাখ শ্রমিক। সে হিসেবে প্রায় দুই লাখ শ্রমিকের বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য সুবিধা লে অফের কারণে অর্ধেকে নেমে আসবে। এতে করে তাদের জীবন-যাপনে বড় ধরণের সংকট তৈরি হবে বলে আশংকা করছেন শ্রমিকরা।

ইতিমধ্যে এসব কারখানা থেকে শ্রমিকদের মোবাইলে ক্ষুদে বার্তার (এসএমএস) মাধ্যমে লে অফের বিষয়টি জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।

রিজেন্সী গার্মেন্ট লিমিটেড থেকে শ্রমিকদের পাঠানো একটি ক্ষুদে বার্তায় বলা হয়েছে, ‘বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের কারণে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে পর্যাপ্ত কার্যাদেশ না থাকার পরিপ্রেক্ষিতে কারখানাসমূহ ১২-০৪-২০২০ ইং তারিখ হতে ১১-০৫-২০২০ ইং তারিখ পর্যন্ত লে অফ ঘোষণা করা হলো। লে অফ চলাকালীন কারখানায় উপস্থিত হওয়ার প্রয়োজন নেই এবং যাবতীয় পাওনাদি ইপিজেড শ্রম আইন-২০১৯ এর ধারা ১৫ অনুযায়ী যথাসময়ে প্রদান করা হবে।’

কারখানাটির একজন শ্রমিক আলমগীর হোসেন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘হঠাৎ করে কারখানা লে অফ করায় আমাদের মধ্যে আতংক কাজ করছে। পরিবার নিয়ে এখন কিভাবে দিনযাপন করব তা বুঝতে পারছি না। আগের চেয়ে প্রায় অর্ধেক বেতন দিয়ে সংসার চালানো সম্ভব হবে না। কি করবো বুঝেও উঠতে পারছি না। লে অফের পরও কারখানা চালু হবে কিনা তা নিশ্চিত না। এখন আতংকের মধ্যে আছি।’

কেনপার্ক (বিডি) লিমিটেড কারখানায় কাজ করেন কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার আকলিমা খাতুন। তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘কারখানায় কাজ কমে যাওয়ায় লে অফের ঘোষণা গত ১২ এপ্রিল মোবাইলে এসএমএসের মাধ্যমে আমাদের জানিয়ে দিয়েছে। সামনে রমজান আর ঈদ আসছে। এমন পরিস্থিতিতে কিভাবে সংসারের খরচ চালাবো তা ভাবতেই পারছি না।’

বাংলাদেশ ইপিজেড শ্রম আইন ২০১৯ অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণের বাহিরে বা অনিচ্ছাকৃত কোনো সমস্যার কারণে কারখানার মালিকরা লে অফ ঘোষণা করতে পারেন। তবে শ্রমিকরা লে অফের ক্ষতিপূরণ হিসেবে মূল বেতনের অর্ধেকের পাশাপাশি বাড়ি ভাড়ার পুরো অংশ পাবেন। একই সঙ্গে পূর্ণ বোনাসও পাবেন। তবে চিকিৎসা ভাতা, যাতায়াত ভাতাসহ আনুষাঙ্গিক ভাতা পাবেন না। আইন অনুযায়ী, ৪৫ দিনের লে অফের পর আবেদনের প্রেক্ষিতে আরও ১৫ দিন লে অফ রাখতে পারবেন কারখানার মালিকপক্ষ। এরপরেও সমস্যা থেকে উত্তরণ না হলে শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধ সাপেক্ষে আইন অনুযায়ী ছাঁটাই করতে পারবে। তবে যাদের চাকুরীর বয়স ১ বছর হয়নি তারা কোনো সুবিধাই পাবেন না। ফলে বেকার হয়ে পড়বেন চুক্তিভিত্তিক ও এক বছরের কম সময় চাকরী করা শ্রমিকরা।

চট্টগ্রাম ইপিজেডের মহাব্যবস্থাপক খুরশেদ আলম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘ইতিমধ্যে বাংলাদেশ ইপিজেড শ্রম আইন ২০১৯ এর ১১ ধারা অনুযায়ী বেপজার অনুমোদন সাপেক্ষে ৪৬টি কারখানাকে লে অফ অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। প্রতিদিনই অনেক কারখানা লে অফের জন্য আবেদন করছেন। তা যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এ ইপিজেডের ১৪৬টি কারখানার মধ্যে ৮-১০টি কারখানা ছাড়া বাকি সব কারখানাই লে অফের চিন্তা-ভাবনা করছে। আমরা তাদের সঙ্গে আলোচনা করে শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষার চেষ্টা করছি।’

চলতি সপ্তাহের মধ্যে পুরো চিত্র পাওয়া যাবে বলে যোগ করেন তিনি।

একইভাবে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী ইপিজেডের ৪১টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১৯টি প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যে লে অফের অনুমোদন পেয়েছে। আবেদন যাচাই-বাছায়ের প্রক্রিয়ায় রয়েছে আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান।

কেইপিজেডের মহাব্যবস্থাপক মশিউদ্দিন বিন মেজবাহ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘এই ইপিজেডে ৪১টি কারখানায় প্রায় ৮০ হাজার শ্রমিক কাজ করছেন। প্রায় সব কারখানায় লে অফ চাচ্ছে। ইতিমধ্যে বেশকিছু কারখানা আবেদন করেছে। আমরা যাচাই-বাছাই করে তা অনুমোদন দিচ্ছি। বাংলাদেশ ইপিজেড শ্রম আইন অনুযায়ী কারখানার মালিকরা লে অফের আবেদন করছেন। আমরা মৌখিকভাবে তাদের ভরসা দিচ্ছি। পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে তা এখনই বলা যাচ্ছে না।’

তৈরি পোশাক শিল্পের সংগঠন বিজেএমইএর সহ-সভাপতি এ এম চৌধুরী সেলিম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘এখন কারখানা বন্ধ ঘোষণা করা ছাড়া আমাদের কাছে আর কোনো বিকল্প পথ খোলা নেই। ক্রমেই আমাদের অর্ডার বাতিল হচ্ছে। আবার যারা অর্ডার স্থগিত করছেন তারা কখন পণ্য নিবেন তারও কোনো ঠিক নেই। ইউরোপে সব শোরুম বন্ধ থাকায় যেসব কাজ সম্পূর্ণ করা হয়েছে তাও বায়াররা নিচ্ছেন না। এ মৌসুমের জন্য তৈরি করা পণ্য বিক্রি করার জন্য আমাদের আবার এক বছর অপেক্ষা করতে হবে। তারপরও বায়াররা পণ্য নিবেন কিনা কিংবা নিলে কি দামে নেবেন তার নিশ্চয়তা নেই।’

সংগঠনটির প্রথম সহ-সভাপতি ও এশিয়ান গার্মেন্টসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ সালাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘করোনাভাইরাসের কারণে সারা বিশ্বই স্থবির হয়ে পড়েছে। চট্টগ্রামে প্রায় ৪৫০টির মতো কারখানা চালু আছে। এরমধ্যে মাত্র ৫-১০টি কারখানা ছাড়া আর কারও পক্ষেই কাজ না থাকলে এক মাসের বেতনও দেওয়া সম্ভব না। প্রতিটি অর্ডারে আমাদের প্রায় ২৩-২৫ শতাংশ মুনাফা হয়। যার মধ্যে শ্রমিকদের বেতন বাবদ ব্যয় হয় ১৮-২০ শতাংশ। তাছাড়া পরিবহনসহ অন্যান্য খরচ বাদ দিয়ে আমাদের মুনাফা ২-৩ শতাংশ থাকে। ফলে নতুন করে অর্ডার না আসলে কিংবা কারখানায় কাজ না থাকলে আমাদের পক্ষে বেতন-ভাতা দেওয়া অসম্ভব।’

তিনি আরও বলেন, ‘লে অফ করে হয়তো কারখানাগুলো কিছুটা ক্ষতি কমাতে পারবে। তবুও অর্ধেক বেতন তাদের দিতে হবে। লে অফের মধ্যে কর্মচারীদের এই অর্ধেক বেতন কোথা থেকে দিবে তার নিশ্চয়তাও প্রায় ৯৫ শতাংশ কারখানার মালিকরা জানেন না।’

দেশের গার্মেন্টস শিল্প হুমকির মুখে আছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রতিযোগী দেশ ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া এখনো তাদের পোশাক কারখানা সচল রাখতে পারছে। যা আমরা পারিনি। ফলে আমাদের কিছু অর্ডার সেসব দেশে চলে যাওয়ার আশংকা রয়েছে। দেশের পরিস্থিতি কিছুটা ভালো হলে ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা ও ইন্দোনেশিয়ার মতো ছোট পরিসরে হলেও গার্মেন্টস কারখানা খুলে দেওয়া উচিত। তা না হলে পর্যায়ক্রমে সব কারখানাই লে অফ বা বন্ধ করে দেওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না।’

Comments

The Daily Star  | English
Sheikh Hasina's Sylhet rally on December 20

Hasina doubts if JP will stay in the race

Prime Minister Sheikh Hasina yesterday expressed doubt whether the main opposition Jatiya Party would keep its word and stay in the electoral race.

5h ago