মহামারি সংকটে পড়বে ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ দেশগুলো
করোনাভাইরাস মহামারির প্রভাবে চীনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ পরিকল্পনা পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, চীনা বিনিয়োগে মন্দা ও অংশীদার দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য কমে যেতে পারে। অন্যদিকে, মহামারির কারণে বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশে চীনা অর্থায়নে নির্মিত অবকাঠামো প্রকল্প আটকে থাকায় দেশগুলোর অর্থনীতি জটিল পরিস্থিতিতে পড়বে।
দ্য সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট জানায়, অর্থনৈতিক ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে চীনের প্রায় এক বছর সময় লাগতে পারে। বেইজিংয়ের সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২০ সালের প্রথম তিন মাসে চীনের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৬ দশমিক ৪ শতাংশ কমে গেছে।
দেশটির বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ১৮ দশমিক ৩, ইউরোপের দেশগুলোর সঙ্গে ১০ দশমিক ৪ ও জাপানের সঙ্গে ৮ দশমিক ১ শতাংশ বাণিজ্য হ্রাস পেয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও জাপানের তুলনায় ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ পরিকল্পনার অংশীদার দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য ৩ দশমিক ২ শতাংশ বাড়লেও তা গত বছরের তুলনায় ১০ দশমিক ৮ শতাংশ কমেছে।
দেশটির বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জানায়, চীনের বার্ষিক বাণিজ্যের প্রায় ৩০ শতাংশ হলো আফ্রিকা, এশিয়া, ইউরোপ ও দক্ষিণ আমেরিকার ৫৬টি ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ অংশীদার দেশের সঙ্গে।
নানকাই বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিভাগের অধ্যাপক টং জিয়াডং জানান,এ বছর ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ দেশগুলোর সঙ্গে চীনের বাণিজ্য ২ থেকে ৫ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে।
তিনি বলেন, ‘বছরের প্রথম চতুর্থাংশে চীনের মোট বাণিজ্যে হ্রাস পাবে এটা এরকম নিশ্চিত ছিল। তবে, উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এই অর্থনীতির ক্ষতি কেটে যাবে। বিশেষ করে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, পূর্ব ইউরোপ ও আরব দেশগুলোর সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক পুনরুদ্ধার করা সম্ভব।’
তিনি আরও বলেন, ‘তবে, চীনের এরপরের তিন মাসের অর্থনীতি নির্ভর করছে “বেল্ট অ্যান্ড রোড” দেশগুলোতে মহামারি কেমন প্রভাব ফেলছে তার উপর।’
এদিকে, হংকংভিত্তিক ইকোনোমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের বিশ্ব বাণিজ্য বিভাগের প্রধান নিক ম্যারো জানান, এই বছর চীনের মোট বিদেশি বিনিয়োগের প্রায় ৩০ শতাংশ কমে যেতে পারে।
তিনি বলেন, ‘চীনের অভ্যন্তরীণ স্বাস্থ্য সংকটের কারণে দেশটির বাণিজ্যে মারাত্মক প্রভাব পড়বে। আন্তর্জাতিক বাজারে চীনের যে আধিপত্য তা কমে যাবে ও বিনিয়োগের চাহিদাও কমে যাবে।’
ইতোমধ্যে, চীনা প্রতিষ্ঠান নির্মিত ও পরিচালিত কম্বোডিয়া শহরের অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর অগ্রগতি কমে গেছে। পাশাপাশি, বাংলাদেশের পায়রা তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ অন্যান্য অবকাঠামো প্রকল্প আটকে গেছে।
ম্যারো জানান, সামনের দিনগুলোতে ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ প্রকল্পের মূল অংশীদার দেশগুলোর অর্থনীতি জটিল হয়ে উঠবে। যেমন, কেবল পাকিস্তানেই প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলারের অবকাঠামোগত প্রকল্প চীনা অর্থায়ন নির্মিত হচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘পাকিস্তানের অবস্থা বেশ উদ্বেগজনক। অন্যান্য দেশের তুলনায় পাকিস্তানের সরকারি ঋণ অনেক বেশি। অন্যদিকে, করোনাভাইরাসের কারণে এই বছর পাকিস্তানের জিডিপি প্রায় ১০ শতাংশ কমতে পারে।’
গত সপ্তাহে পাকিস্তানের স্থানীয় সংবাদপত্র ডনের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য দেওয়া ৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ পরিশোধের জন্য পাকিস্তান চীনের কাছে ১০ বছর মেয়াদ বাড়ানোর অনুরোধ জানিয়েছে।
টং জানান, মহামারির কারণে চীনা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। তারা অন্যান্য দেশ, বিশেষ করে যেসব দেশে মহামারি প্রকট আকার ধারণ করেছে সেসব দেশে বিনিয়োগ করতে ভরসা পাচ্ছেন না।
তিনি বলেন, ‘সামনের দিনগুলোতেও চীনা বিনিয়োগ হ্রাস পাবে। তবে, “বেল্ট অ্যান্ড রোড” পরিকল্পনার অতীত অভিজ্ঞতা চীনকে অনেক কিছু শিখিয়েছে। ধীর স্থির হয়ে নিজেদের স্বার্থ সম্পর্কে ভাবতে শিখিয়েছে। তাই মহামারির এ সময়টাতে সব পক্ষই এ ব্যাপারে চিন্তা করবে।’
নেদারল্যান্ডসের ক্লিনজেনডেল ইনস্টিটিউটের সিনিয়র গবেষক ডা. ফ্রান্স পাল ভ্যান ডের পুটেন জানান, চীন মহামারি পরবর্তী কৌশল হিসেবে ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ এর অংশ হিসেবে ইউরোপের বন্দর ও বিমানবন্দরে বিনিয়োগের মতো বড় অবকাঠামো প্রকল্প থেকে সরে আসতে পারে।
তিনি বলেন, ‘সামনের বছরগুলোতে ঋণ ও বিনিয়োগের পরিমাণ ২০১৫-১৬ সালের তুলনায় কমে গেলেও আমি আশা করি ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ পরিকল্পনা যে বৈদেশিক অর্থনৈতিক সম্পর্কের কাঠামো তা টিকে থাকবে।’
Comments