নারায়ণগঞ্জের কাউন্সিলর খোরশেদ আলমের অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত
‘কী করোনা আইল, বাবা মারা গেল, আমি কান্না করতেছি কিন্তু আশেপাশের বাসার কেউ ঘর থেকে দরজা খুলে বের হয়নি। আত্মীয় স্বজনরাও কেউ আসেনি। পরে বাড়ির মালিকের পরামর্শে খোরশেদ ভাইকে ফোন দিই। তিনি এসেই বলেন, “কাকা মারা গেছে”। তিনি তখন আমার কাছে ভগবান, আমার পরম আত্মার আত্মীয় হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। খোরশেদ ভাই সব কিছু করে বাবার মরদেহ দাহ করছেন।’
গতকাল শনিবার বিকালে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ১৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মাকছুদুল আলম খন্দকার খোরশেদ সম্পর্কে দ্য ডেইলি স্টারকে কথাগুলো বলেন শহরের আমলাপাড়া এলাকার বাসিন্দা নিয়তি রানী বণিক। যার বাবা ডা. কৈলাস বণিক (৬০) গত ১৯ এপ্রিল করোনাভাইরাসের উপসর্গ নিয়ে মারা যান। তিনি মারা যাওয়ার পর শেষকৃত্যের জন্য যখন কেউ এগিয়ে আসেনি, তখন ফোন পাওয়া মাত্রই এগিয়ে যান কাউন্সিলর খোরশেদ।
একই দিনে ঢাকার কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান সিপিবি’র নারায়ণগঞ্জ মহানগরের সদস্য ও ১৪ নম্বর ওয়ার্ড সেক্রেটারি বিকাশ সাহা। সন্ধ্যায় মরদেহ মাসদাইর শ্মশানে আসলে দাহ করতে সহযোগিতা করেন কাউন্সিলর খোরশেদ।
বিকাশ সাহার ছেলে অনির্বাণ সাহা বলেন, ‘বাবা করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন শুনে আত্মীয় স্বজন কেউ আসেনি। আমার একার পক্ষে বাবার মরদেহ দাহ করা সম্ভব ছিল না। কারণ দাহ করতে অনেক নিয়ম-কানুন আছে। এতো কিছু আমি একা কীভাবে করবো। আর কেউ এগিয়েও আসছিল না। তাই খোরশেদ কাকাকে খবর দিই, তিনি এসে সহযোগিতা করেন।’
শুধু হিন্দু সম্প্রদায়ের মৃতদের শেষকৃত্যেই কাউন্সিলর খোরশেদ এগিয়ে যাননি, করোনায় আক্রান্ত কিংবা উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়া মুসলিম ব্যক্তিদের মরদেহও দাফন করে চলেছেন তিনি।
সম্প্রতি শহরের আমলাপাড়া এলাকায় একই পরিবারের তিনজন করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তিন জনের মরদেহই দাফন করেন কাউন্সিলর খোরশেদ। তাদের পরিবারের সদস্য টুটুল আহমেদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘কী দুর্ভাগ্য যে একেক করে খালা, মামা ও মামাতো বোনকে তিনিই (খোরশেদ) দাফন করেন। খোরশেদ ভাই আমাদের রক্তের সম্পর্কের না হলেও, এখন তিনিই সব থেকে বড় আপনজন। তিনি না থাকলে হয়তো জানাজা ছাড়াই মরদেহ দাফন করতে হত। উনার কারণে ধর্মীয় রীতিতে মাটি পেয়েছে তিনজন।’
কাউন্সিলর খোরশেদ শহরের মাসদাইর এলাকার মৃত শাহ আলম খন্দকারের ছেলে। তিনি কাউন্সিলরের পাশাপাশি নারায়ণগঞ্জ মহানগর যুবদলের সভাপতি। তিন ভাইয়ের মধ্যে তিনি তৃতীয়। বড় ভাই তৈমূর আলম খন্দকার বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও মেঝো ভাই মৃত সাব্বির আলম খন্দকার ছিলেন বিকেএমইএ’র পরিচালক। স্ত্রী, ছেলে ও দুই মেয়ে নিয়ে খোরশেদের ছোট সংসার।
কাউন্সিলর খোরশেদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘যখন দেখলাম করোনায় আক্রান্ত হলে স্বজনরা লাশের কাছে যেতে চায় না। মানবিক দিক বিবেচনা করে এটা মাথায় এসেছে। আসলে মানুষের বিপদের দিনেই পাশে থাকা জরুরি। এখনই মানুষের সব থেকে বড় বিপদ চলছে। এ ছাড়াও, আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য এ কাজে এসেছি।’
তিনি বলেন, ‘আমি হঠাৎ করে এ কাজ শুরু করিনি। প্রথমে হ্যান্ড স্যানিটাইজার বানানো ও বিতরণ করা থেকে এ কাজে যুক্ত হলাম। এভাবে জড়িয়ে পড়েছি বলেই পরিবার কোনো বাধা দিতে পারেনি। তারপরও পরিবার ভীত, বারবার অনুরোধ করে সর্তক থাকার জন্য।’
‘গত ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার পরদিনই মানুষকে সচেতন করতে ২০ হাজার লিফলেট বিতরণ শুরু করি। পরে ১৮ মার্চ নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলায় এক নারী করোনায় আক্রান্ত হয়ে প্রথম মারা যাওয়ার পর ওষুধের দোকানে হেক্সিসল কিনতে গিয়ে পাইনি। তারপর গবেষকদের পরামর্শ অনুযায়ী নিজেই ৬০ হাজার হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরি করে বিতরণ করি। পরে সিটি করপোরেশনে অনুরোধ জানাই নারায়ণগঞ্জে করোনা পরীক্ষার ল্যাব স্থাপন ও মরদেহ দাফনের অনুমতি দেওয়ার জন্য। এর প্রেক্ষিতে ৮ এপ্রিল প্রথম উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়া ব্যক্তির মরদেহ দাফন করি। গত ২৫ এপ্রিল সন্ধ্যা পর্যন্ত মোট ৩১ জনের শেষকৃত্যের কাজ করেছি। যার মধ্যে হিন্দু ৫ জনকে দাহ ও মুসলিম ২৬ জনকে দাফন করা হয়। এ কাজে আমার সহযোগিতায় ছিলেন ১২ জন স্বেচ্ছাসেবক। এ ছাড়াও, সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করায় কর্মহীন ও অসহায় পরিবারের মধ্যে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করছি। এতে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে আছেন আরও ২৩ জন’, যোগ করেন তিনি।
কাউন্সিলর খোরশেদ আরও বলেন, ‘আল্লাহ আমাকে এ কাজ করার জন্য সুযোগ করে দিয়েছেন, এজন্য ধন্যবাদ জানাই। একইসঙ্গে ধন্যবাদ জনাই আমার আহ্বানে সাড়া দিয়ে আমাকে সহযোগিতার জন্য ক্ষুদ্র পেশার যেসব লোকজন স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে এগিয়ে এসেছেন তাদেরকেও।’
প্রথম মরদেহ দাফনের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে খোরশেদ বলেন, ‘এটা আমার খুব মনে থাকবে। কারণ ওই ব্যক্তির কোনো ছেলে নেই। দুই মেয়ে ও স্ত্রী। বড় মেয়ে আমাকে ফোন দিয়ে বলে, আমার বাবা করোনা উপসর্গ নিয়ে রাতে মারা গেছেন। কিন্তু বাসায় কোনো পুরুষ নেই। কেউ এগিয়েও আসছে না মরদেহ দাফন করার জন্য। আপনি ঘোষণা দিয়েছেন দাফন করতে চান, তাহলে আমাদের সহযোগিতা করুন।’
তিনি বলেন, ‘আমি ওই বাসায় গেলে মেয়েরা দূর থেকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় পাশের রুমে বাবার মরদেহ। রুমের দরজা বন্ধ ছিল। আমি ধাক্কা দিই, মনে মনে ভাবছিলাম ভেতরে কেউ হয়তো মরদেহের পাশে বসে কান্না করছে। কিন্তু ভেতরে কেউ নেই। বিছানায় শরীর ও ফ্লোরে পা ছিল। মরদেহ নিয়ে চলে আসলাম, কিন্তু কেউ একটু কান্নাও করেনি এবং সামনেও আসেনি। এমন মৃত্যু দেখে নিজেই খুব কষ্ট পেয়েছি।’
খোরশেদ বলেন, ‘এখন পর্যন্ত নারী পুরুষ সব মিলিয়ে ৩১ জনের মরদেহ দাফন করেছি। এর মধ্যে ১০ থেকে ১২ জন ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের হলেও বাকিরা আশেপাশের ওয়ার্ড ও ইউনিয়নের বাসিন্দা। যারাই মরদেহ দাফন করার জন্য লোক পাচ্ছে না, জানালে আমরা তাদের সহযোগিতা করছি। এ কাজ করতে গিয়ে এখন পর্যন্ত একই পরিবারের ভাই, বোন ও মেয়েকে (তিনজন) পরপর দাফন করেছি। এখন সেই পরিবারে নানী আর নাতনি ছাড়া কেউ নেই। যা অত্যন্ত বেদনাদায়ক।’
তিনি বলেন, ‘ঝুঁকি আছে। আর সেটা সব থেকে বেশি আমার পরিবারের। তাই এক মাস ধরে আলাদা আছি। ওরা তিন তলায় থাকে আর আমি দ্বিতীয় তলার একটি রুমে থাকি। সেখানেই খাই, ঘুমাই, গোসল করা থেকে সব কিছু করি। স্ত্রী ও সন্তানদের কাছে আসতে নিষেধ করেছি। দূর থেকে দেখি আর ফোনে কথা বলি। তবে ইতোমধ্যে নমুনা পরীক্ষা করিয়েছি যেহেতু আমি আক্রান্তদের সংস্পর্শে গিয়েছি। কিন্তু আইইডিসিআর থেকে পাঠানো আমার করোনা পরীক্ষা ফল নেগেটিভ এসেছে।’
তিনি বলেন, ‘ব্যক্তিগত উদ্যোগের পাশাপাশি অনেকেই সহযোগিতার জন্য এগিয়ে এসেছেন। কেউ আর্থিকভাবে সহযোগিতা করেছেন, আবার কেউ স্বাস্থ্য সুরক্ষার সরঞ্জাম দিয়ে সহযোগিতা করছেন। যারা মরদেহ দাফনের নূন্যতম খরচ দিতে পারছেন না, তাদের খরচটা আমরাই বহন করছি। এভাবেই কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। এ ছাড়া, সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী সকল ধরনের সহযোগিতা করার আশ্বাস দিয়েছেন।’
খোরশেদ আলমের আহ্বানে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করা ১২ জনের মধ্যে আনোয়ার হোসেন একজন ফার্নিচার ব্যবসায়ী। তিনি বলেন, ‘খোরশেদ ভাই মহৎ কাজ করছেন। ফেসবুকে ভিডিও দেখে আমার ইচ্ছা হয় তাকে সহযোগিতা করার জন্য। এভাবেই এ কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়েছি। বিশেষ করে আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য এ প্রচেষ্টা।’
তিনি বলেন, ‘কম বেশি ভয় সবার মধ্যে আছে। ঝুঁকিও আছে। সব কিছু জেনেই এখানে এসেছি। তবে স্বেচ্ছাসেবক হিসেব আসলেও খোরশেদ ভাই নিজের যেমন খেয়াল রাখেন, তেমনি আমাদের নিরাপত্তার বিষয়েও খেয়াল রাখেন, সব ধরনের সহযোগিতা করেন।’
কাউন্সিলর খোরশেদের স্ত্রী আফরোজা খন্দকার রুনা বলেন, ‘করোনা নিয়ে আতঙ্কে নেই এমন কেউ আছে বলে মনে হয় না। করোনাকে সবাই ভয় পাচ্ছে। আমরা এর ঊর্ধ্বে না, আমরাও ভয় পাই। একজন কাউন্সিলর মানবতার দিক থেকে ঘোষণা দিয়েছেন মরদেহ দাফনে যাবেন। তাই বাধা দিইনি। এর মধ্যেও একবার দিয়েছি, কিন্তু তিনি সেটা শুনেনি। তাই বলেছি যতটা নিরাপদ থেকে কাজ করা যায়, সেটা যেন অনুসরণ করে। তবে দুশ্চিন্তা তো থাকেই।’
তিনি বলেন, ‘আমার সন্তানরা তার বাবাকে খুব বেশি মিস করে। ছোট মেয়েটা তো প্রতিদিন কান্না করে। এমনিতেই কাউন্সিলর হওয়ায় ঠিকভাবে সময় দিতে পারত না। আর এখন একসঙ্গে বসে কথা বলা হয় না, খাবার খাওয়া হয় না, আলাদা রুমে থাকে। সব সময় একটা ভয় আছে, কিন্তু ভালো লাগে সে মানুষের পাশে আছে। আমি আমার স্বামীর সুস্থ থাকার জন্য সকলের কাছে দোয়া চাই।’
‘আমরা নারায়ণগঞ্জবাসী’ সামাজিক সংগঠনের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা নূর উদ্দিন বলেন, ‘মানবতার দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবেন খোরশেদ। তবে তাকে আরও সর্তক হয়ে কাজ করতে হবে। কারণ জনপ্রতিনিধি হিসেবে তার আরও কাজ বাকি আছে।’
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী বলেন, ‘খোরশেদ খুব ভালো কাজ করছে। আমি তার তারিফ করি। আমি আশা করি ভবিষ্যতেও সে এ ধরনের কাজ করবে। আমরা সিটি করপোরেশন থেকে তাকে সহযোগিতা করছি। সে যখন যা চাচ্ছে, তাকে সাপোর্ট দিতে চেষ্টা করছি।’
Comments