অক্সিজেন ঘাটতিতে কোভিড-১৯ হাসপাতাল
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দাবি, রোগীদের অক্সিজেন সরবরাহ করতে কোনো সমস্যা হবে না। কিন্তু, রোগী এবং চিকিৎসকদের কণ্ঠে শোনা যাচ্ছে ভিন্ন সুর।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা বলেন, ‘করোনা রোগীদের জন্য আমাদের পর্যাপ্ত অক্সিজেন সিলিন্ডার আছে।’
‘উপজেলা পর্যায়ে আমাদের ১০ হাজার ৯৯৪টি সিলিন্ডার রয়েছে। বিভাগীয় শহরগুলোতে, মেডিকেল কলেজের বাইরেও ১৩ হাজার ৭৭৫টি সিলিন্ডার রয়েছে। কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ৪৫০টি এবং কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে ১২৩টি সিলিন্ডার আছে,’ বলে জানান তিনি। এই হাসপাতালগুলোতে কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা না থাকলেও কোনো সমস্যা হবে না বলেও তিনি যোগ করেন।
তবে, চিকিৎসাকর্মী এবং রোগীরা এটাকে বড় সমস্যা বলেই মনে করছেন।
কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহের অর্থ হলো, হাসপাতালে একটি নির্দিষ্ট জায়গা থাকবে যেখান থেকে পাইপ লাইনের মাধ্যমে অক্সিজেন সরবরাহ করা হবে প্রতিটি রোগীর শয্যায়। কয়েকজন কর্মী থাকেন যারা স্টোরেজ চেম্বারে কতটুকু অক্সিজেন আছে তা পর্যবেক্ষণ করেন এবং সার্বক্ষণিক সরবরাহ নিশ্চিত করেন।
চিকিৎসকরা জানান, সিলিন্ডারের সমস্যা হলো, পর্যাপ্ত পরিমাণে সিলিন্ডার স্টকে আছে কিনা এবং সেগুলো ঠিকভাবে রিফিল করা হয়েছে কিনা তা তদারকি করতে হয় চিকিৎসক বা নার্সদের।
অব্যবস্থাপনা আর জনবলের ঘাটতির কারণে করোনাভাইরাসের জন্য নির্ধারিত হাসপাতালগুলোতে এটা একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই সমস্যাটি রোগী মারা যাওয়ার আশঙ্কাও বাড়িয়ে তুলছে।
গুরুতর অবস্থায় ১৮ এপ্রিল কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয় বিকাশ সাহাকে। নারায়ণগঞ্জের খানপুরের একটি হাসপাতাল থেকে তাকে এখানে পাঠানো হয়। মাঝরাতে তার শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। তার স্ত্রী তিন ঘণ্টা চেষ্টার করেও সেই রাতে অক্সিজেনের ব্যবস্থা করতে পারেননি। অবশেষে যখন অক্সিজেন পান, সেই সিলিন্ডারেও সমস্যা ছিল বলে দাবি পরিবারের।
রোগীর ছেলে অনির্বাণ সাহা বলেন, ‘ওয়ার্ডে কোনো চিকিৎসক বা নার্স ছিলেন না। তারা অন্য কোথাও ছিলেন। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করারও কোনো উপায় ছিল না, কারণ রোগীর এটেনডেন্টরা নিজে ওয়ার্ডের বাইরে যেতে পারেন না। নার্সদের ডাকার একমাত্র উপায় পাহারায় থাকা আনসার সদস্য। আমার বাবার এটেনডেন্ট হিসেবে মা হাসপাতালে ছিলেন। তিনি আনসার সদস্যদের কয়েকবার বলেছেন নার্সদের ডেকে দিতে, কিন্তু তারা কথায় গুরুত্ব দেননি।’
পরে এক নার্স এসে তাকে একটি অক্সিজেন সিলিন্ডার দিয়ে চলে যান। অনির্বাণের দাবি, তার বাবা তাকে বলেছিলেন যে সিলিন্ডারটি কাজ করছে না। ‘এর আগেও আমার বাবাকে অক্সিজেন দেওয়া হয়েছিল এবং তখন তিনি ভালো বোধ করেছিলেন। এবার তাকে দেওয়া অক্সিজেন কাজ করছিল না। এটা নেওয়ার পরও শ্বাস নিতে সমস্যা হচ্ছিল এবং তার অক্সিজেন পরীক্ষা করতে নার্সদের ডাকতে বলেন।’
অনির্বাণের মা আনসার সদস্যদের কয়েকবার বলেন নার্সদের ডাকতে। কিন্তু, কেউ আসেনি। ‘নিরাপত্তা প্রহরীরা আমার মাকে বলেছিল, আমার বাবাকে অক্সিজেন দেওয়া হয়েছে, সব ঠিক হয়ে যাবে। আমাদের ধৈর্য ধরা দরকার। সকাল ৬টার দিকে নার্সরা বাবাকে দেখতে এসেছিল, কিন্তু ততক্ষণে আমার বাবা মারা গেছেন।’
অনির্বান আরও বলেন, ‘নার্সরা আসার আগেই আমার বাবার হাত ও পায়ের আঙ্গুল নীল হয়ে গিয়েছিল। তিনি চার-পাঁচ বার জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে নিঃশব্দে চলে গেলেন।’
রাজধানীর তোপখানা রোডের সার্জিক্যাল যন্ত্রপাতির দোকান নেক্সট কেয়ার সার্জিকাল এর স্বত্বাধিকারী রুবেল আহমেদ বাবু জানান, একটি অক্সিজেন সিলিন্ডারে দুই হাজার লিটার অক্সিজেন থাকে।
তিনি বলেন, ‘এটা কতক্ষণ চলবে তা নির্ভর করে কতটা অক্সিজেন দেওয়া হচ্ছে তার উপর। প্রতি মিনিটে কমপক্ষে তিন লিটার অক্সিজেন দিতে হয়।’
সাক্ষাৎকারে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, ওয়ার্ডগুলোতে রোগীদের প্রতি মিনিটে ছয় থেকে ১০ লিটার অক্সিজেন দেওয়া হচ্ছে। সে হিসাবে একটি দুই হাজার লিটারের সিলিন্ডার রোগীভেদে সাড়ে তিন থেকে সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা চলে।
সাক্ষাৎকার নেওয়া তিন জন চিকিৎসকের কেউই নাম প্রকাশে রাজি হননি। কেননা, একটি সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী তাদের গণমাধ্যমের সামনে কথা বলা নিষেধ।
তারা জানান, রোগীর যে চাপ রয়েছে তাতে অক্সিজেন সিলিন্ডারগুলো দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছে।
হাসপাতালের কর্মীদের তিনটি গ্রুপে বিভক্ত করা হয়েছে। একটি গ্রুপ যখন কাজ করে তখন অপর একটি গ্রুপ কোয়ারেন্টিনে থাকে। এর অর্থ হাসপাতালটি চলছে এক তৃতীয়াংশ কর্মী নিয়ে। যার কারণে কোন রোগীর সিলিন্ডার কখন খালি হয়েছে তা পর্যবেক্ষণ করা অসম্ভব।
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য হাসপাতালটির পরিচালকের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
করোনাভাইরাস রোগীদের চিকিৎসার জন্য ডেডিকেটেড অন্যান্য হাসপাতালগুলোতেও কেন্দ্রীয়ভাবে অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা নেই।
কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. শেহাব উদ্দিন দাবি করেছেন, বর্তমানে ভর্তি থাকা ১২৮ জন রোগীর জন্য ১২৩টি ক্যানিস্টারই পর্যাপ্ত। রেলওয়ে জেনারেল হাসপাতালের পরিচালক ডা. ফিরোজ আলমগীর জানিয়েছেন, এই পরিমাণ ক্যানিস্টার থাকার অর্থ বর্তমানে তিনি গুরুতর রোগীর সেবা দিতে পারবেন না।
ডা. ফিরোজ আলমগীর বলেন, ‘আমি অক্সিজেন সিলিন্ডার ব্যবহার করতে পারি, তবে সেটা শুধু মাঝারি ঝুঁকিতে থাকা রোগীদের জন্য। তাদের অবস্থার অবনতি হলে তাদেরকে আইসিইউ আছে এমন হাসপাতালে রেফার করতে হবে।’
ইউনাইটেড হাসপাতাল লিমিটেডের বিজনেস ডেভেলপমেন্টের প্রধান ডা. শাগুফা আনোয়ার বলেন, ‘কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহ ছাড়া হাসপাতাল পরিচালনার কথা আমি ভাবতেও পারি না। এটি বাধ্যতামূলক।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডা. নাসিমা সুলতানা জানিয়েছেন, আরও তিন হাজার ৫০০ অক্সিজেন সিলিন্ডার আমদানি করা হচ্ছে, তবে সেগুলো এখনও এসে পৌঁছেনি।
(সংক্ষেপিত, পুরো প্রতিবেদনটি পড়তে এই Covid-19 Hospitals: Gasping for oxygen লিংকে ক্লিক করুন)
Comments