করোনায় পার পেলেও রেহাই নেই জলবায়ু পরিবর্তনে
করোনাভাইরাস সংক্রমণে প্রতিদিন হাজারো মানুষের প্রাণ ঝরছে। উন্নত দেশগুলোর নার্সিং হোমে মানুষ নিঃসঙ্গ মরে পড়ে থাকছে। হিমঘরে জমে উঠছে মরদেহের স্তুপ। গণমাধ্যমের কল্যাণে আমরা গণকবরের ছবিও দেখছি। অনেকের শেষ যাত্রায় নেই স্বজনের উপস্থিতি। তাদের সমাধিতে পড়ে না স্বজনের শেষ অশ্রুটুকুও। মানব সভ্যতাকে আজ এক নিষ্ঠুর বাস্তবতার সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে করোনাভাইরাস।
গত ডিসেম্বরে চীনের উহানে এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরুর পর এখন পর্যন্ত পৃথিবীব্যাপী প্রায় ২৯ লাখ মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন এবং মৃত্যু হয়েছে দুই লাখেরও বেশি মানুষের। সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে বাংলাদেশেও।
লকডাউনের কারণে বিশ্বের ২০ শতাংশ মানুষ আজ ঘরবন্দি। কর্মহীন হয়ে পড়ছেন কোটি কোটি মানুষ। কবে মানুষ আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবেন, কবে সচল হবে অর্থনীতির চাকা তা এখনও অজানা। এমন পরিস্থিতিতে কয়েক মাসের মধ্যে তিন কোটি মানুষের না খেয়ে মরার আশঙ্কা প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ।
পরিবেশ ধ্বংসের পরিণাম
মানুষ কি তার পরিবেশ ধ্বংসের পরিণাম ভোগ করছে? কিছু তথ্য হয়তো এই প্রশ্নের উত্তর নিয়ে ভাবতে শেখাবে। জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির (ইউএনইপি) তথ্য, গড়ে প্রতি চার মাসে একটি সংক্রামক রোগ মানুষের মধ্যে ছড়ায়। এসব সংক্রামক রোগের ৭৫ শতাংশ আসে প্রাণী থেকে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বলছে, নতুন করোনাভাইরাস এসেছে বাদুর থেকে। দ্য ইউনিভার্সিটি অব হংকং ও দ্য ইউনিভার্সিটি অব সিডনির একদল গবেষক জানিয়েছেন, বাদুর থেকে প্যাঙ্গোলিন (বনরুই) হয়ে মানুষের শরীরে এসেছে নতুন এই ভাইরাস। এখানে জেনে রাখা প্রয়োজন, বিশ্বের যে প্রাণীটি সবচেয়ে বেশি পাচারের শিকার হয় তা প্যাঙ্গোলিন বা বনরুই।
তবে চীনের তথ্য গোপনের সুযোগ নিয়ে পশ্চিমের দেশগুলো এতে ষড়যন্ত্র দেখছে। প্রকৃতি নয়, চীনের গবেষণাগার থেকে ভাইরাস ছড়াতে পারে বলে সন্দেহ করছেন তারা।
সে যাই হোক, বাস্তবতা হচ্ছে, বিশ্বের ট্রপিক্যাল বা চিরহরিৎ বন উজাড়ের হার ৮ দশমিক ৫ শতাংশ। এ তথ্য জাতিসংঘ খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও)। সায়েন্টিফিক অ্যামেরিকার হিসাব, বিশ্বের প্রতিদিন ১৬০ একর বনভূমি উজাড় হয়। তার সঙ্গে প্রতিদিন বিলুপ্ত হয় ১৩৫ প্রজাতির উদ্ভিদ, প্রাণী ও পোকা-মাকড়। বাস্তুসংস্থান বা ইকোসিস্টেম ধংসের কারণে মানুষের সংস্পর্শে আসছে বন্যপ্রাণী।
অথচ, একটি ভারসাম্যপূর্ণ বাস্তুসংস্থান রোগ-বালাই থেকে আমাদের রক্ষা করতে পারে। কারণ, সমৃদ্ধ বন বা জীববৈচিত্র্য থাকলে রোগ-জীবাণু দ্রুত ছড়াতে পারে না। তাই, আগামী কোন মহামারি থেকে বাঁচতে বন্যপ্রাণী পাচার ও তাদের বাসস্থান ধ্বংস এখনই বন্ধ করতে হবে।
করোনার মতো বহু সংকটের জন্ম দেবে জলবায়ু পরিবর্তন
পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে মেরু অঞ্চলের বরফ গলে তার নিচের মাটি থেকে (Permafrost Layer) হাজার বছরের সুপ্ত ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস উন্মুক্ত হচ্ছে। যা মানুষকে আক্রান্ত করতে পারে, তৈরি করতে পারে নতুন নতুন মহামারি।
২০১৬ সালের আগস্টে সাইবেরিয়ার তুন্দ্রা অঞ্চলের ইয়ামাল পেনিনসুলাতে ১২ বছরের এক শিশু অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় এবং কমপক্ষে ২০ আক্রান্ত ব্যক্তি হাসপাতালে ভর্তি হন। একই সঙ্গে ওই এলকায় দুই হাজারের মতো বল্গাহরিণ (Reindeer) আক্রান্ত হয়।
পেছনের গল্পটা হচ্ছে, প্রায় ৭৫ বছর আগে এখানে অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত হয়ে একটি বল্গাহরিণ মারা গিয়েছিল, যেটি মাটিচাপা দিয়ে রাখা হয়েছিল। ২০১৬ সালের তাপপ্রবাহে বরফ গলে সেই মাটির স্তর বেরিয়ে আসে এবং অ্যানথ্রাক্স জীবাণু উন্মুক্ত হয়। বিজ্ঞান বলছে, অ্যানথ্রাক্সের জীবাণু মাটির নিচে কয়েক যুগ টিকে থাকতে পারে।
২০১১ সালে আলাস্কার তুন্দ্রা অঞ্চলে ১৯১৮ সালে ‘স্প্যানিশ ফ্লু’ ভাইরাসে মারা যাওয়া মানুষের গণকবর থেকে আরএনএ’র অংশ আবিষ্কার করেন বিজ্ঞানীরা। তাদের ধারণা বরফ গলে মাটির পারমাফ্রস্ট স্তর উন্মুক্ত হতে থাকলে স্প্যানিশ ফ্লু, স্মলপক্স বা প্লেগ ফিরে আসতে পারে।
২০০৫ সালে মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার বিজ্ঞানীরা আলস্কার বরফ স্তর থেকে ৩২ হাজার বছর আগের দুই ধরণের ব্যাকটেরিয়া আবিষ্কার করেন। এর দুই বছর পর অ্যান্টার্কটিকার বিকন ও মুলিন উপত্যকার হিমবাহ থেকে ৮ কোটি বছরের পুরনো ব্যাকটেরিয়া আবিষ্কৃত হয়।
২০১৪ সালে সাইবেরিয়ান পারমাফ্রস্ট স্তর থেকে দুটি ভাইরাস আবিষ্কার করেন বিজ্ঞানীরা। তারা বলছেন, এসব ভাইরাস অবমুক্ত হওয়ার পর দ্রতই সংক্রামক হয়ে ওঠে।
তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে ডেঙ্গু বা ম্যালেরিয়ার মতো রোগের প্রাদুর্ভাব বাড়ার সম্পর্কও দেখছেন বিজ্ঞানীরা।
বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা- ডব্লিউএমও’র তথ্য, প্রাক-শিল্প যুগের (১৮৫০-১৯০০) তুলনায় পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়েছে ১ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ২০১৫ থেকে ২০১৯ সাল- এই পাঁচ বছর ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে উষ্ণ বছর।
গত বছর প্রকাশিত জাতিসংঘের ‘ইউনাইটেড ইন সায়েন্স’ রিপোর্ট বলছে, তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে ১৯৭৯ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত সময়ে অ্যান্টার্কটিকার বরফ গলার হার ছয় গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। আর, ২০১৫ সাল থেকে ২০১৯ সাল— এই পাঁচ বছরে হিমবাহ গলার হার ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি। অর্থাৎ, প্রাচীন ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া ফিরে আসার পথ উন্মুক্ত হচ্ছে।
শুধু তাই নয় বরফ গলা মানে সমুদ্রের উচ্চতা বেড়ে যাওয়া। ১৯৯৭ সাল থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে বৈশ্বিক সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির হার ছিল বছরে ৩ দশমিক ০৪ মিলিমিটার, যা ২০০৭-২০১৬ সময়কালে বছরে ৪ মিমি করে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এই বৃদ্ধির হার অব্যাহত থাকলে আগামী ৫০ থেকে ৮০ বছরে বিশ্বের অনেক দ্বীপ ও উপকূলীয় অঞ্চল তলিয়ে যাবে। লবণাক্ততায় আক্রান্ত হতে পারে বিস্তীর্ণ এলাকা ও কৃষি জমি। এটি খাদ্য নিরাপত্তা ও জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি। লবণাক্ততার প্রভাবে কর্মসংস্থান হারিয়ে ভিটেছাড়া হবেন কোটি কোটি মানুষ।
কার্বন নিঃসরণ কমাতে না পারলে চলতি শতাব্দীর শেষে অর্থাৎ আগামী ৮০ বছরে পৃথিবীর তাপমাত্রা প্রাক-শিল্প যুগের তুলনায় ২ দশমিক ৯ ডিগ্রি থেকে ৩ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যাবে। তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়বে ঝড়-জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, খরা, তাপপ্রবাহ, শীতসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের সংখ্যা ও তীব্রতা।
নতুন পৃথিবীর পথ দেখাচ্ছে করোনা সংকট
কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে ঘেঁষে খেলা করবে ডলফিনের দল— এটা নিকট অতীতে হয়তো কেউ ভাবতেও পারেননি। ভারতে গঙ্গার পানি কখনও স্বচ্ছ হতে পারে কিংবা কোনদিন ঢাকা শহরের বাতাস শুদ্ধ হবে তা ছিল কল্পনাতীত। কিন্তু, করোনাভাইরাস থেকে বাঁচতে মানুষ ঘরে অবস্থান কারায় তা দৃশ্যমান হয়েছে। কল-কারখানা বন্ধ থাকায় নদ-নদীগুলোও বিষাক্ত বর্জ্যের হাত থেকে সাময়িক মুক্তি পেয়েছে।
নাইট্রোজেন অক্সাইড (NO₂) মানুষের শ্বাসতন্ত্র ও হৃদযন্ত্রের অসুখ তৈরি করে, যা জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারের ফলে উৎপন্ন হয়। বিবিসি নিউজের রিপোর্ট, যুক্তরাজ্যে লকডাউন ঘোষণার পর দুই সপ্তাহে আগের বছরের তুলনায় বাতাসে নাইট্রোজেন অক্সাইডের পরিমাণ ৬০ শতাংশ কমেছে।
গত মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বাতাসে নাইট্রেজেন অক্সাইডের পরিমাণ আগের বছরের তুলনায় ৩০ শতাংশ কমেছে। আর চীনে জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে গত বছরের তুলনায় কমেছে ৪০ শতাংশ।
বিশ্বে এমন উদাহরণ আরও আছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, স্বাভাবিক সময়ে এটা অর্জন করা সম্ভব কিনা?
পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি ২১০০ সাল নাগাদ প্রাক-শিল্প যুগের তুলনায় ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে আটকে রাখার জন্য সব দেশ মিলে ২০১৫ সালে প্যারিস জলবায়ু চুক্তি করেছে। তবে, চেষ্টা থাকবে ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি বাড়তে না দেওয়া।
২০১৮ সালে আইপিসিসি’র বিশেষ রিপোর্টে বলা হয়েছে, বর্তমান অবস্থা চলতে থাকলে ২০৩০ সালের মধ্যে পৃথিবীর তাপমাত্রা প্রাক-শিল্প যুগের তুলনায় ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পাবে। তাপমাত্রা বৃদ্ধি ২১০০ সাল নাগাদ ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে আটকে রাখতে হলে ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ ২০১০ এর তুলনায় ৪৫ শতাংশ কমাতে হবে এবং ২০৫০ সালের মধ্যে শূন্য বা ভারসাম্য অবস্থায় যেতে হবে। এর জন্য উপযুক্ত প্রযুক্তি মানুষের হাতে আছে। দরকার শুধু রাজনৈতিক সদিচ্ছা।
কিন্তু, উন্নত দেশগুলো কথিত অর্থনৈতিক ক্ষতির আশঙ্কায় কার্বন নিঃসরণ কমাতে চাচ্ছে না। অন্যদিকে বিজ্ঞানীরা বলছেন, পৃথিবী অস্তিত্ব সংকটে পড়লে এই অর্থনীতি তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়বে, যা করোনাকালে প্রতিভাত হচ্ছে।
করোনাভাইরাস প্রতিরোধে ভ্যাকসিন আবিষ্কারের পথে অনেকটাই এগিয়ে গেছেন বিজ্ঞানীরা। হয়তো এ বছরই মানুষ করোনা জয় করবে। এরপর আবার কি আগের মতো পরিবেশটা দূষিত হয়ে পড়বে? আবার কি কথিত আর্থিক লাভের অজুহাতে জলবায়ু পরিবর্তনের বাস্তবতাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া হবে?
গত সপ্তাহে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, ‘এটা ভুলে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই যে বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে বড় সংকট জলবায়ু পরিবর্তন। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে পৃথিবী ও মানব সভ্যতার অস্তিত্বের প্রশ্ন। এখনই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নিলে মহাবিপর্যয় থেকে ফিরে আসার কোনো পথ থাকবে না।
জিএম মোস্তাফিজুল আলম, ডেপুটি ম্যানেজার, নলেজ ম্যানেজমেন্ট, জলবায়ু পরিবর্তন কর্মসূচি, ব্র্যাক
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)
Comments