সংবাদ বিশ্লেষণ

এক মৃত্যুতেই বেরিয়ে এলো রাজশাহীতে করোনা প্রস্তুতির গলদ

রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় করোনা আক্রান্ত এক ব্যক্তির মৃত্যুর পর বেরিয়ে এসেছে নানা অসঙ্গতি। করোনা মোকাবিলায় প্রস্তুতির অংশ হিসেবে অন্তত ২১টি ভেন্টিলেটরসহ দুটি নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) প্রস্তুত রাখা হয়েছে। অথচ আক্রান্ত রোগীর জন্য একটিও ব্যবহার করা হয়নি। করোনা আক্রান্ত—শুনেই চিকিৎসকরা দূরে সরে গেছেন। তাকে স্থানান্তরের কোনো ব্যবস্থা ছিল না।
ছবি: সংগৃহীত

রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় করোনা আক্রান্ত এক ব্যক্তির মৃত্যুর পর বেরিয়ে এসেছে নানা অসঙ্গতি। করোনা মোকাবিলায় প্রস্তুতির অংশ হিসেবে অন্তত ২১টি ভেন্টিলেটরসহ দুটি নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) প্রস্তুত রাখা হয়েছে। অথচ আক্রান্ত রোগীর জন্য একটিও ব্যবহার করা হয়নি। করোনা আক্রান্ত—শুনেই চিকিৎসকরা দূরে সরে গেছেন। তাকে স্থানান্তরের কোনো ব্যবস্থা ছিল না।

মৃত ব্যক্তির স্বজন ও হাসপাতাল সূত্র এ তথ্যগুলো জানিয়েছে।

গত ১৭ এপ্রিল মূত্রথলিতে জ্বালা-পোড়ার সমস্যা নিয়ে রাজশাহীর বাঘা উপজেলা থেকে আসা ৮০ বছর বয়সী এক ব্যক্তিকে হাসপাতালের পঞ্চম মেডিসিন ইউনিটে ভর্তি নেওয়া হয়। পরে দেখা যায়, তার জ্বর ও শ্বাসকষ্টের সমস্যা আছে। বুকের এক্স-রে করে কোভিড-১৯ আক্রান্ত সন্দেহে নমুনা পরীক্ষা করা হয়। ২০ এপ্রিল রাতে রিপোর্টে করোনা পজিটিভ আসে। রোগী করোনায় আক্রান্ত জানার পর রাতেই পঞ্চম মেডিসিন ইউনিট থেকে চিকিৎসক-কর্মচারীরা সবাই চলে যান। পরদিন চিকিৎসাধীন রোগীদের ছেড়ে দিয়ে ওই ইউনিটটি তালা বন্ধ করে দেওয়া হয়। সূত্র জানিয়েছে, সেখানে অন্তত ২০ জন রোগী ছিলেন।

করোনায় আক্রান্ত বৃদ্ধ তীব্র শ্বাসকষ্টে ভুগছিলেন। জরুরি ভিত্তিতে তার আইসিইউ ও ভেন্টিলেটর সাপোর্ট দরকার ছিল। কিন্তু সে সিদ্ধান্ত দেওয়ার মতো দায়িত্বশীল কোনো চিকিৎসক সেখানে ছিলেন না। হাসপাতালের ১৫ শয্যার আইসিইউ করোনা চিকিৎসায় ব্যবহৃত হবে সে সিদ্ধান্ত আগে থেকেই নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ওই বৃদ্ধকে সেখানে না নিয়ে রামেক হাসপাতালের অধীনে সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে আইসোলেশনে রাখার ব্যবস্থা ছাড়া করোনা চিকিৎসায় অন্য কোনো ধরনের সুবিধা ছিল না।

কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীকে স্থানান্তরে হাসপাতালের কর্মচারীদের আলাদা একটি দল তৈরি করা হলেও, ওই বৃদ্ধকে স্থানান্তরের সময় কাউকে পাওয়া যায়নি। শুধু মাস্ক পরে রোগীর স্ত্রী ও ছেলে সব ব্যবস্থা করেছেন।

‘কনটাক্ট ট্রেসিং’ করে দেখা যায় চিকিৎসক, নার্স ও কর্মচারী মিলেয়ে মোট ৪২ জন ওই রোগীর সংস্পর্শে এসেছিলেন। তাদের শহরের বিভিন্ন জায়গায় কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়। হাসপাতালের অন্য চিকিৎসক, নার্স ও কর্মচারীরা বলেন, তারা ওই ৪২ জনের সংস্পর্শে এসেছেন। তাই তাদেরও করোনা পরীক্ষার প্রয়োজন। করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় কী কী ঘাটতি আছে সে বিষয়ে তারা দফায় দফায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সভা করেন।

পরে দেখা যায়, কোয়ারেন্টিনে থাকা ৪২ জনের কেউই আক্রান্ত নন। ২১ ও ২২ এপ্রিল ৪২ জনের নমুনা পরীক্ষার রিপোর্ট হাতে এলে অসন্তোষের বিষয়টি সুরাহা হয়।

কোভিড-১৯ আক্রান্ত বৃদ্ধকে আইসিইউতে না নেওয়ার বিষয়ে হাসপাতালের উপপরিচালক সাইফুল ফেরদৌস বলেন, ‘আইসিইউ ব্যবহারে রোগীর স্বজনরা অনাগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন।’

তবে এটা সত্য নয় বলে দাবি করেছেন রোগীর ছেলে। তিনি বলেন, ‘আব্বাকে আইসিইউতে নিয়ে যাওয়ার কোনো ব্যবস্থা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের ছিল না। আইসোলেশনে থাকাকালে তারা আমাকে বলেছিলেন আব্বাকে আইসিইউতে নিতে। এক সপ্তাহ ধরে আমার আব্বা শ্বাস নিতে পারছিলেন না। আমি আর আমার মা কীভাবে আব্বাকে আইসিইউতে নিতে পারতাম?’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা কোনো ডাক্তারও পাইনি। আব্বাকে বাঁচানো যাবে না সেটা আমরা আগেই টের পেয়েছিলাম। হাসপাতালের সবার ব্যবহার সে রকমই ছিল। একজন ডাক্তার ২৪ ঘণ্টায় একবার মাত্র জানালা দিয়ে আব্বাকে দেখে চলে যেতেন। আব্বাকে বাঁচানোর কোনো চেষ্টাই কেউ করেনি। আমি আর আমার মা এই রোগকে ভয় পাইনি। আমরা রোগীর সঙ্গে একই ঘরে থাকতাম। শুধু তার মৃত্যুর তিন দিন আগে আমাদের আলাদা থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল।’

হাসপাতাল সূত্র জানিয়েছে, বৃদ্ধের কোভিড-১৯ ধরা পড়ার পর তার স্ত্রী-ছেলেরও করোনা পরীক্ষা করা হয়। রিপোর্টে দেখা যায়, তারা আক্রান্ত হননি।

এই বৃদ্ধের মৃত্যুর পর হাসপাতালের আইসিইউ বিভাগে করোনা চিকিৎসার মহড়া হয়। সেখানে এক বা একাধিক করোনা রোগী এলে কে, কোন দায়িত্ব কীভাবে পালন করবে তা দেখানো হয়।

গত ১৯ এপ্রিল অর্থাৎ করোনা আক্রান্ত বৃদ্ধ হাসপাতালে ভর্তির দুদিন পরে আইসিইউ বিভাগটি করোনা চিকিৎসার উপযোগী করে প্রস্তুত করা হয়।

২০ শয্যার আইসিইউ বিভাগের ১৫টি ভেন্টিলেটর আছে। সেখানে আরও পাঁচটি ভেন্টিলেটর ও পাঁচটি নেগেটিভ প্রেসার আইসোলেশন রুমের ব্যবস্থা করা হবে। চিকিৎসকদের অন্তত ছয়টি দল সেখানে নিয়োজিত। একেক দলে আছেন তিন জন চিকিৎসক, ১০ জন নার্স ও চার জন কর্মচারী। তারা সাত দিন কাজ করে ১৪ দিন আইসোলেশনে থাকবেন। এ রকম ব্যবস্থা হাসপাতালের ভেতরেই থাকার পরও ওই বৃদ্ধকে হাসপাতালের বাইরে আইসোলেশন পয়েন্টে নেওয়া হয়েছিল।

গত ৬ এপ্রিল রাজশাহী বিভাগীয় সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছিল করোনা চিকিৎসায় ব্যক্তি মালিকানাধীন সিডিএম হাসপাতালের ছয়টি ভেন্টিলেটরসহ আইসিইউ বিভাগ ব্যবহার করা হবে। ওই বৃদ্ধকে সেখানেও নেওয়া হয়নি।

হাসপাতাল সূত্র জানিয়েছে, মেডিসিন বিভাগে অন্তত তিন জন অধ্যাপক পর্যায়ের চিকিৎসক থাকলেও করোনা চিকিৎসায় সমন্বয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে অপেক্ষাকৃত জুনিয়র এক চিকিৎসককে। যে কারণে তার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে কর্মকর্তাদের মধ্যে অনীহা দেখা যায়। হাসপাতালের চিকিৎসক ও কর্মচারীদের অসন্তোষ দূর করতে কমিটিগুলোতে রদবদল আনার কথাও ভাবা হচ্ছে।

হাসপাতালের কর্মচারীদের সূত্র জানায়, এ পর্যন্ত দুই হাজারের বেশি সুরক্ষা সামগ্রী পাওয়া গেছে এবং যার অর্ধেকের বেশি সংখ্যক চিকিৎসকদের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে। অন্তত তিন জন চিকিৎসক দ্য ডেইলি স্টারকে বলেছেন যে তাদের মাস্ক ও হ্যান্ড গ্লাভস ছাড়া আর কিছু দেওয়া হয়নি এবং সেগুলো নিম্নমানের।

পিপিই পেয়েছেন এমন একজন জানিয়েছেন, পিপিইগুলো অত্যন্ত নিম্নমানের। তিনি বলেন, ‘এক ঘণ্টা ব্যবহারেই সেগুলোতে ছিদ্র হয়ে যাচ্ছে।’

রাজশাহী বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মখলেসুর রহমান বলেন, ‘করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় অনেক জেলায় বেসরকারি ক্লিনিক মালিকদের সহযোগিতা নিচ্ছে সরকার। রাজশাহীতে সে রকম কিছু চোখে পড়েনি। সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়নি। আমরাই বরং নিজে উদ্যোগী হয়ে জানিয়েছি, ৩০টি বেসরকারি হাসপাতাল ও ১২০টি ক্লিনিক করোনা চিকিৎসায় ব্যবহার করা যেতে পারে।’

রাজশাহী বারিন্দ মেডিকেল কলেজের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, তারা অন্তত ৩৪০টি বেড সরবরাহ করতে পারবেন। তবে সরকারের পক্ষ থেকে তাদের কাছে সহযোগিতা চাওয়া হয়নি।

অব্যবস্থাপনার বিষয়ে জানতে চাইলে হাসপাতালের উপপরিচালক সাইফুল ফেরদৌস বলেন, সব প্রশ্নের উত্তর তার কাছে নেই। ফোনে বা এসএমএসে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। রামেক হাসপাতালে করোনায় আক্রান্ত রোগী ভর্তির দ্বিতীয় দিন থেকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নিয়মিত প্রেস ব্রিফিং বন্ধ করে দিয়েছে। তবে বিভাগীয় ও জেলা প্রশাসনের প্রেস ব্রিফিংয়ে নিয়মিত বলা হয়েছে যে করেনা মোকাবিলায় তাদের যথেষ্ট প্রস্তুতি আছে।

করোনা আক্রান্ত বৃদ্ধের মৃত্যুর পরে দাফন নিয়ে দেখা গেছে আরেক অব্যবস্থাপনা।

সিদ্ধান্ত ছিল, করোনায় রাজশাহীতে কারো মৃত্যু হলে তার দাফন কিংবা শেষকৃত্য এখানেই হবে। সে অনুযায়ী শহরের মেহেরচণ্ডী এলাকায় গোরস্তানে কবর খুঁড়তে গেলে এলাকাবাসী বাধা দেয়। সকাল ৭টা ৪০ মিনিটে ওই ব্যক্তির মৃত্যু হলেও দুপুর ৩টা পর্যন্ত টানা সাত ঘণ্টা মরদেহ হাসপাতালের বিছানায় পড়ে থাকে। বিকেল ৪টায় শহরের হেতেম খান গোরস্তানে তার দাফন সম্পন্ন হয়।

Comments

The Daily Star  | English
power outage in rural areas

Power outages on the rise again

Power cuts are getting more frequent as power generation has failed to keep up with the high demand caused by the rising mercury.

10h ago