মহামারি নিয়ে ট্রাম্পের যত কাণ্ড
করোনাভাইরাস মহামারিতে এখন পর্যন্ত বিশ্বে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। দেশটির এই মারাত্মক সংকটের সময়েও প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্ব নিয়ে চলছে নানা আলোচনা।
মহামারিতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ব্যর্থতা নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সিএনএন।
সিএনএন বলছে, করোনাভাইরাসের সংক্রমণে যুক্তরাষ্ট্রে ৬০ হাজারেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে, ভাইরাসটির সঙ্গে লড়ছে ১০ লাখের বেশি। সামনের দিনগুলোতে অর্থনৈতিক মন্দার শিকার হবে আরও কয়েক লাখ মানুষ। তবুও যেন মনে হয় পরিস্থিতির ভয়াবহতা বুঝে উঠতে পারছেন না প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
যুক্তরাষ্ট্রের ভয়াবহ সংকটের সময়ে ট্রাম্পের নেতৃত্ব প্রশ্নবিদ্ধ। গণমাধ্যমে বারবার ভুল তথ্য জানানো, ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ, অন্যদের মতামতকে নাকচ করে দেওয়া ও মহামারির সময়েও ‘দোষারোপের রাজনীতি’ চালিয়ে যাচ্ছেন ট্রাম্প।
মন গড়া ভবিষ্যদ্বাণী
পুরো জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে ট্রাম্প বলেছেন, করোনাভাইরাস নিয়ে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। এই ভাইরাস আমেরিকাকে আঘাত করতে পারবে না। সবকিছু নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আছে। এমনকী, নুতন করোনাভাইরাসকে তিনি ‘সাধারণ ফ্লু’র সঙ্গে তুলনা করেছিলেন।
গত মঙ্গলবার এ প্রসঙ্গে তিনি সিএনএনকে বলেন, ‘অনেক দক্ষ বিশেষজ্ঞও বলেছেন করোনাভাইরাস যুক্তরাষ্ট্রে সংক্রমিত হবে না। বিশেষজ্ঞদের ভুল হয়েছে। অনেক মানুষই ভুল করেছে। অনেকেই বুঝতে পারেনি যে, এটা এতো মারাত্মক হবে।’
এই ধরনের মন্তব্য ট্রাম্পের ‘দায় এড়ানোর’ নীতি ও বিচক্ষণতার অভাবেরই উদাহরণ। খবরের কাগজে শুরু থেকেই নিয়মিত করোনার ঝুঁকি নিয়ে লেখালিখি করা হলেও ট্রাম্পের নজর সেগুলো এড়িয়ে গেছে।
বিশেষ করে, গত ২৭ ফেব্রুয়ারি মার্কিন সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের (সিডিসি) কর্মকর্তা ন্যান্সি মেসোন্যার সর্তক করেছিলেন যে, যুক্তরাষ্ট্রে ভাইরাসটির সংক্রমণ এড়ানো সম্ভব না। প্রাদুর্ভাবের পর যুক্তরাষ্ট্রের পরিস্থিতি ‘খারাপ’ হতে পারে।
ট্রাম্পের বিরুদ্ধে সত্যকে অস্বীকার করা, বিভ্রান্তিকর কথা বলে দায়িত্ব এড়ানোর অভিযোগ নতুন নয়। এই ধরনের কৌশলের জন্যই রাশিয়া স্ক্যান্ডাল ও অভিশংসনের বির্তক থেকেও তিনি পার পেয়ে গেছেন।
মহামারি মোকাবিলায় প্রাথমিকভাবে ট্রাম্পের ব্যর্থতা ছিল বিষয়টিকে গুরুত্ব না দেওয়া।
গতকাল বুধবার, যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম তিনমাসের অর্থনীতি গত বছরের তুলনায় ৪ দশমিক ৮ শতাংশ কমে গেছে। এটাকে আসন্ন অর্থনৈতিক মন্দার সূচনা বলা যায়।
অথচ একই দিনে, ফক্স নিউজকে এক সাক্ষাৎকারে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের জামাতা জ্যারেড কুশনার ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, জুলাইয়ের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রে আবার প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে আসবে।
তিনি বলেন, ‘এখানে মূল লক্ষ্য হচ্ছে মানুষকে কাজে ফিরিয়ে আনা। কয়েকটি গ্রুপ আছে যারা টেলিভিশনে এসে বলেন যে তারা ‘চিরদিনের জন্য লকডাউন চান’। কিন্তু, বাস্তবতা হচ্ছে, আমাদের পক্ষে তথ্য আছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দেশকে সচল করার জন্য একটি নিরাপদ পথ তৈরি করেছেন।’
দায়সারা ভাব
গত সপ্তাহে আক্রান্তদের জীবাণুনাশক রাসায়নিক তরল দিয়ে চিকিৎসার প্রস্তাব দিয়েছিলেন ট্রাম্প। এটি ট্রাম্পের উদ্ভট বক্তব্যের আরেকটি উদাহরণ। এই ধরনের মন্তব্য এমন একজন নেতাকে জনগণের সামনে তুলে ধরে যিনি কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই গণমাধ্যমে কথা বলেন। যিনি জটিল বিষয় নিয়েও সামান্য পড়াশোনা করেননি।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার কোনো পরিকল্পনা না করে বরং তিনি স্কুলগুলো খুলে দেওয়া যায় কিনা সে ব্যাপারে সবাইকে ভাবার জন্য আহ্বান জানান। কয়েক লাখ শিশুর স্বাস্থ্য ঝুঁকি, তাদের পরিবারের সুরক্ষার মতো বিষয়গুলো একজন সরকার প্রধানের বিবেচনায় নেওয়া জরুরি।
পরিস্থিতির ভয়াবহতা সম্পর্কে মার্কিন প্রশাসনের দায়সারা ভাব স্পষ্ট হয়ে যায় যখন মঙ্গলবার ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স মিনেসোটা মায়ো ক্লিনিক পরিদর্শন করেন।
তিনি সিডিসির দিক নির্দেশনা অমান্য করে ফেসমাস্ক না পরেই সেখানে গিয়েছেন। প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান, তাকে নিয়মিত করোনা পরীক্ষা করা হচ্ছে তাই ভাইরাসটির উপসর্গহীন বাহক হওয়ার সম্ভাবনা নেই। হাসপাতাল পরিদর্শনে গিয়ে মাস্ক না পরা দেশের মানুষের জন্য উপযুক্ত দৃষ্টান্ত তৈরি করে না বলে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথার অমিল
বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই যাত্রা করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকানো গেলেও ভ্যাকসিন তৈরি না হলে শীতকালে ভাইরাসটি আবারও ফিরে আসতে পারে।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের করোনাভাইরাস টাস্কফোর্সের সদস্য অ্যান্টনি ফউসি বলেন, ‘এখনই আমাদের উপযুক্ত প্রতিরোধব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। যদি এটা না করা যায়, তাহলে শীত অথবা বর্ষায় ভাইরাসটি ফিরে আসলে আবারও মারাত্মক পরিস্থিতিতে পড়তে হবে।’
এমন সর্তকতার পরেও গণমাধ্যমে ট্রাম্প বলেছেন, ‘আমার ধারণা, যা হবার তা হয়ে গেছে। এটা আবারও ফিরে আসবে বলে আমি মনে করি না। আর যদি আসে, তখনও আমরা ভাইরাস মোকাবিলায় সফল হবো।’
যুক্তরাষ্ট্রে সর্বোচ্চ আক্রান্তের সংখ্যার বিষয়ে টুইটে তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রে করোনার সংক্রমণ সবচেয়ে বেশি কারণ বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের করোনা পরীক্ষা ব্যবস্থা সবচেয়ে ভালো। অন্য দেশে পরীক্ষা হচ্ছে না বলে তাদের আক্রান্তের সংখ্যা কম।’
তবে, যুক্তরাষ্ট্রের অর্গানাইজেশন অব ইকোনোমিক কোঅপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট জানিয়েছে, দেশটিতে প্রতি ১ হাজার মানুষের মধ্যে গড়ে ১৬ দশমিক ৪ শতাংশ পরীক্ষা করা হচ্ছে। অন্যদিকে, ইতালি ও স্পেনে প্রতি হাজার জনসংখ্যায় পরীক্ষা হয়েছে ২৩ দশমিক ১ শতাংশ। পরীক্ষার দিক থেকে তৃতীয় অবস্থানে আছে যুক্তরাষ্ট্র। এরপরই ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যের অবস্থান।
Comments