সংবাদের প্রতিবাদ ও প্রতিবেদকের বক্তব্য
‘এক মৃত্যুতেই বেরিয়ে এলো রাজশাহীতে করোনা প্রস্তুতির গলদ’ শিরোনামে গত ২৭ এপ্রিল দ্য ডেইলি স্টার অনলাইনে প্রকাশিত সংবাদের প্রতিবাদ জানিয়েছে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
গত ২৯ এপ্রিল হাসপাতালের পরিচালকের পক্ষে উপপরিচালক ডা. সাইফুল ফেরদৌস মো. খায়রুল আতাতুর্ক স্বাক্ষরিত প্রতিবাদটি আমাদের হাতে আসে।
পাঠকদের জন্য সেটি হুবহু তুলে ধরা হলো।
উক্ত সংবাদে দাবি করা হয়, রাজশাহীতে সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণকারী ৮০ বছর বয়সী রোগীর আইসিইউ ও ভেন্টিলেটর সাপোর্ট দরকার থাকার সত্ত্বেও তাকে আইসিইউতে না নেওয়ায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু, আপনার পত্রিকায় প্রকাশিত ওই সংবাদটি অসত্য।
মেডিসিন ওয়ার্ড থেকে করোনা সন্দেহে রোগীটিকে সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে স্থানান্তরের পর তার করোনা টেস্ট পজিটিভ আসে। সেই সময় কর্তব্যরত ডাক্তার রোগীর ছেলেকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে স্থানান্তর করতে চান কি না জিজ্ঞাসা করলে তিনি জবাব দেন যে, তার বাবার অনেক বয়স হয়েছে বিধায় তারা তাকে আর টানা-হেঁচড়া করতে চান না এবং সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালেই যেন তার চিকিৎসার যথাসম্ভব ব্যবস্থা করা হয়।
রোগীর বুকের এক্স-রেতে দুই দিকে কনসোলিডেশন ছিল এবং বামপাশে নিউমোথোরাক্স (ফুসফুস ছিদ্র হয়ে বাতাস লিক) ছিল। এই ধরনের রোগীকে শুরুতেই ভেন্টিলেটরে দিলে আরও বেশি বাতাস লিক হয়ে টেনশন নিউমোথোরাক্স হয়ে রোগী দ্রুত (সাধারণত এক ঘণ্টার মধ্যে) মৃত্যুবরণ করতো। সুতরাং, ভেন্টিলেটরে দেওয়ার আগে বুকে অপারেশন করে চেস্ট টিউব ওয়াটার সিল ড্রেইনেজ দিতে হতো।
কিন্তু বয়স বিবেচনায় রোগীর ছেলে কোনো ধরনের ইনভেসিভ প্রসিডিওর করতে আপত্তি জানান। রোগীর মৃত্যুর একদিন আগে রোগীর ছেলে রোগীকে আইসিইউতে নিয়ে যেতে অনুরোধ করেন। কিন্তু ততক্ষণে রোগীর অবস্থার এত অবনতি হয় যে, রোগীর বুকে অপারেশন (চেস্ট টিউব ওয়াটার সিল ড্রেইনেজ) করার মতো ফিটনেস ছিল না। সুতরাং, তাকে ভেন্টিলেটরে দেওয়া সম্ভব ছিল না। এই বিষয়টি রোগীর ছেলেকে ব্যাখ্যা করা হলে তিনি তা মেনে নেন।
গত ২৯ এপ্রিল সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. মামুন কবীর রোগীর দুই ছেলের সাথে মোবাইলে কথা বলেছেন। দুই ছেলেই জানিয়েছে, তারা তার বাবার চিকিৎসা নিয়ে সন্তুষ্ট এবং চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে তাদের কোনো অভিযোগ নেই। কিন্তু, প্রশাসনের নির্দেশের কারণে তারা বাবার মরদেহ দাফনের জন্য বাঘায় নিজ বাড়িতে নিয়ে যেতে না পারায় তারা তীব্র মনোকষ্টে ভোগেন।
রোগীর চিকিৎসার সাথে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকদের সাথে কথা না বলে আপনার পত্রিকায় অসত্য সংবাদ ছাপা হওয়ায় রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সন্মানহানি হয়েছে। আমরা এই অসত্য সংবাদের তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি এবং আপনার পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ প্রত্যাহার ও ভবিষ্যতে সংবাদের সত্যতা যাচাই পূর্বক সংবাদ পরিবেশনে আরও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের জন্য অনুরোধ করা হলো।
প্রতিবেদকের বক্তব্য
দ্য ডেইলি স্টারের সংবাদের বিষয়বস্তু ছিল কেভিড-১৯ রোগে একজনের মৃত্যু ও রাজশাহীতে করোনা প্রস্তুতির নানা অসঙ্গতি যেগুলো সংবাদের শিরোনাম ও মূল অংশে সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। সংবাদের ভিত্তি ছিল মৃত ব্যক্তির স্বজনের বক্তব্য ও হাসপাতাল সূত্রে পাওয়া তথ্য, যেগুলো আমাদের কাছে সংরক্ষিত আছে।
রামেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলেছে, ‘আইসিইউতে না নেওয়ায় রোগী মৃত্যুবরণ করেন বলে প্রকাশিত সংবাদে দাবি করা হয়েছে’।
অথচ প্রকাশিত সংবাদের কোথাও এমন দাবি করা হয়নি।
করোনা রোগীর আইসিইউ ও ভেন্টিলেটর সাপোর্ট দরকার থাকা সত্ত্বেও কেন তাকে আইসিইউতে নেওয়া হয়নি, সে সম্পর্কে প্রতিবাদে চিকিৎসা সংক্রান্ত নতুন ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। এই ব্যাখ্যা প্রকাশিত সংবাদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়, কারণ সংবাদের বিষয়বস্তু ছিল করোনা মোকাবিলায় প্রস্তুতিতে ঘাটতি।
ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, করোনা সন্দেহে রোগীকে রামেক হাসপাতাল থেকে সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে নেওয়া হয়। স্থানান্তরের পরে নমুনা পরীক্ষার ফলাফলে কোভিড-১৯ পজিটিভ আসে। এখানে প্রমাণিত হয়েছে যে, উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা থাকা স্বত্ত্বেও শুধুমাত্র সন্দেহের বশবর্তী হয়ে রোগীকে অপেক্ষাকৃত কম সুবিধাসম্পন্ন হাসপাতালে পাঠিয়ে চিকিৎসাবঞ্চিত করা হয়েছে। তাদের বক্তব্যেই পরিষ্কার হয়ে যায়, তারা নিজেদের ঝুঁকি এড়ানোর চেষ্টা করেছেন। কর্তৃপক্ষে আরও দাবি করেছে, তাদের পর্যাপ্ত সুরক্ষা ব্যবস্থা ছিল।
চিকিৎসা সংক্রান্ত ব্যাখ্যায় ‘রোগীর ভেন্টিলেটরে নেওয়ার শারীরিক সক্ষমতা ছিল না বলা হয়েছে এবং তারপরও তার স্বজনদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল রোগীকে তারা আইসিইউতে স্থানান্তর করতে চান কি না। কিন্তু তারা রাজি হননি।’ এ বক্তব্য দুটি সাংর্ঘষিক। তার মানে দাঁড়ায়, সংক্রামক হাসপাতালের চিকিৎসক রোগীর স্বজনকে প্রশ্ন করার সময়ও জানতেন না যে রোগী ভেন্টিলেশনে দেওয়ার যোগ্য না। আবার মৃত্যুর এক দিন আগে স্বজন যখন রোগীকে আইসিইউতে নিতে চেয়েছেন, ততক্ষণে রোগির শারীরিক অবস্থার মারাত্মক অবনতি হয়েছিল— বলা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে স্পষ্ট হয়, রোগী সর্বোচ্চ সেবাবঞ্চিত হয়েছিলেন।
ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, রোগীর ছেলে জবাবে বলেছিলেন যে, ‘...তারা তাকে আর টানা-হেঁচড়া করতে চান না’। রোগীর ছেলে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেছিলেন, করোনা রোগীকে স্থানান্তরের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় তাদের নিজেদেরই সুরক্ষা ব্যবস্থা ছাড়া রামেক হাসপাতাল থেকে সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়েছিল। এখানে স্পষ্ট, রোগী স্থানান্তরের সময় তার স্বজনরা কর্তৃপক্ষের মানবিক ও দায়িত্বশীল আচরণ থেকেও বঞ্চিত হয়েছিলেন।
প্রকাশিত সংবাদে প্রতিবাদ প্রেরকের বক্তব্য আছে। সেখানে বর্ণনা করা হয়েছে, কর্তৃপক্ষ তথ্য জানাতে কতটা অসহযোগী ছিল। কিন্তু প্রতিবাদে ‘রোগীর চিকিৎসায় সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলা হয়নি’— উল্লেখ করে প্রতিষ্ঠানটির মুখপাত্রের গুরুত্ব এড়ানোর চেষ্টা করা হয়েছে।
প্রতিবাদে মৃত ব্যক্তির ছেলের ‘তীব্র মনোকষ্ট’র কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সেই মনোকষ্টের পুরো দায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ প্রশাসনের ঘাড়ে চাপিয়ে সেবা দিতে নিজেদের ব্যর্থতার দায় এড়াতে চেয়েছে।
প্রতিবাদে সংবাদের কোন অংশ অসত্য তা নির্দিষ্ট করে বলা হয়নি। সংবাদে উঠে আসা অসঙ্গতিগুলো সম্পর্কেও কিছু উল্লেখ করা হয়নি। এতে প্রকারান্তরে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ পুরো সংবাদই স্বীকার করে নিয়েছে।
দ্য ডেইলি স্টারের অবস্থান প্রকাশিত সংবাদের পক্ষে।
আরও পড়ুন:
এক মৃত্যুতেই বেরিয়ে এলো রাজশাহীতে করোনা প্রস্তুতির গলদ
Comments