কোভিড-১৯ নিপীড়নের হাতিয়ার হতে পারে না
কোভিড-১৯ ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে দমনপীড়ন ও ভুয়া তথ্য বেড়ে চলেছে সমানতালে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার এই উদ্বেগের মধ্যে আছে যে, মহামারির সময়ে রোগ ও এর প্রতিকার সম্পর্কে ক্ষতিকর ভুল তথ্য ছড়িয়ে এটি প্রতিরোধের উদ্যোগকে ব্যহত করার সুযোগ নিতে পারে কেউ কেউ। তাদের এই উদ্বেগের যথার্থতাও রয়েছে।
কিন্তু, কিছু সরকার নিজেরাই বরং এই মুহূর্তটিকে সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করছে। পরিস্থিতি সম্পর্কিত যেসব তথ্য সরকারের জন্য অসুবিধাজনক সেগুলো দমন করা কিংবা সমালোচকদের ওপর নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের উপলক্ষ হিসেবে বর্তমান সময়টিকে কাজে লাগাচ্ছে এসব সরকার।
প্রায় দুই মাস নিখোঁজ থাকার পর সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজল বেনাপোল বন্দর থানা পুলিশের হেফাজতে আছেন বলে আজ রবিবার গণমাধ্যমকে জানিয়েছে পুলিশ। এটি নিঃসন্দেহে স্বস্তির বিষয় যে কাজল জীবিত আছেন এবং পুলিশের হেফাজতে আছেন।
বাংলাদেশে যখন কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে প্রতিদিনই মানুষ মারা যাচ্ছেন এমন পরিস্থিতিতে কাজলের ১১ বছর বয়সী মেয়ে ও ২০ বছর বয়সী ছেলে তাদের বাবার শুধু নিরাপত্তার কথা ভেবে উদ্বিগ্ন নয়, তার শারীরিক সুস্থতা নিয়েও তারা বিচলিত।
ফটোসাংবাদিক এবং একটি দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক কাজলকে নিবর্তনমূলক ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে অভিযুক্ত করার শঙ্কাও রয়েছে। তার নিখোঁজ হওয়ার আগের দিন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের একজন আইনপ্রণেতা ‘ভুল, আক্রমণাত্মক ও মানহানিকর’ বক্তব্য ফেসবুকে পোস্ট করার অভিযোগে কাজলের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। কাজলকে সর্বশেষ প্রকাশ্যে যখন দেখা গিয়েছে এর তিন ঘণ্টা পর ক্ষমতাসীন দলের আরেক সদস্য তার বিরুদ্ধে একই আইনে আরেকটি মামলা দায়ের করেন।
কোভিড-১৯ মহামারি যখন থেকে সংবাদের মূল বিষয়বস্তু হয়ে উঠলো, তখন থেকে সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের সমালোচনাকারীরা কর্তৃপক্ষের রোষানলের শিকার হতে শুরু করেছেন। সরকার কেন স্বল্পমূল্যের টেস্টিং কিট সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হলো— এ বিষয়ে গত ২৬ এপ্রিল সমালোচনামূলক এক মতামত নিবন্ধ একটি ওয়েবসাইটে প্রকাশের পর তা হঠাৎ করে সরিয়ে ফেলা হয়েছে।
সাংবাদিক ও গবেষক তাসনিম খলিল সম্পাদিত সুইডেনভিত্তিক অনুসন্ধানমূলক সংবাদমাধ্যম নেত্র নিউজ জাতিসংঘের ফাঁস হওয়া একটি অভ্যন্তরীণ নথির বরাতে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে তুলে ধরা হয় যে, মহামারির কারণে কোনোরূপ হস্তক্ষেপ ছাড়া বাংলাদেশে ২০ লাখ পর্যন্ত মানুষের মৃত্যু হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। সরকারি উচ্চপদস্ত ব্যক্তিদের দুর্নীতিতে জড়িত থাকার অভিযোগ সংক্রান্ত সংবাদ প্রকাশের পর থেকে নেত্র নিউজ’র নিজস্ব ওয়েবসাইট বাংলাদেশের পাঠকদের জন্য প্রবেশঅযোগ্য করে রাখা হয়েছে বলে খলিল অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালকে জানান।
বর্তমানে সংবাদমাধ্যমটির মিরর ওয়েবসাইটও বাংলাদেশে ব্লক করা হয়েছে। একইসঙ্গে নেত্র নিউজ’র প্রতিবেদন পুনঃপ্রকাশকারী রেডিও ফ্রি এশিয়া’র সহযোগী সংবাদমাধ্যম বেনারনিউজ’কেও বাংলাদেশে ব্লক করা হয়েছে।
খলিল বর্তমানে বাংলাদেশের বাইরে বসবাস করছেন। তিনি জানান, গত ৯ এপ্রিল একটি গোয়েন্দা সংস্থার কয়েকজন সদস্য বাংলাদেশে তার মায়ের বাসায় যান এবং তার ছেলে ‘দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করছেন’ বলে সর্তক করেন।
সম্প্রতি, কমপক্ষে ২০ জন সাংবাদিক ক্ষমতাসীন দলের সদস্যদের দ্বারা হামলা বা হয়রানির শিকার হয়েছেন, বলছে গণমাধ্যমঅধিকার কর্মীদের সংগঠন মুক্ত প্রকাশ। সংগঠনটি আরও জানিয়েছে, লকডাউনের ভুক্তভোগী গরিব মানুষদের জন্য বরাদ্দ ত্রাণ বিতরণে চুরি, দুর্নীতি ও অস্বচ্ছতার সংবাদ প্রকাশের কারণে কিছু ক্ষেত্রে সাংবাদিকদেরকে পুলিশ আটক করেছে এবং ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে।
ত্রাণ তহবিল নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ সংক্রান্ত সংবাদ প্রকাশের পর সেটিকে ‘আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতিকারক’ এবং ‘ভুল, আক্রমাণাত্মক ও মানহানিকর বিষয়বস্তু’ হিসেবে উল্লেখ করে গত ১৭ এপ্রিল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সম্পাদক তৌফিক ইমরোজ খালিদীসহ চার জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে পুলিশ মামলা নথিভুক্ত করেছে।
গত ১২ এপ্রিল তথ্য মন্ত্রণালয়ের ‘অনুরোধ’ সম্বলিত নোটিশ জারি করে টেলিভিশন চ্যানেল মালিক সমিতি; যাতে ‘কোভিড-১৯ সম্পর্কিত সব ধরনের নেতিবাচক আলোচনা ও সমালোচনা’ এড়িয়ে চলতে বলা হয়।
গত ২৩ এপ্রিল জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলে উপস্থাপিত প্রতিবেদনে সংস্থাটির অধিকার সংরক্ষণ ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাবিষয়ক বিশেষ র্যাপোর্টিয়ার ডেভিড ক্যাই বলেছেন, অনেক দেশের সরকার মৌলিক আইনি বাধ্যবাধকতা না মেনেই তথ্য প্রবেশাধিকার বাধাগ্রস্ত করছে। ক্যাই সতর্ক করে আরও বলেছেন, মহামারির কারণে পৃথিবীব্যাপী এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে যেখানে সাংবাদিক এবং মানবাধিকার সংরক্ষকরা তাদের কাজের কারণে হয়রানি, আটক, জিজ্ঞাসাবাদ ও বঞ্ছনার শিকার হচ্ছেন।
বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীরাও মহামারি নিয়ে মন্তব্য করার কারণে আটক হচ্ছেন, নিপীড়নের নিশানায় পরিণত হচ্ছেন। এখন পর্যন্ত অন্তত ৫০ জন ব্যক্তির বিরুদ্ধে ‘ভুয়া সংবাদ’ এবং ‘গুজব’ ছড়ানোর দায়ে মূলত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ফৌজদারি অপরাধের আওতায় মামলা করা হয়েছে।
বিভিন্ন ঘটনা থেকে বোঝা যাচ্ছে দায়িত্বশীল ও ক্ষমতাশালীদের দ্বারা দমনপীড়নের স্তরগুলো কতটা উদ্বেগজনক। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অস্পষ্ট ও অতিবিস্তৃত কিছু ধারার মাধ্যমে বৈধ মতপ্রকাশকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
খালিদী ও অন্য সাংবাদিকরা ত্রাণ অব্যবস্থাপনা নিয়ে কেবল একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে কীভাবে ‘দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটিয়েছেন’ সে সম্পর্কে আইনটিতে কোনো স্পষ্ট ব্যাখ্যা নেই। এই সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের ভিত্তিতে যদি তারা দণ্ডিত হন, তাহলে ৭ বছর পর্যন্ত কারাগারে থাকতে হতে পারে।
কোভিড-১৯ এর সময়ে ও আগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে বেশকিছু মামলা হয়েছে যেগুলোতে রাজনীতিক ও সরকারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগকে প্রতিহত করতে ‘মানহানির অভিযোগ’কে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। ফলে ক্ষমতাশালী ব্যক্তিদের সম্পর্কে শুধুমাত্র নিজেদের মতপ্রকাশের কারণে অনেককে ৫ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডের মুখোমুখি দাঁড়াতে হচ্ছে। মানবাধিকারনীতি খুবই স্পষ্ট যে, যখন একজন ব্যক্তি তার মর্যাদা বা সুনাম ক্ষুন্ন হয়েছে বলে দাবি করবেন, তখন এটি নাগরিক বিষয় হিসেবে গণ্য হবে, ফৌজদারি নয়।
কোভিড-১৯ মহামারি চলাকালে শুধুমাত্র মতপ্রকাশের অধিকার চর্চার কারণে সাংবাদিক ও সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান মামলার সংখ্যা কোনোভাবেই মানবাধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের দৃষ্টান্ত নয়। মতপ্রকাশের অধিকারে কোনো ধরনের সীমাবদ্ধতা আনতে হলে তা অবশ্যই আইন অনুসারে হতে হবে এবং তা কতটুকু প্রয়োজন ও সঙ্গতিপূর্ণ তার ব্যাখ্যা থাকতে হবে। এ বিষয়গুলো বাংলাদেশের স্বাক্ষরিত ‘আন্তর্জাতিক নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সনদ’ এ স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা রয়েছে।
জনস্বাস্থ্য ও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ভুয়া, অনির্ভরযোগ্য তথ্য, গুজব বা গালগল্পকে রুখতে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া সরকারি কর্তৃপক্ষের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
কিন্তু, নির্বিচারে শাস্তি দেওয়ার প্রবণতা প্রকৃতপক্ষে কোনো উদ্দেশ্যই হাসিল করবে না। বরং কর্তৃপক্ষের উচিত দ্রুত সঠিক, নির্ভরযোগ্য ও প্রমাণভিত্তিক তথ্য সবার নাগালে আনতে কাজ করা।
জনস্বাস্থ্যের সুরক্ষা নিশ্চিত করা ও মহামারি মোকাবেলায় গৃহীত প্রয়োজনীয় উদ্যোগের বিষয়ে জনগণকে সজাগ ও গুজবমুক্ত রাখতে এটাই বেশি কার্যকর পন্থা।
সাদ হাম্মাদি: অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সাউথ এশিয়ার রিজিওনাল ক্যাম্পেইনার। টুইটার: @saadhammadi
Comments