‘করোনা আক্রান্তদের জন্য মেন্টাল সাপোর্ট সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ’
নতুন করোনাভাইরাস কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হওয়া সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজের শিক্ষানবিশ ডাক্তার মেহেদী হাসানের মতে, আক্রান্তদের জন্য ‘মেন্টাল সাপোর্ট’ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
‘সবাই মনে করছে যে আক্রান্ত হলেই বোধহয় মারা যাবো। তা ছাড়া, সামাজিক লাঞ্ছনার একটা বিষয়ও সঙ্গে আছে। আর এ সময় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে— “মেন্টাল সাপোর্ট”। আরেকটা বিষয় হচ্ছে— টেনশন বা দুশ্চিন্তা মুক্ত থাকতে হবে’, বলেন তিনি।
সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজের ৫৩তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ও গাজীপুর জেলার বাসিন্দা মেহেদী হাসান। গত ২২ এপ্রিল কোভিড-১৯ আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হন এই শিক্ষানবিশ চিকিৎসক।
এরপর থেকে সিলেট শহীদ শামসুদ্দিন আহমদ হাসপাতালের করোনা আইসোলেশন সেন্টারে চিকিৎসাধীন থাকার ১৪ দিনের মাথায় গত ৬ মে সুস্থ হয়ে ফেরেন কলেজের হোস্টেলে।
গতকাল বৃহস্পতিবার দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে আলাপচারিতায় কোভিড-১৯ আক্রান্ত সময়ের কথা বলেন এ শিক্ষানবিশ চিকিৎসক।
শিক্ষানবিশ চিকিৎসক হিসেবে কাজে যোগ দিতে ১৮ এপ্রিল গাজীপুর থেকে সিলেট আসেন তিনি। তখন যারা কোভিড-১৯’র বেশি সংক্রমিত এলাকা যেমন: গাজীপুর, বাসাবো, মিরপুর থেকে এসেছিলেন, কাজে যোগ দেওয়ার আগে সতর্কতামূলক পরীক্ষা হিসেবে সবার নমুনা সংগ্রহ করা হয়। ২০ এপ্রিল নমুনা নেওয়ার পর ২২ এপ্রিলে জানানো হয়, তার কোভিড-১৯ পজিটিভ।
মেহেদী হাসান বলেন, ‘তখন পর্যন্ত আমার মধ্যে কোনো উপসর্গ ছিল না। আক্রান্ত হয়েছি শুনে একটু খারাপ লাগছিল। চিন্তা হচ্ছিলো, বাড়িতে আব্বু-আম্মুরও হয়েছে কি না। যদিও তাদের টেস্ট করার পর নেগেটিভ এসেছে। তার মানে আমি বাসা থেকে নিয়ে আসিনি। রাস্তায় বা এখানে (সিলেটে) আসার পর সংক্রমিত হয়েছি।’
তিনি বলেন, ‘আক্রান্ত হওয়ার পর প্রথমে ভেবেছিলাম হোস্টেলে থাকা যায় কি না। পরে ভাবলাম হোস্টেলে তো কমন বাথরুম, আমার জন্য তো সবার সমস্যা হবে। তখন সবার নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে ২৩ এপ্রিল বিকালে হাসপাতালে চলে যাই। সেখানে শেষ পর্যন্ত কেবিনে চিকিৎসাধীন ছিলাম।’
‘২৫ বা ২৬ তারিখের দিকে প্রথম সামান্য বুকে ব্যথা হয়। একটু জ্বরও এসেছিল একদিনের জন্য। আগে থেকে ওষুধ চলছিল বলে জ্বর আর বাড়েনি। শ্বাসকষ্টের কথা ভেবে অক্সিজেন সিলিন্ডার পাশে রাখা ছিল, তবে শ্বাসকষ্ট হয়নি। অক্সিজেন স্যাচুরেশন ৯৮-৯৯ শতাংশ ছিল, তাই সিলিন্ডারও ব্যবহার করতে হয়নি শেষ পর্যন্ত’, বলেন মেহেদী।
হাসপাতালের চিকিৎসাব্যবস্থা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘কোভিড-১৯ আক্রান্তদের চিকিৎসায় যে ক্লিনিক্যাল ম্যানেজমেন্টের নির্দেশনা আছে, তা অনুযায়ী আমাকে চিকিৎসা দিয়েছেন ডাক্তাররা। সময় করে ওষুধ খেতে হয়েছে। ডাক্তাররা সবাই খুব যত্ন করেছেন। প্রতিদিন বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা রুটিন অনুযায়ী দেখে গেছেন।’
মেহেদী আরও বলেন, ‘ওষুধ ছাড়াও সারাদিন ৪-৫ বার গরম লেবু পানি খেতাম। মাঝে মাঝে আদা-রসুন দিয়ে গরম চা খেয়েছি। আদা-লেবু দেওয়া চায়ের গরম পানিতে বা এমনি গরম লেবু পানিতে ভাপ নিতাম দিতে ৭-৮ বার। এসব খুবই উপকারী। এ ছাড়াও, নিয়মিত কালোজিরা-মধু খেয়েছি। এটা প্রতিষেধক না, তবে প্রতিরোধক। মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।’
তবে ওষুধ বা প্রতিরোধক ব্যবস্থার চেয়ে মেহেদী গুরুত্ব দিচ্ছেন মানসিক অবস্থার ওপর।
তিনি বলেন, ‘আমাদের ডাক্তারদের তেমন সামাজিকভাবে হয়রানির শিকার হতে হয় না। তবে, সাধারণ কেউ আক্রান্ত হলে তারা সামাজিকভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। এমনকি আমাদের হোস্টেলে যারা ডাইনিং চালান, কাপড় আয়রন করেন— তারা হোস্টেলেই থাকেন। তাদের এলাকার লোকজন নাকি শুনেছে তারা আমার সঙ্গে মেলামেশা করেছে, আর এতে তাদেরকে সামাজিকভাবে হেয় করেছে।’
মেহেদী বলেন, ‘আসলে যারা একটু কম জানে বা যারা না জেনেই ভয় পায়, তাদের জন্য এটা খুবই আতঙ্কের বিষয়। আমারও ভয় ছিল যে আব্বু-আম্মু হয়রানি হন কি না। কিন্তু আমাদের এলাকায় এটা হয় নাই।’
‘সামাজিক হয়রানির কারণে অনেকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়। এর সঙ্গে বিভিন্ন হরমোন জড়িত। আর এর ফলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও কমে যায়। তাই কোনোভাবেই চিন্তিত হওয়া যাবে না। আমার বন্ধুরা, শিক্ষকরা সবসময় আমার খোঁজ নিয়েছেন, মেন্টাল সাপোর্ট দিয়েছেন’।
চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় সুস্থ হয়েছেন কি না, তা বুঝতে ২৭ এপ্রিল মেহেদীর নমুনা পরীক্ষা করা হয়। যেটির রিপোর্ট নেগেটিভ আসে ৩০ তারিখ। এরপর আবারও ১ মে নমুনা নিয়ে পরীক্ষার পর ৪ তারিখ রাতে রিপোর্ট নেগেটিভ আসলে নিশ্চিত হওয়া যায় যে তিনি সুস্থ হয়েছেন। বাবা-মা ও ৩ ভাই-বোনের পরিবারে বড় হওয়া মেহেদী সুস্থ হওয়ার খবর প্রথমেই জানান তার আব্বু-আম্মুকে।
তিনি বলেন, ‘রাত ৮টার দিকে রিপোর্ট পাওয়ার পরই আব্বু-আম্মুকে জানাই যে আমি সুস্থ হয়ে গেছি। তবে, আমি সুস্থ হওয়ার পরও আমার খুব বেশি আনন্দ লাগেনি। কারণ, আমার ১৬ জন ব্যাচমেট ইতোমধ্যে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন।’
আক্রান্তদের ১০ দিনের বেশি হয়ে যাওয়ার পরও উপসর্গ দেখা না দেওয়ায় মেহেদী আশাবাদী যে, সবাই দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবেন।
মেহেদী বলেন, ‘আমি সবাইকে আমার কথা বলছি। যাতে আমার সুস্থ হওয়ার কথা শুনে সবাই সাহস পান। এখন সবাইকে সাহস দিতে হবে। আমি আপাতত হোস্টেলের একটি ব্লকে আইসোলেশনে আছি। ২৫ দিন পর আমি আমার কাজে যোগ দেবো।’
Comments