যে কারণে কিছু মানুষ মাস্ক পরতে চান না
স্বাস্থ্য সচেতনতার কারণে পশ্চিমের অধিকাংশ দেশেই আগে কখনো মাস্ক ব্যবহার করতে হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রে করোনাভাইরাস মহামারিতে বাজার করা কিংবা হাঁটতে বের হওয়ার আগে মাস্ক পরার নিয়ম অনেকেই মানছেন না। কয়েকটি অঞ্চলে এর বিরুদ্ধে নাগরিকরা প্রতিবাদ ও ক্ষোভ জানিয়েছেন।
সরকারি নির্দেশনার পরেও মাস্ক না ব্যবহার করার পেছনের কারণ সম্পর্কে জানিয়েছেন কয়েকজন মনোবিদ। মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনে এ বিষয়ে বিস্তারিত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে।
অনেকে ‘ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ’ মনে করেন
প্রতিষ্ঠান কিংবা রাষ্ট্র যখন বাধ্যতামূলকভাবে মাস্ক পরতে বলে তখন অনেকেই এটাকে ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ বলে মনে করেন, এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন। ভ্যান্ডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল বিভাগের অধ্যাপক ও মনোবিদ ডা. ডেভিড অ্যারনফের মতে, মাস্ক পরার নির্দেশনা বাধ্যতামূলক না করে সংহতি প্রকাশের জন্য আহ্বান জানানো উচিত। মানুষকে বোঝাতে হবে যে, কাপড়ের মাস্ক পরে যদি আপনি ভাইরাসটির উপসর্গহীন বাহক হন তবে আপনার মাধ্যমে অন্যরা হয়তো সংক্রমিত নাও হতে পারে।
ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট স্টেভেন টেইলর বলেন, ‘মানুষের কাছে তাদের স্বাধীনতার মূল্য অনেক বেশি। তাই যখন তারা কোনোকিছুকে তাদের স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ বলে মনে করেন তখন সেটার প্রতিবাদ করেন। নৈতিকভাবেই ক্ষোভ প্রকাশ করেন।’
মিশিগানে সম্প্রতি প্রায় ৭০০ মানুষ বাড়িতে থাকুন (স্টে অ্যাট হোম) নির্দেশনার প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসেন। সেসময় তারা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বাজারে যাওয়ার সময় মাস্ক ব্যবহারের নির্দেশনা নিয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করেন। পুলিশ জানায়, এ মাসে মিশিগানে এক ক্রেতাকে মাস্ক পরতে বলায় তিনি ওই নিরাপত্তাকর্মীকে গুলি করে হত্যা করেন।
প্রতিষ্ঠানের ভেতরে মাস্ক পরতে অনুরোধ করায় মিশিগানের আরেক ক্রেতা কর্মীর জামায় মুখ মোছেন। ওকলাহোমা শহরে পাবলিক প্লেসে মাস্ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক করার পরদিনই নাগরিকদের সহিংস আন্দোলনের হুমকির মুখে তা উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে।
ওকলাহোমার নগর ব্যবস্থাপক নরম্যান ম্যাকনিকল এক বিবৃতিতে জানান, অনেকেই এই নিয়মকে সংবিধান পরিপন্থি বলেছেন। কাউকেই মাস্ক পরতে বাধ্য করা যায় না। কোনো আইন বা আদালতের রায়ও এই নির্দেশনাকে সমর্থন করে না।
রেস্তোরাঁসহ পাবলিক প্লেসে ধূমপান নিষিদ্ধের সঙ্গে এর তুলনা করেন ডা. ডেভিড অ্যারনফ। তিনি বলেন, ‘রেস্তোরাঁ বা পাবলিক প্লেসে ধূমপান না করার নিয়ম মানুষ মেনে চলে কারণ তারা বোঝে যে, সেসব জায়গায় ধূমপান করলে অন্যের স্বাস্থ্যের ক্ষতি হতে পারে। আমরা এখন এমনই এক পরিস্থিতিতে আছি। মানুষকে বোঝাতে হবে যে, ব্যক্তি স্বাধীনতার কথা ভেবে মাস্ক না পরলে আমি যদি উপসর্গহীন বাহক হই তবে আমার শ্বাস-প্রশ্বাস থেকে অন্য কেউ সংক্রমিত হতে পারেন।’
অনেক মনে করেন ‘মাস্ক’ ব্যবহার দুর্বলতার লক্ষণ
ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট ও নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডেভিড আব্রাহামের মতে, অনেকেই মনে করেন মাস্ক ব্যবহার করা মানে ভয় স্বীকার করে নেওয়া। মানুষের কাছে ‘ভাইরাস সংক্রমণের ভয়ে আছি’ এমনটা প্রকাশ পাবে বলে তারা মনে করেন। তাই সাহস ও শক্তি প্রদর্শনের জন্য তারা মাস্ক পরেন না।
তিনি বলেন, ‘অনেকেই ভাবেন, মাস্ক পরে থাকা মানেই অন্যকে চিৎকার করে জানানো যে আমি ভাইরাসের ভয়ে আছি। তাই মনে মনে ভয় পেলেও অনেকেই তা মানুষকে জানাতে চান না।’
মানুষ অনেক সময় নিজেকে শক্তিশালী, সুরক্ষিত হিসেবে তুলে ধরতে ছদ্মবেশ ধারণ করে। এটা মানুষের স্বাভাবিক আচরণ। সমষ্টিগতভাবে মানুষ যখন ভীত কিংবা হুমকির মুখে থাকে, তখন অনেকেই নিয়ম না মেনে নিজেকে অন্যদের সামনে ‘বিশেষ’ হিসেবে প্রমাণ করতে চায়।
বিভ্রান্তিকর নির্দেশনা
শুরুতে ‘সুস্থদের মাস্ক ব্যবহারের প্রয়োজন নেই’ নির্দেশনা দেওয়া হলেও তিন মাস পরই তা ‘পাবলিক প্লেসে মাস্ক বাধ্যতামূলক’ এ পরিবর্তিত হয়েছে। এই ধরনের বিভ্রান্তিমূলক নির্দেশনার কারণে অনেকেই মাস্ক ব্যবহার কতটা জরুরি তা নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভোগেন।
বিশ্বজুড়েই উপসর্গহীন বাহকের মাধ্যমে সংক্রমণের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে মাস্ক ব্যবহারের নির্দেশনাও কঠোর হয়েছে। কাপড়ের মাস্ক ব্যবহার করে ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকানো না গেলেও যিনি আক্রান্ত তিনি অন্যকে কম আক্রান্ত করবেন এমন পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
ডা. অ্যারনফ জানান, এমনকী প্রথম সারির অনেক স্বাস্থ্যকর্মীও মাস্ক ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে বিভ্রান্ত। কারণ সিডিসি প্রাথমিকভাবে পরামর্শ দিয়েছিল, সুস্থ থাকলে মাস্ক ব্যবহারের প্রয়োজন নেই। তবে, এপ্রিলে এসে এ নির্দেশনা বদলে যায়।
অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় নেতারাও এ সম্পর্কে মিশ্রবার্তা দিয়েছেন। সিডিসি সাধারণ জনগণকে মাস্ক ব্যবহারের নির্দেশনা দিলেও হানিওয়েল মাস্ক ফ্যাক্টরি পরিদর্শনের সময় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেই মাস্ক ব্যবহার করেননি।
এছাড়াও, গত মাসে মায়ো হাসপাতাল পরিদর্শনের সময়ও ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সকে মাস্ক ব্যবহার করতে দেখা যায়নি। শীর্ষ কর্মকর্তাদের এমন আচরণের ফলেও জনগণের কাছে মিশ্র বার্তা পৌঁছে।
ডা. অ্যারনফ বলেন, ‘এ ধরনের মিশ্র বার্তার কারণে মানুষ বিভ্রান্ত হন। কর্মকর্তাদের মতো নাগরিকরাও যার যার মতো করে নিয়ম তৈরি করার সুযোগ পান।’
অস্বস্তিবোধ
আব্রাহাম বলেন, ‘যখন মানুষের উপর স্বাভাবিক আচরণের বাইরে কোনো নির্দেশনা চাপিয়ে দেওয়া হয় তখন মানুষ সেটা নিয়ে প্রশ্ন করে, সেটাকে প্রতিরোধ করতে চায়। এটা স্বাভাবিক মানসিক প্রবণতা।’
এশিয়ার অনেক দেশে বায়ু দূষণের কারণে মানুষ আগে থেকেই মাস্ক ব্যবহারে অভ্যস্ত। এশিয়ার দেশগুলোতে জনসমক্ষে মুখ ঢেকে রাখা তুলনামূলক গ্রহণযোগ্য বলে সেখানে এই ধরনের নির্দেশনা নিয়ে কেউ তেমনটা ক্ষোভ প্রকাশ করেনি।
হঠাৎ করে মুখে মাস্ক পরে চলাটা অনেকের কাছেই অস্বস্তিকর মনে হয়। অনেকেই স্বাভাবিকভাবে নিশ্বাস নিতে গিয়ে সমস্যায় পড়েন।
Comments