এক টুকরো ছেঁড়া কাগজ ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন বুনে দিয়েছিল ঋতুর মনে
ক্রিকেট বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা। এ ব্যাপারে কারও হয়তো দ্বিমত নেই। দেশের প্রায় সব মানুষ খোঁজ-খবর রাখেন বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের। তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহিমদের মাঠে খেলতে দেখে তারা রোমাঞ্চ অনুভব করেন। কেবল তা-ই নয়, মাঠের বাইরে ক্রিকেটাররা কে-কী করছেন, সেসব গল্প শোনার ব্যাপারেও দেশের মানুষের আগ্রহ অনেক। আর পাদপ্রদীপের আলোয় সাধারণত থাকে ছেলেদের দল। সে যা-ই হোক। করোনাভাইরাস মহামারির কারণে দেশব্যাপী চলমান এই অচলাবস্থায়, দ্য ডেইলি স্টার যোগাযোগ করেছে বাংলাদেশের নারী ক্রিকেটারদের সঙ্গে। পেশা হিসেবে ক্রিকেটকে বেছে নেওয়ার পেছনে তাদের যে লড়াই ছিল, কষ্ট ছিল কিংবা যে কারণগুলো তাদের খেলোয়াড় হওয়ার পেছনে প্রধান ভূমিকা রেখেছে, সেসব তুলে ধরার প্রচেষ্টা থেকে।
প্রথম পর্বে অলরাউন্ডার ঋতু মণির গল্প উপস্থাপন করা হচ্ছে পাঠকের সামনে, যিনি চলতি বছরের শুরুর দিকে অস্ট্রেলিয়ায় অনুষ্ঠিত হওয়া আইসিসি নারী টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন।
নারী বিশ্বকাপে বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের মধ্যে সেরা বোলিং পারফরম্যান্সের কীর্তির মালিক ঋতু মণি। গেল ফেব্রুয়ারি-মার্চে সবশেষ নারী টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে তিনি ১৮ রানে নিয়েছিলেন ৪ উইকেট। মেলবোর্নের ওই ম্যাচে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ ছিল নিউজিল্যান্ড। অথচ ঋতু একসময় জানতেনই না যে, বাংলাদেশে নারী ক্রিকেট দল রয়েছে!
২০০৬ সালের পর ঋতু প্রথম জানতে পেরেছিলেন যে, বাংলাদেশের মেয়েরাও পেশাদার ক্রিকেট খেলে এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দেশের প্রতিনিধিত্ব করে।
ক্রিকেটকে পেশা হিসাবে বেছে নেওয়ার পেছনের গল্পটি জানাতে গিয়ে তিনি এই প্রতিবেদককে বলছিলেন, ‘একদিন আমি যখন স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছিলাম, তখন দেখলাম ছেঁড়া সংবাদপত্রের টুকরো একটি অংশ রাস্তায় পড়ে আছে। সেখানে একটি শিরোনাম ছিল এমন যে, সালমা (খাতুন) আপু একটি টুর্নামেন্টে চার উইকেট পেয়েছিলেন। কোন টুর্নামেন্ট বা কোন ম্যাচ ছিল তা আমার মনে নেই।’
‘আমি কাগজটি নিয়ে মায়ের কাছে গিয়ে তাকে বলেছিলাম, “মা দেখো, আমাদের দেশের মেয়েরা ক্রিকেট খেলছে। আমিও ক্রিকেট খেলতে চাই।” শুনে আমার মা জবাব দিয়েছিল, “তুমি চাইলে পারবে। আমরা তোমাকে সাহায্য করব।” তারপর থেকে আমার পরিবারের প্রত্যেক সদস্য আমাকে ক্রিকেটার হওয়ার ক্ষেত্রে অনেক সহায়তা করেছে।’
এটা ছিল তার স্বপ্নের শুরু। আর বেশিরভাগ সাহসী স্বপ্নদর্শীদের মতো বগুড়ার বাসিন্দা ঋতুকেও অনেক লড়াই করতে হয়েছে, বাংলাদেশ দলের হয়ে খেলার স্বপ্ন সার্থক করতে অনেক ধরনের ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে।
জীবন-যুদ্ধের কঠিন সময়গুলোর স্মৃতি হাতড়ে ২৭ বছর বয়সী এই ক্রিকেটার বলেছেন, ‘২০০৮ সালে আমাদের মফস্বল শহরের আলতাফুন্নেসা মাঠে জেলা ক্রীড়া সংস্থা আয়োজিত একটি দৌড় প্রতিযোগিতায় আমি অংশ নিয়েছিলাম। সেখানে মোসলেম উদ্দিন স্যারের (বগুড়া জেলার প্রয়াত কোচ) সঙ্গে দেখা করার সুযোগ হয়েছিল। আমি তাকে বলেছিলাম যে, আমি ক্রিকেটার হতে চাই। মোসলেম স্যার তখন আমাকে বলেছিলেন যে, আমি যদি ক্রিকেটার হতে চাই, তবে আমাকে কেবল ক্রিকেটে-ই মনোনিবেশ করতে হবে। তারপর থেকে আমি আমার গ্রামের ছেলেদের সঙ্গে ক্রিকেট খেলতে শুরু করি।’
‘২০০৪ সালে আমার বাবা মারা যাওয়ার পর আমাকে, আমার তিন বোন এবং আমার ভাইকে ব্যাপক আর্থিক সমস্যায় পড়তে হয়েছিল। আমি যখন আমার গ্রাম থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে বগুড়া শহীদ চান্দু স্টেডিয়ামে ক্রিকেট অনুশীলন শুরু করি, তখন আমার পরিবার প্রচুর ত্যাগ স্বীকার করেছিল। কখনও কখনও পরিবারের খাবার এবং অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসগুলোর চাহিদা পূরণ করার মতো পর্যাপ্ত টাকা আমাদের হাতে থাকত না। আমার বড় ভাই জুয়েল মিয়া তার কাছে যা কিছু থাকত, তা আমাকে দিত। ২০১২ সালে জাতীয় দলে ডাক পাওয়ার আগ পর্যন্ত আমাকে এমন নানা ধরনের লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছিল।’
এমন সমাজ, যেখানে নারীরা প্রায়শই বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার হন এবং খেলাধুলায় অংশ নেওয়ার ব্যাপারে তাদেরকে নিরুৎসাহিত করা হয়, সেখানে ঋতুর বড় ভাই কীভাবে বহুবার মানুষের বিদ্রূপ আর কটাক্ষ সহ্য করেছিলেন, তার স্বপ্ন পূরণে সমর্থন যুগিয়েছিলেন, সেসবও স্পষ্টভাবে মনে করতে পারেন তিনি।
তবে পেশাগত জীবনের মর্যাদা সমুন্নত রাখতে কঠোর পরিশ্রমের পাশাপাশি ঋতুকে এখনও নানা ধরনের সীমাবদ্ধতা ও বাধা-বিপত্তি সামলে নিয়ে চলতে হচ্ছে।
করোনাভাইরাসের প্রকোপে নারীদের জাতীয় ক্রিকেট লিগ (এনসিএল) ও ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ (ডিপিএল) স্থগিত হয়ে যাওয়ায় সম্প্রতি আর্থিকভাবে কিছুটা বিপাকে পড়ার কথা উল্লেখ করে এই খেলোয়াড় জানিয়েছেন, ‘এই সংকটের সময়ে, আমি আমার ফিটনেস বজায় রাখতে সমস্যায় পড়েছি। আমি গেল ৫ মার্চ ঢাকা থেকে (বগুড়ায়) ফিরে এসেছি। আমি ব্যক্তিগতভাবে শারীরিক অনুশীলন করতাম এবং শহীদ চান্দু স্টেডিয়ামে হালকা দৌড়-ঝাঁপ করতাম। লকডাউনের সময়সীমা শেষ হওয়ার পর বাড়ি সংলগ্ন একটি খেলার মাঠেও হালকা দৌড়-ঝাঁপ চলত। তবে রমজান মাস শুরু হওয়ার পর থেকে আমার কোনো ধরনের শারীরিক অনুশীলন করার সুযোগ হয়নি। বাড়িতে আমার কোনো জিমের সুবিধা নেই এবং আমাকে কেবল ফ্রি-হ্যান্ড অনুশীলনের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে।’
জীবনের অনেক বাধা আর লড়াই জিতে আসা অলরাউন্ডার ঋতু আরও বড় কিছুর স্বপ্ন দেখেন। বাংলাদেশের ছোট্ট একটি মফস্বল শহরের এই নারী ক্রিকেট ক্যারিয়ারকে বিদায় বলার পর হতে চান সফল ব্যবসায়ী। প্রতিজ্ঞা আর পরিশ্রমের কল্যাণে নানান চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে তিনি ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করেছেন। তাই তার পরবর্তী লক্ষ্যও পূরণ হবে এমন প্রত্যাশা করা যেতেই পারে।
Comments