ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের ৪ গ্রামে কোনো সাহায্যই পৌঁছেনি
রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার কাঁকনহাট পৌর এলাকায় বাস করেন বাসনা বালা। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ার পর থেকে বাড়িতেই বসে আছেন। কোনো কাজ না থাকায় পরিবার নিয়ে তার অসহায় দিন কাটছে। স্বাভাবিক সময়ে স্বামীর সঙ্গে দিনমজুরের কাজ করতেন। অন্তত তিন বেলা খাবারের কোনো চিন্তা ছিল না তার। জমানো টাকা শেষ হয়ে গেছে অনেক আগেই। ত্রাণের আশায় পৌরসভায় ঘুরে আশ্বাস ছাড়া আর কিছুই মেলেনি।
বাড়িতে একটি ছাগল ছিল। সপ্তাহ তিনেক আগে তাও বিক্রি করে দিয়েছেন। বাসনা বালা বলেন, ‘পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে ছাগলের দাম অন্তত সাত হাজার টাকা পাওয়া যেত। বিক্রি হয়েছে মাত্র তিন হাজার টাকায়।’
এপ্রিল মাসের মাঝামাঝিতে ফসল তোলা শেষে নষ্ট বলে কৃষকরা জমিতে আলু ফেলে যায়। বাসনা তার দুই ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে জমি থেকে সেই আলু কুঁড়িয়ে এনেছিলেন। দুই মণ আলু বাজারে বিক্রি করে পেয়েছিলেন ছয় শ টাকা।
‘ঘরে বসে খেয়ে আর ধার শোধ করে সব টাকাই শেষ। এখন হাতে কিছুই নেই। মেম্বর-চেয়ারম্যানের কাছে গেলে তারা জাতীয় পরিচয় পত্রের কপি নিয়ে রাখেন। বলেন, সাহায্য এলে দেবেন। কিন্তু সাহায্য এখনো পাইনি,’ যোগ করেন তিনি।
আরও বলেন, ‘গত দুই সপ্তাহ ধরে বাড়িতে চাল নেই। এ-বাড়ি, ও-বাড়ি থেকে চাল চেয়ে আনি। সব সময় দান মেলে না। তখন ধার করি। শুধু দুপুরে একবার ভাত রান্না করি। কুঁড়িয়ে আনা আলু ভর্তা করি, কখনো সেগুলো দিয়ে তরকারি রান্না করি। নিজেরা কম খাই। বাচ্চাদেরকে খাওয়াই।’
কাঁকনহাট পুলিশ ফাঁড়ির পেছনে দলদলা গ্রামে গড়াৎ সম্প্রদায়ের অন্তত ৪০ পরিবার বাস করে। যাদের প্রায় সবাই দিনমজুর। বাসনা তাদেরই একজন। অন্যদের অবস্থা তার থেকে আলাদা না। কেউই ত্রাণ পাননি বলে অভিযোগ করেন।
এখন পর্যন্ত রাজশাহীতে দরিদ্রদের প্রাথমিক তালিকা ধরে, মোট সংখ্যার তিনগুণের বেশি ত্রাণ বিতরণ করা হয়েছে। অথচ ত্রাণ পাওয়ার যোগ্য অনেকেই জানিয়েছেন, তারা কোনো সহায়তা পাননি।
বিশেষ করে, জেলার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী অধ্যুষিত বেশির ভাগ গ্রামের মানুষ এখনো সব ধরনের সরকারি সহায়তার বাইরে। সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় না থাকায়, করোনা পরিস্থিতিতে কাজ হারিয়ে ঘরবন্দি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায়গুলোকে ত্রাণ বিতরণে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সহায়তা না পেয়ে অর্ধাহারে-অনাহারে তাদের দিন কাটছে।
গোদাগাড়ী উপজেলার মাটিকাটা ইউনিয়নে অন্তত চারটি গ্রামে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ওঁরাও সম্প্রদায়ের বাস। হাবাসপুরে আছে ৬৫ পরিবার, ভাজনপুরে ১৮, নতুনপাড়ায় ২৫ ও সিলিন্দায় ২৮ পরিবার। যাদের অধিকাংশই ত্রাণ পাওয়ার যোগ্য। দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে কথোপকথোনে তারা জানিয়েছেন, কোনো ধরনের সরকারি সুবিধা তাদের হাতে পৌঁছেনি।
হাবাসপুরের জগদিস চন্দ্র বসু বলেন, ‘করোনা পরিস্থিতিতে সব কিছু বন্ধ হয়ে যাওয়ায় জমানো টাকা শেষ হয়ে গেছে। গৃহপালিত পশু বিক্রি করে কোনোমতে চলছিল। কিন্তু দুই-তিন সপ্তাহ হলো খাবারের কষ্ট অসহনীয় হয়ে উঠেছে। আমরা কেউই ত্রাণ পাইনি। নেতারা বলে— অপেক্ষা করো, কত অপেক্ষা করবো? ক্ষুধার জ্বালায় কাজে বের হলেও কাজ পাই না। পুলিশে তাড়া করে।’
মাটিকাটা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রুহুল আমিন বলেন, ‘গ্রামগুলোর একটু দূরে হওয়ার কারণে হয়তো নজর এড়িয়ে গেছে। গ্রামের কেউ বিষয়টা নজরে আনেনি। আপনি জানালেন, আমি এখন নিজেই দেখবো ওই গ্রামগুলোতে যেন ত্রাণ পৌঁছে।’
এই চারটি ছাড়াও গোদাগাড়ী উপজেলার আটটি ইউনিয়নে অন্তত ১৫ হাজার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের পরিবার বাস করে। তাদের বেশিভাগই ত্রাণ সুবিধাবঞ্চিত। জাতীয় আদিবাসী পরিষদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, রাজশাহী মহানগর ও জেলায় ২০টি সম্প্রদায়ের অন্তত ৩৫ হাজার পরিবারের আছে এবং তাদের ৯০ শতাংশের বেশি হতদরিদ্র।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, জেলার ৭২টি ইউনিয়নে মোট সাড়ে ছয় লাখ পরিবার আছে। এদের অন্তত দুই লাখ পরিবার দরিদ্র।
জেলা সমাজ সেবা কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, জেলায় দরিদ্রদের মধ্যে সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যে বিভিন্ন সরকারি সুবিধা পাচ্ছেন অন্তত দেড় লাখ পরিবার। বলয়ের বাইরে থাকা দরিদ্রদের ত্রাণ পাওয়ার কথা।
গত ২৭ মার্চ ত্রাণ বিতরণ কর্মসূচি শুরু হওয়ার পর এক সংবাদ সম্মেলনে রাজশাহীর জেলা প্রশাসক হিসাব করে বলেছিলেন, জেলায় অন্তত এক লাখ মানুষের ত্রাণ সহায়তা প্রয়োজন। গত ৭ মে পর্যন্ত জেলার অন্তত তিন লাখ ৫৬ হাজার ৪১০ জনের মধ্যে তিন হাজার ১৯৬ টন খাদ্যশস্য ও এক কোটি ৩৬ লাখ ৫৪ হাজার ৭৭৮ নগদ টাকা বিতরণ করা হয়েছে।
জেলা প্রশাসনের এই হিসাব অনুযায়ী, দারিদ্রের তুলনায় প্রায় তিনগুণ বেশি ত্রাণ বিতরণ করা হয়েছে। কিন্তু ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের সদস্যরা বলছে, তাদের ৭০ ভাগের বেশি পরিবার এখনো সহায়তাবঞ্চিত।
কাজ নেই, খাবারও নেই
জাতীয় আদিবাসী পরিষদের কেন্দ্রীয় সদস্য রাজকুমার সাঁও বলেন, ‘আমাদের জনগোষ্ঠীর বেশিরভাগই দিনমজুর। তারা সবাই ত্রাণ পাওয়ার যোগ্য।’
দলদলা গ্রামের গড়াৎ সম্প্রদায়ের সুখো বালা বলেন, ‘বাসনা বালার মতো বিক্রি করার কিছু ছিল না আমার।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের থাকারই জায়াগা নেই, হাঁস-মুরগি কোথায় পালবো? কাজ করে খাই, এখন কাজ নাই। খাবারও নাই। মানুষের কাছে চেয়ে খাই। কত দিন যে এ রকম যাবে জানি না।’
তার মতে, ‘চালের দাম বেড়ে গেছে। তাই চালও আজকাল কেউ দিতে চায় না। সরকারি ১০ টাকা কেজির চাল কিনতেও গিয়েছিলাম কিন্তু আমাকে বলা হয়েছে বরাদ্দ আসেনি।’
দলদলা গ্রামে অন্তত সাতটি রবিদাস পরিবার বাস করে। তারা চর্মকারের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে। দুখু রবিদাস জানান, তারাও কোনো ত্রাণ পাননি।
দুখু আরও বলেন, ‘জমানো যা কিছু ছিল, বন্ধের প্রথম দুই সপ্তাহে শেষ হয়ে গেছে। কদিন কষ্ট করে আর পারছিলাম না। এখন প্রতি সকালে কয়েক ঘণ্টা স্থানীয় বাজারে কাজে বসছি। আগে দিনে কমপক্ষে পাঁচ শ টাকা আয় হতো। এখন ৫০/৬০ টাকার বেশি হয় না। এভাবেই চলছি।’
এ প্রসঙ্গে কাঁকনহাট পৌরসভার মেয়র আব্দুল মজিদ বলেন, ‘দলদলা গ্রামে গড়াৎ ও রবিদাস সম্প্রদায়ের কেউ হয়তো ত্রাণ না পেয়েও থাকতে পারেন। তারা যেন শিগগির ত্রাণ পান সেটি আমি দেখবো। দলদলা গ্রামে ১২৫ পরিবারের বাস। ওরা সবাই হতদরিদ্র। আমি নিজেই সেখানে একবার ত্রাণ দিতে গিয়েছিলাম। কাকে ছেড়ে কাকে দেবো? এদের অভাব পূরণ করার সাধ্য কারো নেই।’
আরও বলেন, ‘পৌর এলাকায় মোট ১৫ হাজার হতদরিদ্র পরিবার আছে। সরকারি ত্রাণ এসেছে দেড় হাজার জনের। আমি ব্যক্তিগতভাবে চার হাজার মানুষকে সাহায্য করেছি। বিভিন্ন সংস্থা আড়াই হাজার জনকে ত্রাণ দিয়েছে। শিগগির স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের উদ্যোগে এক শ জনকে সহায়তা করা হবে।’
গোদাগাড়ীতে সাঁওতাল সম্প্রদায়ের সামাজিক সংগঠন পারগানা পরিষদের সভাপতি রবীন্দ্রনাথ হেমব্রম বলেন, ‘সবার বাড়ি বাড়ি ত্রাণ পৌঁছে দেওয়ার কথা খালি খবরেই শুনেছি, বাস্তবে ত্রাণের জন্য বারবার দৌড়াদৌড়ি করেও পাওয়া যাচ্ছে না। গোদাগাড়ীতে অন্তত সাত হাজার সাঁওতাল পরিবার ত্রাণবঞ্চিত।’
‘আমার নিজের গ্রাম সাগরামপাড়ায় ২৫০ পরিবার বাস করে, তাদের মাত্র ২০ জনের ত্রাণ মিলেছে’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বাকিরা এখনো আশা করে বসে আছে। আমাদের সবাই অচ্ছুত মনে করে দূরে সরিয়ে রাখে। কেউ আমাদের কথা কানেই নেয় না।’
ত্রাণ না পেয়ে গত ২৮ এপ্রিল সকালে রবীন্দ্রনাথ গিয়েছিলেন ১২ কিলোমিটার দূরে উপজেলা সদরে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করতে। এক কর্মচারী তাকে বসতে বলেন। তিন ঘণ্টা বসে থাকার পরে তাকে জানানো হয়, দেখা হবে না, অন্য দিন যেতে হবে।
রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘এত দূরে তো আর রোজ যাওয়া যায় না।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, হটলাইনে ত্রাণের জন্য যোগাযোগ করা যায় সে কথা তিনি কখনো শোনেননি।
ত্রাণ বিতরণে অনিয়মের অভিযোগ
ওঁরাও সম্প্রদায়ের সামাজিক সংগঠন দ্বিঘরী রাজা পরিষদের রাজা নিরেন চন্দ্র খালকু ত্রাণ বিতরণে অনিয়মের অভিযোগ তুলে বলেন, ‘যাদের আগে ত্রাণ পাওয়ার কথা, তারা এখনো পায়নি। যাদের পরে পেলেও চলতো, তারা একাধিকবার ত্রাণ পেয়েছে।’
স্থানীয় নেতারা তাদের পছন্দের লোকদের ত্রাণ দিয়েছে। রাজনীতিতে সক্রিয় না এমন কেউ ত্রাণ পায়নি বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
নিরেন চন্দ্রের বাড়ি রিষিকূল ইউনিয়নের ছাতনী পাড়ায়। সেখানে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের ১৫৯ পরিবার বাস করে। তাদের ৩৫ জন ত্রাণ পেয়েছে। এর মধ্যে অন্তত ১২ জন সচ্ছল কৃষক ও রাজনৈতিক কর্মী বলে উল্লেখ করেন তিনি।
রাজকুমার সাঁও বলেন, ‘সাঁওতাল, ওঁরাও, মুণ্ডা, রায়, রাজেয়ারসহ অন্যান্য সম্প্রদায়ের অবস্থা ভিন্ন নয়।’
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে গোদাগাড়ীর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাজমুল ইসলাম সরকার বলেন, ‘একটি গ্রামের সবাই ত্রাণবঞ্চিত থাকলে সেটা অনাকাঙ্ক্ষিত। আমাদের উপজেলায় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের সংখ্যা বেশি। কর্ম হারানো মানুষগুলোর মধ্যে প্রথমেই তাদের ত্রাণ বিতরণের নির্দেশনা ছিল। তারপরও তারা বঞ্চিত হলে এর পেছনে দুটি কারণ থাকতে পারে। একটা হলো অসচেতনতা। কীভাবে কোথায় থেকে ত্রাণ পাওয়া যাবে তা না জানা এবং দ্বিতীয়টি হলো, সরকারি বরাদ্দের সীমাবদ্ধতা।’
তিনি আরও বলেন, ‘সরকারি-বেসরকারি ত্রাণ সমন্বয় করে বিতরণ করা হচ্ছে। তবে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রমে নেতৃত্ব দিচ্ছেন স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিরা।’
রাজশাহী জেলা প্রশাসক হামিদুল হক দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘ত্রাণ বিতরণে একজনকে বারবার দেওয়ার কারণে অনেকে বাদ পড়েছেন। এ রকম ঘটনা এড়ানোর জন্য ইতোমধ্যেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। দীর্ঘ সময় ধরে মানুষ ঘরবন্দি। অনেককে আমরা এত অসহায় পেয়েছি, যাদের বারবার ত্রাণ সরবরাহ করতে হয়েছে। যে কারণে অনেকে বাদ থেকেছেন। আমরা আরও বরাদ্দ পেয়েছি। যারা এখনো পায়নি, তাদের সবাইকে ত্রাণ পৌঁছে দেওয়া হবে।’
অন্তত তিন জন স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি বলেছেন, ত্রাণ বিতরণে স্থানীয় রাজনীতিবিদদের প্রভাব ছিল। নিয়ম অনুযায়ী, ইউপি চেয়ারম্যান-মেম্বরদের মাধ্যমে ত্রাণ বিতরণের কথা থাকলেও, স্থানীয় রাজনীতিবিদদের সঙ্গে ত্রাণসামগ্রী ভাগ করে বিতরণ করতে হয়েছে।
Comments