২টি মৃত্যু ও হাসপাতালের চিত্র

প্রয়োজন জরুরি সেবার। এই মহামারির মধ্যে হাসপাতালগুলোতে বাড়ছে রোগীর সংখ্যা। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই জরুরি সেবা বঞ্চিত হচ্ছেন গুরুতর অসুস্থ রোগীরাও। যার ফলে রোগী মৃত্যুর মত ঘটনা ঘটছে।
ছবি: স্টার ফাইল ফটো

প্রয়োজন জরুরি সেবার। এই মহামারির মধ্যে হাসপাতালগুলোতে বাড়ছে রোগীর সংখ্যা। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই জরুরি সেবা বঞ্চিত হচ্ছেন গুরুতর অসুস্থ রোগীরাও। যার ফলে রোগী মৃত্যুর মত ঘটনা ঘটছে।

গতকাল রোববার সকাল সাড়ে দশটায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনাভাইরাস ইউনিটে নিয়ে আসা হয় আবরার হোসেনের মাকে। তার জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন ছিল।

দ্য ডেইলি স্টারের একজন সহ-সম্পাদককে আবরার বলেন, ‘দুসপ্তাহ আগে মা জ্বর-জ্বর বোধ করা শুরু করেন। আমাদের সবারই ফ্লুর উপসর্গ ছিল এবং খুব দ্রুত সেরে উঠেছি। তাই মায়ের জ্বর নিয়ে আমরা খুব বেশি চিন্তা করিনি। গত কয়েক দিনে তার জ্বর কমেও যাচ্ছিল। আজ (গতকাল) সকালে তিনি ঘুম থেকে উঠে রান্না ও ঘরের অন্যান্য কাজের নির্দেশনা দিচ্ছিলেন। এরই মধ্যে হঠাৎ করে তার শ্বাসকষ্ট হতে শুরু করে। তিনি চেয়ারে বসে যান। খুবই কষ্টে ১০ থেকে ১৫ মিনিট শ্বাস নেওয়ার পর তিনি পুরোপুরি শ্বাস নেওয়া বন্ধ করে দেন।’

দ্রুত তাজমহল রোডের বাসায় অ্যাম্বুলেন্স ডাকেন আবরার। কিন্তু, অ্যাম্বুলেন্স আসতে সময় নেয় প্রায় ৪০ মিনিট।

আবরার বলেন, ‘সকাল দশটা ৩৫ মিনিটে আমরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের জরুরি বিভাগে পৌঁছাই এবং একজন ডাক্তার বা নার্সের খোঁজ করতে থাকি। সেখানে একজন নার্স আমাকে বলেন, লাইনে দাঁড়িয়ে টোকেন নিতে।’

‘আমি কাউন্টারে গিয়ে একটি টোকেন কিনে নিয়ে আসি। তখন নার্স আমাকে একটি রুম দেখিয়ে সেখানে গিয়ে রিসেপশনিস্টের সঙ্গে কথা বলতে বললেন। সেখানে চারটি বুথ ছিল আর প্রতিটিতেই ছিল লম্বা লাইন। জরুরি সেবা প্রয়োজন জানিয়ে আমি চিৎকার করলে লাইনের সামনে আমাকে যেতে দেয়। সেখানে আমার কথা শুনে মাকে চতুর্থ তলায় আইসোলেশন ওয়ার্ডে নিয়ে যেতে বলে।’

‘আমি যখন মাকে চতুর্থ তলায় নিয়ে যাচ্ছিলাম তখন একজন নার্স তার মুখে অক্সিজেন মাস্ক দেন। তবে সেটা কাজ করছিল না। মা নিজে থেকে ঠিকভাবে শ্বাস নিতে পারছিলেন না। তারপরে, নার্স মার ফাইল দেখে বললেন যে প্রেসক্রিপশনে ইকোকার্ডিওগ্রামের কথা লেখা নেই। এটা ছাড়া তারা কোনো ওষুধ দিতে পারেন না। নার্স আমাকে জানান, এই জাতীয় প্রেসক্রিপশন দিতে পারেন এমন কোনো চিকিৎসক কাছাকাছি নেই।’

আবরার আরও জানান, ফ্লোরের কিছুটা দূরেও যে চিকিৎসক ছিলেন তারাও তার মাকে কোনো প্রেসক্রিপশন দিতে পারবেন না বলে উল্লেখ করেন নার্স।

একটি ইসিজির প্রেসক্রিপশন পেতে পেতে আবরারের আরও ঘণ্টাখানেক সময় লাগে। সব মিলিয়ে হাসপাতালে ঢোকার পর থেকে ইসিজি করা পর্যন্ত পুরো ২ ঘণ্টা সময় পার হয়। বেশিরভাগ বেসরকারি হাসপাতালের জরুরি বিভাগে রোগী নিয়ে গেলে সাধারণত প্রথম যে কাজটি করা হয় তা হলো ইসিজি।

ইনকিউবিশনের প্রয়োজন ছিল কিনা জানতে চাইলে আবরার বলেন, ‘এই সময়ের মধ্যে তারা মাকে সিপিআর দেওয়ার চেষ্টা করেনি। অক্সিজেন দিয়েছিল কিন্তু মা নড়াচড়া করছিলেন না বা নিজে থেকে অক্সিজেন নিতে পারছিলেন না।’

ইসিজি করার জন্য আবরারের মাকে নেওয়া হলে রিপোর্টে বলা হয় তিনি মারা গেছেন। আবরার বলেন, ‘আমার মনে হয় মা বেডে থাকাকালীন সময়ই মারা গেছেন।’

বারবার চেষ্টা করেও ঢামেক হাসপাতাল পরিচালককে ফোনে পাওয়া যায়নি। তবে একজন প্রবীণ চিকিৎসক জানান, আবরারের মায়ের মতো রোগীদের জন্য গতকাল কোনো আইসিইউ খালি ছিল না।

তিনি বলেন, ‘এই রোগীরা গুরুতর পর্যায়ে এসে হাসপাতালে পৌঁছেছেন। কোনো বেড খালি না হলে আমি অক্সিজেন দেওয়া ছাড়া আর কোনো কার্যকর চিকিত্সা দিতে পারি না।’

মৃত্যুর পরেও অব্যবস্থাপনা

স্নিগ্ধা সুরভির বাবা কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ২০ এপ্রিল মারা যান।

সুরভী বলেন, ‘বাবা ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (আইসিইউ) ছিলেন। ভোররাত সাড়ে তিনটার দিকে তার বুকে তীব্র ব্যথা  ও শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। আমার মা আইসিইউতে বাবার সঙ্গে ছিলেন। তিনি এ অবস্থা দেখে নার্স বা ডাক্তারের খোঁজ করছিলেন। কিন্তু আশেপাশে কেউ ছিলেন না। বাবা মারা গেলেন। বাবা মারা যাওয়ার প্রায় ঘণ্টাখানেক পরে একজন ওয়ার্ড বয় আমার মায়ের কান্নাকাটি শুনে এগিয়ে আসেন। তিনি আমার মাকে বলেন যে আমার বাবা যেহেতু ইতিমধ্যে মারা গেছেন তাই মা যেন আইসিইউয়ের বাইরে চলে যান।’

এরপর থেকে সকাল দশ পর্যন্ত তার মা আইসিইউয়ের বাইরে অপেক্ষা করেন বলে জানান সুরভি।

তিনি বলেন, ‘আমার বাবা বালিশে হেলান দেওয়া অবস্থায় মারা গিয়েছিলেন। তার মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা পরে ভিতরে গিয়ে মা দেখেন বাবা সেই অবস্থাতেই আছেন। কেউ তার মুখের উপর চাদরটিও টেনে দেয়নি বা তাকে শুইয়ে দেয়নি।’

 কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের পরিচালক ও উপপরিচালককে গতকাল বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেও ফোনে পাওয়া যায়নি।

ঢামেক হাসপাতালেও একই অবস্থার মুখোমুখি হন আবরার। তিনি বলেন, ‘মা রাত সাড়ে বারোটায় মারা গেলেন। আমরা সঙ্গে সঙ্গেই চলে যেতে চাইছিলাম। কিন্তু তারা বলেন যে আমাদের কাগজপত্রের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।’

আবরার জানান, বিভিন্ন ডেস্কে দৌড়াদৌড়ি করে আরও প্রায় ছয় ঘণ্টা পরে তার মায়ের মরদেহ হাসপাতাল থেকে বের করতে পারেন তিনি।

(দ্য ডেইলি স্টারের প্রতিবেদক শাহিন মোল্লা এই প্রতিবেদনে সহায়তা করেছেন।)

Comments

The Daily Star  | English

Political parties want road map to polls

Leaders of major political parties yesterday asked Chief Adviser Prof Muhammad Yunus for a road map to reforms and the next general election.

7h ago