বাংলাদেশে করোনার ভবিষ্যৎ
বাংলাদেশ কি করোনার পিক টাইমে (সংক্রমণের সর্বোচ্চ পর্যায়) আছে নাকি সেই সময়টি আরও সামনে? স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী প্রতিদিনই করোনা শনাক্ত এবং মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। সবশেষ সোমবার একদিনে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা এক হাজার ছাড়িয়েছে। তবে শনাক্ত বৃদ্ধির কারণ পরীক্ষার সংখ্যা বেড়েছে। প্রতিদিন যে সংখ্যক পরীক্ষা হচ্ছে, সে তুলনায় আক্রান্ত ১২ শতাংশের কিছু কমবেশি। মৃত্যুর হার আরও কম। পরিসংখ্যান বিচার করলে ইউরোপ-আমেরিকার তুলনায় বাংলাদেশে করোনা পরিস্থিতি এখন পর্যন্ত খুব বেশি আতঙ্কের নয়। কারণ এখানে এখনও আক্রান্ত এবং মৃত্যুর সংখ্যা যথেষ্ট কম। কিন্তু এ নিয়ে আমাদের নির্ভার বা নিশ্চিন্ত থাকার কি সুযোগ রয়েছে?
আপনি আপনার বাসার আশপাশের দোকানদার, বিশেষ করে যারা রাস্তার উপরে যারা মাছ-মাংস, সবজি ও ফলমূল বিক্রি করেন, তাদের দিকে তাকিয়ে দেখুন, তারা সেভাবে ফিজিক্যাল ডিসট্যান্স বা স্বাস্থ্যবিধি মানেন না। অথচ তারা প্রতিদিনি অগণিত মানুষের সংস্পর্শে আসেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত পাড়া মহল্লার এসব দোকানদারদের মধ্যে কতজন আক্রান্ত হয়েছেন? আপনি আপনার এলাকায় খোঁজ নিয়ে দেখুন কতজন আক্রান্ত হয়েছেন বা কতজনের মধ্যে করোনার উপসর্গ দেখা দিয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রেডিকশন এবং হুঁশিয়ারি অনুযায়ী বাংলাদেশে এতদিনে লাখ লাখ মানুষ আক্রান্ত এবং কয়েক হাজার লোকের মৃত্যু হওয়ার কথা। তর্কের খাতিরে না হয় ধরে নেওয়া গেল যে, সরকার কিছু তথ্য গোপন করছে। কিন্তু কতজনের তথ্য গোপন করা সম্ভব? আপনার আত্মীয়-স্বজন-বন্ধু-বান্ধব কেউ মরে গেলে আপনি কি সেটি গোপন রাখবেন? অন্তত ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস তো দেবেন। এরকম কতগুলো স্ট্যাটাস আমাদের নজরে এসেছে? করোনার উপসর্গে অনেকের মৃত্যু হয়েছে বা এখনও হচ্ছে। তাদের সবাই যে করোনায় আক্রান্ত ছিলেন, তাও নয়। ধরা যাক তাদের অনেকে করোনায় আক্রান্ত ছিলেন। সেই সংখ্যাটা যোগ করলেও আমাদের মোট আক্রান্ত এবং মৃত্যুর সংখ্যা কত হবে?
বাস্তবতা হলো, আমাদের এখানে ওই অর্থে লকডাউন খুব একটা কার্যকর হয়নি। উপরন্তু অতি ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। ইউরোপ আমেরিকার মতো আমাদের দেশের মানুষ সেভাবে স্বাস্থ্য সচেতনও নয়। রাস্তায় বেরোলে ফিজিক্যাল ডিসট্যান্স বা শারীরিক দূরত্ব মানাও অসম্ভব। কিন্তু তারপরও আমাদের দেশে শনাক্ত/আক্রান্ত এবং মৃত্যুর সংখ্যা এত কম কেন? বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কি এর কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারবে?
বলা হচ্ছিল আক্রান্তের ৪৫ তম দিন না আসা পর্যন্ত ভয়াবহতা বোঝা যাবে না। ৪৫ তম দিন তো গেলো। বলা হলো, ৬০তম দিন না এলে বোঝা যাবে না। ৬০ তম দিনও পার হয়েছে। কিন্তু লাখ লাখ আক্রান্ত আর হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু হয়নি। তার মানে আমাদের এখানে করোনাভাইরাস খুব একটা বিধ্বংসী হতে পারেনি।
চিকিৎসকদের অনেকেই যে বিষয়ে একমত তা হলো, নানা কারণেই আমাদের দেশে ঠান্ডাজনিত ভাইরাস খুব একটা ভয়াবহ হতে পারে না। এর একটি বড় কারণ বাংলাদেশের মানুষের লাইফস্টাইল। এত বেশি বৈরী পরিবেশে এখানের মানুষ বেড়ে ওঠে যে, ঠান্ডাজনিত কোনো ভাইরাস তার শরীরে ঢুকে প্রাণঘাতি হয়ে ওঠার সুযোগ পায় না। তাছাড়া সারা বছরই মানুষ জ্বর সর্দি কাশির মতো সমস্যায় ভুগে ভুগে অভ্যস্ত হয়ে যায়। ফলে এ জাতীয় ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করে মানুষকে খুব বেশি কাবু করতে পারে না। বাংলাদেশে এই সময়ের তাপমাত্রাও ভাইরাস ছড়ানোর জন্য খুব উপযোগী নয়। বাতাসে হিউমিডিটি বেশি থাকায় ভাইরাস খুব বেশি ছড়াতে পারে না বলেও মনে করে হয়।
যারা বিদেশ থেকে এসেছেন, তারাই সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে ছিলেন। তাদের মধ্যে এখন পর্যন্ত খুব বেশি লোকের মৃত্যু হয়েছে, এমনটা জানা যায় না। বরং যেহেতু তাদের দেশে ফিরবার পরে দুই মাসেরও বেশি সময় পার হয়ে গেছে এবং এখন পর্যন্ত সুস্থ আছেন, ফলে ধরেই নেয়া যায় যে, তারা রোগমুক্ত।
তবে বাংলাদেশে করোনায় মৃত্যুর হার এখন পর্যন্ত যথেষ্ট কম থাকার পেছনে একটা বড় কারণ বয়স্ক এবং শারীরিক নানা সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা লকডাউনের কারণে গৃহবন্দী। যারা বাইরে বের হচ্ছেন তাদের বড় অংশই শারীরিকভাবে সক্ষম এবং তাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি। ফলে ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করলেও অনেকে সেটি টেরই পাচ্ছেন না। পরীক্ষা করলে হয়তো অনেকের শরীরে করোনা পজিটিভ আসবে। কিন্তু দেখা যাবে তিনি সাধারণ জ্বর ও সর্দি কাশিতে ভুগে সুস্থ হয়ে যাবেন যদি তার শরীরে অন্য কোনো জটিল অসুখ না থাকে।
ইউরোপ আমেরিকার তুলায় আমাদের দেশের প্রবীণ বা বয়স্ক মানুষেরা ঘরের বাইরে বের হন কম। বিশেষ করে বয়স্ক নারীরা ঘরেই থাকেন। ফলে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকা এই জনগোষ্ঠী করোনায় নিরাপদ, যদি না তারা আক্রান্ত কারও সংস্পর্শে আসেন।
কিন্তু এই আশাবাদের চিত্রটি বদলে যেতে পারে লকডাউন তুলে নেওয়ার পরে। কারণ লকডাউন তোলার পরে গণপরিবহন চালু হবে, প্রচুর মানুষের চলাচল শুরু হবে, যাদের মধ্যে বয়স্ক এবং বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্তরাও থাকবেন। গণপরিবহন বিশেষ করে বাস-ট্রেন-লঞ্চের মতো যানবাহনে যেহেতু শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা সম্ভব হবে না, তাই বৃদ্ধ এবং ঝুঁকিতে থাকা অনেকেই অন্যের মাধ্যমে করোনায় আক্রান্ত হতে পারেন। জটিল হলে তাদের মধ্যে কিছু লোকের মৃত্যুও হবে। ফলে লকডাউন তোলার পরে হঠাৎ করে করোনায় মৃত্যুর হার বেড়েও যেতে পারে। এটা আমাদের মেনে নিতে হবে। কারণ দীর্ঘ সময়ের জন্য লকডাউন বা সবকিছু বন্ধ রাখা যাবে না। তাহলে উপায় কী হবে?
করোনার ভয়ে ধনী-গরিব সব শ্রেণির মানুষ যেভাব স্বাস্থ্যসচেতন হয়েছে, সেটি ধরে রাখাই হবে প্রধান কাজ। স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে মেনে চলা এবং বাইরে বের হলে সবার মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করতে হবে। পকেটে স্যানিটাইজার রাখতে হবে। আমাদের চিরায়ত কিছু অভ্যাস ও বদঅভ্যাস বদলে ফেলতে হবে। মানুষের মুখের সামনে গিয়ে কথা বলা, ভিড়ের মধ্যে হাঁচি কাশি দেওয়ার ক্ষেত্রে অধিকতর সতর্ক থাকা, যাতে হাঁচি কাশির সাথে ভাইরাস ছড়িয়ে না পড়ে, সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। গণপরিবহনে যেহেতু ফিজিক্যাল ডিসট্যান্স বজায় রাখা যাবে না, অতএব এখন যেরকম সবাই স্বাস্থ্য সচেতন, সেটি ধরে রাখতে হবে। আমাদের হয়তো দীর্ঘমেয়াদে হ্যান্ডশেক করা এবং আনন্দ উৎসবে কোলাকুলির মতো সৌজন্যগুলো বাদ দিতে হবে। হয়তো দীর্ঘমেয়াদে আমরা কর্মস্থলে এবং ঘরের বাইরে মুখে মাস্ক পরেই পরস্পরের সাথে কথা বলব। অর্থাৎ করোনার সঙ্গে লড়াই করে বাঁচতে হলে আমাদের করোনাপূর্ব পৃথিবীর অনেক অভ্যাসই বদলে ফেলতে হবে।
লকডাউন তোলার পরে আরেকটা বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে হাসপাতালগুলো। যেমন করোনা রোগীদের চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেলে এখন রোগীর সংখ্যা খুবই কম। কিন্তু লকডাউন তুলে দেওয়ার পরে সেখানে আগের মতোই প্রচুর রোগীর ভিড় হবে এবং তখন নতুন করে অনেকের করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হবে। যেসব যন্ত্রপাতিতে করোনা রোগীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা হচ্ছে, সেসব যন্ত্রপাতি, কক্ষ, বিছানা ইত্যাদি যদি এক শ ভাগ জীবাণুমুক্ত করা সম্ভব না হয় এবং তখনও যদি কোনো করোনা রোগী ওইসব স্থানে যান বা যন্ত্রপাতি স্পর্শ করেন, তখনও অনেকের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকবে। ফলে লকডাউন শিথিল কিংবা তুলে দেওয়ার আগে এইসব বিষয়ে সরকারকে তো বটেই, ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান পর্যায়েও সচেতনতা বাড়াতে হবে। পরীক্ষা বাড়ার ফলে অনেক লোক শনাক্ত হচ্ছে এটি একদিকে ইতিবাচক এ কারণে যে, পজিটিভদের আইসোলেটেড বা বিচ্ছিন্ন করা সহজ হবে। তবে এই কাজটি অবশ্যই কঠোরভাবে করতে হবে। এভাবে পরীক্ষার সংখ্যা বাড়িয়ে আরও বেশি আক্রান্তকে শনাক্ত করতে হবে। সেইসঙ্গে মনে রাখতে হবে, করোনায় আক্রান্ত মানেই তিনি রোগী নন যতক্ষণ না সেটি গুরুতর শারীরিক সমস্যায় পরিণত হয়। সাধারণ জ্বর, সর্দি, কাশির চিকিৎসা এবং আইসোলেটেড থাকাই প্রধান কাজ। সামান্য কিছু সংখ্যক লোকের আইসিইউ, অক্সিজেন এবং ভেন্টিলেটরের সহায়তা লাগতে পারে। সেটি নিশ্চিত করতে হবে এবং এখানে কোনো ধরনের অনিয়ম বা বৈষম্য যেন না হয়, সেদিকে কঠোর নজরদারি রাখতে হবে।
করোনা পজিটিভ হলেই লাখ লাখ মানুষ মরে যাবে—বাংলাদেশে আশা করি ইউরোপ আমেরিকার মতো সেই ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হবে না। তবে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা এবং দীর্ঘমেয়াদে আমাদের হয়তো মাস্ককেও দৈনন্দিন পোশাকের অংশ করে নিতে হবে। আর বাইরে বের হলে পকেটে অতি আবশ্যক জিনিস হিসেবে একটি স্যানিটাইজারের বোতলও রাখতে হবে। এভাবেই আমরা করোনার বিরুদ্ধে লড়াইটা চালিয়ে যেতে পারি।
আমীন আল রশীদ: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, রংধনু টেলিভিশন
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)
Comments