অনন্ত হত্যা: বিচারের অপেক্ষায় ৫ বছর
বিজ্ঞানমনস্ক লেখক ও ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশকে কুপিয়ে হত্যা করা হয় ২০১৫ সালের ১২ মে সকালে। আজ মঙ্গলবার এ হত্যাকাণ্ডের পাঁচ বছর পূর্ণ হয়েছে।
যুক্তিনির্ভর লেখালেখির কারণে উগ্রবাদীরা তাকে প্রকাশ্যে হত্যা করেছে বলে পরিবারের সদস্য ও সহকর্মীরা দাবি করলেও আজও শেষ হয়নি বিচার কার্যক্রম।
সাক্ষ্যগ্রহণে দীর্ঘসূত্রিতায় দীর্ঘদিন ধরে আদালতে চলতে থাকা এ মামলায় দ্রুত বিচার পাওয়ার আশায় রয়েছেন অনন্ত বিজয়ের পরিবারের সদস্য, সহকর্মী ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা।
পেশায় ব্যাংকার এ লেখক বিজ্ঞানমনস্ক ও যুক্তিনির্ভর বই লেখার পাশাপাশি লিখতেন মুক্তমনা ব্লগে, সম্পাদনা ও প্রকাশ করতেন ‘যুক্তি’ নামের একটি ম্যাগাজিন এবং জড়িত ছিলেন গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের সঙ্গে।
২০১৫ সালের এই দিনে সকাল সাড়ে ৮টার দিকে কর্মস্থলে যাওয়ার জন্য নগরীর সুবিদবাজার এলাকার নূরানী আবাসিক এলাকার বাসা থেকে বের হয়ে গলির ভেতর থেকে একটু সামনে আসার পর তার ওপর চাপাতি নিয়ে হামলা চালায় চার অস্ত্রধারী। চাপাতির আঘাতে গুরুতর আহত অনন্ত হাসপাতালে নেওয়ার আগেই মৃত্যুবরণ করেন।
সে বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে দেশে বিজ্ঞানমনস্ক লেখক ও ব্লগারদের হত্যা শুরু হয় এবং ব্লগার রাজিব হায়দার, অভিজিৎ রায়, ওয়াশিকুর বাবু হত্যাকাণ্ডের ধারাবাহিকতায় হত্যা করা হয় অনন্ত বিজয় দাশকেও।
হত্যাকাণ্ডের দিনই অনন্ত বিজয়ের বড় ভাই রত্নেশ্বর দাশ সিলেটের বিমানবন্দর থানায় অজ্ঞাত চারজনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। সেখানে অভিযোগ করা হয় যে বিজ্ঞান বিষয়ে লেখালেখির কারণে অনন্তকে ‘উগ্র ধর্মান্ধ গোষ্ঠী’ পরিকল্পিতভাবে খুন করেছে।
মামলাটি তদন্ত পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগে (সিআইডি) স্থানান্তরের ২ বছর পর ২০১৭ সালের ৯ মে সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিল করেন সিআইডির পরিদর্শক আরমান আলী। এতে সন্দেহভাজন ১০ জনকে অব্যাহতির সুপারিশ করে ছয় জনকে অভিযুক্ত করা হয়।
অভিযুক্তরা হলেন— সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার আবুল হোসেন, খালপাড় তালবাড়ির ফয়সাল আহমদ, সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের বীরেন্দ্রনগরের (বাগলী) মামুনুর রশীদ, কানাইঘাটের পূর্ব ফালজুর গ্রামের মান্নান ইয়াইয়া ওরফে মান্নান রাহী ওরফে এবি মান্নান ইয়াইয়া ওরফে ইবনে মঈন, কানাইঘাটের ফালজুর গ্রামের আবুল খায়ের রশীদ আহমদ ও সিলেট নগরের রিকাবীবাজার এলাকায় বসবাসকারী সাফিউর রহমান ফারাবী ওরফে ফারাবী সাফিউর রহমান।
এর মধ্যে ফারাবী ব্লগার অভিজিৎ রায় হত্যা মামলারও আসামি এবং অভিযুক্ত মান্নান রাহী ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে থাকা অবস্থায় ২০১৭ সালের ২ নভেম্বর অসুস্থ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। এর মধ্যে কেবল মান্নান রাহীই অনন্ত হত্যার দায় স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছিলেন।
এ মামলায় অভিযোগ গঠন শেষে গত বছরের ৭ মে সিলেটের অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে এই মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। সাক্ষীদের অনুপস্থিতিতে বারবার পেছানো এ মামলা সম্প্রতি সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়েছে।
সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালে পাঠানোর পর গত ২৪ মার্চ এই মামলার সাক্ষ্যগ্রহণের কথা থাকলেও করোনা পরিস্থিতির কারণে অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত হয়েছে এ মামলার কর্মসূচি।
এই মামলার বাদীপক্ষের আইনজীবী এমাদউল্লাহ শহিদুল ইসলাম শাহিন বলেন, ‘মামলার ২৯ জন সাক্ষীর মধ্যে এখন পর্যন্ত ১১ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়েছে এবং সাক্ষীরা না আসায় কয়েকবার তারিখ পিছিয়েছে। তবে, আশা করছি নতুন আদালতে স্থানান্তর হওয়ায় এখন মামলার কার্যক্রমে গতি পাবে।’
অনন্ত বিজয়ের ভগ্নিপতি আইনজীবী সমর বিজয় সী শেখর দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘পাঁচ বছরেও মামলার অগ্রগতি আশাব্যঞ্জক নয়। তবে, আমরা আশাবাদী, দ্রুতই এ মামলাতে আমরা ন্যায়বিচার পাবো।’
গণজাগরণ মঞ্চ সিলেটের মুখপাত্র দেবাশীষ দেবু বলেন, ‘নৃশংস এ হত্যাকাণ্ডের পাঁচ বছর পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতিই হয়নি মামলার। রাষ্ট্রপক্ষের অনাগ্রহের কারণেই মামলার অগ্রগতি হচ্ছে না। খুনিদের চিহ্নিত করে বিচার করতে না পারলে অপরাধ নির্মূল করাও সম্ভব হবে না।’
রবীন্দ্র কুমার দাশ ও পীযূষ রানী দাশের দুই মেয়ে ও দুই ছেলের মধ্যে সবার ছোট অনন্ত শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজকর্ম বিষয়ে স্নাতকোত্তর শেষ করার পর পূবালী ব্যাংকের ডেভেলপমেন্ট অফিসার হিসেবে যোগ দেন।
সিলেটে গণজাগরণ মঞ্চের অন্যতম উদ্যোক্তা অনন্ত ‘মুক্তমনা’ ব্লগে লেখার পাশাপাশি বিভিন্ন অনলাইনে সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী ও যুক্তিনির্ভর লেখালেখি করতেন।
সিলেট থেকে প্রকাশিত বিজ্ঞান বিষয়ক ম্যাগাজিন ‘যুক্তি’ সম্পাদনা করতেন অনন্ত বিজয়। তার লেখা বইয়ের মধ্যে রয়েছে— ‘সোভিয়েত ইউনিয়নে বিজ্ঞান ও বিপ্লব: লিসেঙ্কো অধ্যায়’, ‘জীববিবর্তন সাধারণ পাঠ’ ও ‘ডারউইন: একুশ শতকে প্রাসঙ্গিকতা এবং ভাবনা’।
অনন্ত হত্যাকাণ্ডের এক বছর পর, তার হত্যার স্থানে নির্মাণ করা হয় একটি স্মৃতিস্তম্ভ। এরপর থেকে প্রতিবছর এ স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেই অনন্ত বিজয়কে স্মরণ করেন তার বন্ধু-শুভাকাঙ্ক্ষীরা।
তবে, করোনা মহামারির কারণে জনসমাগম এড়াতে এবার সে স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পস্তবক অর্পণের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
Comments