করোনার টেস্ট: ফলস-পজিটিভ, ফলস-নেগেটিভ কেন হয়!

Corona test.jpg
এক ব্যক্তির নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে। ছবি: রয়টার্স

অটোয়ার একটি ল্যাবরেটরিতে করোনাভাইরাসের টেস্ট হয়েছিল এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে। তাদের মধ্যে ২২ জনের ফলাফল আসে পজিটিভ। এক সপ্তাহ পরে ল্যাবরেটরির পক্ষ থেকে এই ফলাফল বাতিল করে জানানো হয়- যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে তারা ফলাফল বাতিল করেছে। ফলে নতুন করে তাদের টেস্টের আওতায় নেওয়া হয়। এই যে ২২ জনের ভুল ফলাফল এসেছে- ল্যাবরেটরির ভাষায় একে বলা হয়- ফলস পজিটিভ। অর্থাৎ ল্যাবরেটরির টেস্টে এদের করোনাভাইরাসের সংক্রমণ দেখালেও, ফলাফলটি আসলে সঠিক নয়।

ঘটনা এইখানেই শেষ না। ল্যাবরেটরির ‘ফলস পজিটিভ’ ফলাফলের ভিত্তিতে এই ২২ জনকে, এমনকি তাদের সংস্পর্শে আসা সবাইকে আইসোলেশনে রাখা হয়। যখন জানা গেল, এই ফলাফলটি ছিল ‘ফলস পজিটিভ’, নাগরিকদের পক্ষ থেকে ১০ মিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ চেয়ে মামলা ঠুকে দেওয়া হয়েছে। অটোয়ার এই পরীক্ষাগুলো হয়েছিল র‌্যাপিড টেস্টের মাধ্যমে। পরে সরকার অবশ্য এদের অনুমোদন বাতিল করেছে।

কেবল অটোয়ায়ই নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই করোনাভাইরাসের টেস্টের ফলাফল নিয়ে টুকটাক অসন্তোষ দেখা দিচ্ছে। ভাইরাসের সংক্রমণ হয়নি অথচ টেস্টে পজিটিভ এসেছে, আবার সংক্রমিত ব্যক্তির ফলাফল নেগেটিভ হয়েছে- এমন ঘটনা নানা দেশেই ঘটেছে এবং ঘটছে। দেশে দেশে গবেষক, বিশেষজ্ঞদের মধ্যেও এ নিয়ে আলাপ আলোচনা হচ্ছে। কোভিড টেস্টের ফলাফল কতোটা সঠিক পাওয়া যাচ্ছে, তা নিয়ে নানা দেশেই সন্দেহ বা সংশয় তৈরি হয়েছে। কানাডিয়ান সোসাইটি ফর মেডিক্যাল ল্যাবরেটরি সায়েন্সের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ক্রিস্টিন নেইলসন এ প্রসঙ্গে কানাডিয়ান মিডিয়াকে বলেছেন, ‘সব ল্যাব টেস্টেরই কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে।’

এটা বলতে হচ্ছে- কারণ কোনো টেস্টের বেলায় যদি ৯৯.৯% সঠিক ফলাফলও পাওয়া যায়, তারপরও ওই বাদবাকি ০.১% এর জন্য খোঁজখবর করার দরকার হবে। যেকোনো ল্যাব টেস্টের বেলায় তা সঠিক হয়েছে কী না, তা জানার উপায় দুটি। এক, যাদের রোগটি হল তাদের সংখ্যা এবং দুই, যাদের রোগটি হলো না তাদের সংখ্যা মিলিয়ে দেখার মাধ্যমে।

সবাই জানি, করোনা নামের ভাইরাসটি যে আতংকিত রোগ বয়ে এনেছে তার নাম কোভিড-১৯। কোভিড-১৯ পজিটিভ মানে ওই ব্যক্তির শরীরে করোনা ভাইরাস বিদ্যমান। এখন পর্যন্ত যতগুলো পদ্ধতিতে ভাইরাসটির টেস্ট করা হয়, তার মধ্যে সবচাইতে কার্যকর আর বহুল প্রচলিত পদ্ধতির নাম আরটি-পিসিআর (রিভার্স ট্রান্সক্রিপশন পলিমারেজ চেইন রি-অ্যাকশন টেস্ট)। এই পদ্ধতিতে রোগীর সোয়াবের সঙ্গে পাওয়া ভাইরাসের আরএনএ শনাক্ত করা হয়।

এই পদ্ধতিতে নাকের অথবা গলার এক্কেবারে ভেতরের দেয়ালে কটন সোয়াব ঢুকিয়ে সোয়াবটি চেপে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে যথেষ্ট পরিমাণে ভিজিয়ে বাইরে বের করে আনতে হয়। সোয়াবটি যদি শুধুমাত্র নাকের ভেতরে ঢুকিয়ে ভাইরাসে আক্রান্ত জায়গা স্পর্শ করিয়ে বের করা হয়, তবে যথেষ্ট পরিমাণে ভাইরাল আরএনএ পাওয়া যাবে না এবং রোগীর রেজাল্ট নেগেটিভ আসবে। আরও কথা আছে, ভাইরাস কারো শরীরে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে টেস্ট করা হলেও ভুল রেজাল্ট পাবার সম্ভাবনা থাকে।

করোনাভাইরাসের রেজাল্ট ভুল হওয়ার পেছনে অনেকগুলো ফ্যাক্টর কাজ করে। নমুনা সংগ্রহের প্রক্রিয়া যথাযথ না হলে টেস্টের ফলাফল ভুল হতে বাধ্য। নমুনা সংগ্রহেও কয়েকটি বিষয়কে গুরুত্ব দিতে হয়। প্রথমত: পরীক্ষার জন্য যথেষ্ট পরিমাণে নমুনা (সোয়াব) নেওয়া হলো কী না, দ্বিতীয়ত: সঠিক টুলস ব্যবহার করা হলো কী না, তৃতীয়ত: কীভাবে নমুনা প্রসেস করা হলো, আর চতুর্থত: সংক্রমণের কোন পর্যায়ে নমুনা সংগ্রহ করা হলো। এই এতোগুলো জিনিস ঠিকঠাক-মতো মিলে না গেলে করোনা টেস্টের ফলাফল ভুল আসার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, করোনা আক্রান্ত হবার পরপরই যদি অ্যা-সিম্পটোম্যাটিক মানুষদেরকে টেস্ট করা হয়, তবে তার ফলাফল শতকরা ৩০ ভাগ ক্ষেত্রে ভুল অর্থাৎ রেজাল্ট নেগেটিভ আসবে অথচ তাদের শরীরে ভাইরাসটি রয়েছে! আর ভুল-পজিটিভ আসে বেশিরভাগ সময় মেশিনের ত্রুটির কারণে। কিছু আসে যারা কাজ করছেন তাদের অদক্ষতার কারণে।

এখন এই পুরো প্রক্রিয়ার ভুলত্রুটিগুলো নানাভাবে পরবর্তী ডিলেমা তৈরি করতে পারে। যেমন, কারো যদি ভুলভাবে পজিটিভ আসে, তবে তার ব্যক্তি ও সামাজিক জীবনে তার বিরাট প্রভাব পরবে। নানারকম ট্যাবু আর সংকট তাকে বিপর্যস্ত করতে পারে। আবার কারো যদি ভুলভাবে রেজাল্ট নেগেটিভ আসে তাহলে ব্যক্তি নিজের অজান্তেই অন্যদেরও ভাইরাস ছড়ানোর বিরাট ঝুঁকি তৈরি করবে। অথবা সময়মত চিকিৎসা নেওয়ার ব্যাপারটিও হয়তো উপেক্ষিত হবে।

করোনার টেস্টের এই ভুল বা ফলস পজিটিভ-ফলস নেগেটিভ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার উপায় কী! নমুনা সংগ্রহে বাড়তি মনোযোগ, নমুনা সংগ্রহকারীদের প্রয়োজনীয় যোগ্যতা অবশ্যই প্রয়োজনীয়। ল্যাবরেটরির সক্ষমতা এবং যারা টেস্ট করবেন তাদের দক্ষতাও এই ক্ষেত্রে জরুরি। যিনি নমুনা সংগ্রহ করছেন, তাকে কাজটি করার প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করতে হবে। যার সোয়াব নেওয়া হচ্ছে, তাকে প্রস্তুত করা অর্থাৎ নাক/মুখের ভেতরে সোয়াবের কাঠি ঢুকানো হলে সেটা বেশ একটা অস্বস্তিকর অনুভূতি বা ব্যথাও হতে পারে, এই ব্যাপারে তাকে সচেতন করার দরকার আছে, নইলে অযাচিত হাঁচি-কাশি বা রোগীর নেগেটিভ শারীরিক প্রতিক্রিয়া প্রকাশ পেতে পারে। আবার সোয়াব সংগ্রহকারী যদি পর্যাপ্ত দূরত্বে না থাকেন অথবা যদি একই গ্লাভস হাতে পরে একের পর এক নমুনা সংগ্রহ করতে থাকেন, প্রতিটি নমুনা সংগ্রহের পর গ্লাভস এবং মাস্ক পরিবর্তন না করেন, হাত ডিসইনফেক্ট না করেন, তাহলে তার মাধ্যমে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পরার ক্ষেত্রও কিন্তু তৈরি হয়।

সেরীন ফেরদৌস, প্রবাসী লেখক

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English
Khaleda Zia calls for unity

‘Seize the moment to anchor democracy’

Urging people to remain united, BNP Chairperson Khaleda Zia has said the country must quickly seize the opportunity to institutionalise the democratic system.

2h ago