অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন…
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেছিলেন, ‘আমরা একটা সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। এই সংকট হচ্ছে মূল্যবোধের সংকট। যে বিশ্বাস নিয়ে আর যে আদর্শকে সামনে রেখে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, কয়েক দশকেও তা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। মুক্তিযুদ্ধ এখনো তাই অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে।’
প্রতিবেশী ভারতের ‘পদ্মভূষণ’ সম্মাননা পাওয়ার পর ২০১৪ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি জাতীয় জাদুঘরে এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান এই বক্তব্য দিয়েছিলেন। ফেব্রুয়ারির শুরুর দিকে দৈনিক প্রথম আলোর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক হিসেবে যোগ দেওয়ার পর তার কোনো অনুষ্ঠানে প্রথম গিয়েছিলাম।
এই অনুষ্ঠানের অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়ার সময় চিফ রিপোর্টার বারবার বলে দিয়েছিলেন, আনিসুজ্জামান স্যারের বক্তব্য যেন রেকর্ড করি; গুরুত্বের সঙ্গে নিই। সুবোধ বালকের মতো পুরো অনুষ্ঠানজুড়ে কী হচ্ছে, কে কী বলছেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব টুকে নিই, কিন্তু অফিসে গিয়ে দেখি জায়গা বরাদ্দ হয়েছে মাত্র দেড়শ শব্দ। মনটা খারাপ হলো; কেননা আনিসুজ্জামান স্যারের পুরো বক্তব্যই তো তিন-চারশ শব্দ হবে, তাছাড়া যা বলেছেন সবই গুরুত্বপূর্ণ।
অনুষ্ঠানে একজন প্রভাবশালী মন্ত্রী ছিলেন, একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন, সবার এক-দুই লাইন বক্তব্য লিখলেও তো আরও জায়গা দরকার। শুধু শুধু এত কষ্ট করলাম। তবু সাহস করে বাড়িয়ে লিখলাম নিজের মতো, ছাপা হলো আড়াইশ শব্দেরও বেশি; যার বেশিরভাগটা জুড়েই ছিল আনিসুজ্জামান স্যারের বক্তব্য।
এরপর থেকে ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান (পরবর্তীতে জাতীয় অধ্যাপক) উপস্থিত ছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা বা তার আশপাশে এমন বহু অনুষ্ঠান কাভার করেছি। তিনি উপস্থিত থাকলে সংবাদ সাজানো নিয়ে মাথা ঘামানোরই প্রয়োজন হয়নি। চোখ বন্ধ করে ‘অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেছেন’ দিয়ে সংবাদ লিখা শুরু করে দিতাম।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলতেন ছোট করে, মিনিট দুই-তিন-চার। পাঁচ মিনিটের বক্তব্য তার খুব কমই পেয়েছি। কিন্তু যতটুকু বলতেন, ততটুকুর জন্যই পুরো অনুষ্ঠানজুড়ে অপেক্ষায় থাকতেন সংবাদকর্মীরা। এসব বক্তৃতায় তিনি কি বলতেন, তা নিয়েই আজকের এই লেখা।
ধর্মনিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতা
‘যে সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদ বাংলাদেশকে নষ্ট করছে, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের পরিপন্থী কাজ করছে, তার সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়া প্রয়োজন।’ ৯ মার্চ ২০১৪, টিএসসি মিলনায়তনে।
‘আমরা অনেক সময় বলি, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের কথা, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত না করার কথা। কিন্তু কারও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা যে রকম অন্যায়, তেমনি কারও বাকস্বাধীনতায় বাধা দেওয়াও যে অন্যায়, সেটা জোর গলায় বলি না।’ ৪ এপ্রিল ২০১৫, আর সি মজুমদার মিলনায়তনে।
‘আমরা কখনো ভাবতে পারিনি যে স্বাধীন এই দেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিষ্ঠার জন্য বক্তব্য-বিবৃতি দিতে হবে। মুক্তমনাদের আত্মরক্ষার্থে পথ খুঁজতে হবে।’ ১৭ নভেম্বর ২০১৫, টিএসসির রাজু ভাস্কর্যের সামনে এক মানববন্ধনে।
রাজপথের প্রতিবাদে
‘বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী কারও ধর্ম পালন ও পালন না করার সমান স্বাধীনতা আছে। সুতরাং যারা ধর্মহীনতার কথা বলে মানুষ হত্যা করে, তাদের সঙ্গে আপস করার কোনো সুযোগ নেই।’ ৩১ অক্টোবর ২০১৬, টিএসসি মিলনায়তনে মুক্তমনা লেখক ফয়সল আরেফিন দীপন হত্যার প্রতিবাদে।
২০১৫ সালের ১৪ এপ্রিল পয়লা বৈশাখে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ফটকের সামনে নারী লাঞ্ছনার ঘটনায় দীর্ঘদিনেও বিচার না হওয়ায় ৪ মে এক প্রতিবাদ সমাবেশে অংশ নিয়ে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, ‘নারীরা গৃহকোণ থেকে উন্মুক্ত প্রান্তর, রাজপথ থেকে সাধারণ পরিবহন পর্যন্ত সর্বত্রই লাঞ্ছিত হচ্ছেন।’ তিনি বলেন, ‘গত ৫০-৬০ বছরে নারীর অগ্রগতি এ দেশের সবচেয়ে ইতিবাচক অর্জন। সেই অর্জনকে নষ্ট করে দেওয়ার জন্য একটি গোষ্ঠী প্রস্তুত রয়েছে।’
বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীনকে নিয়ে তার ভাবনা
‘রক্ত-মাংসের সাধারণ একজন রাজনৈতিক কর্মী থেকে বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলনের মহাকাব্যিক চরিত্র হয়ে উঠেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৪৮ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত কতবার যে তিনি কারাবরণ করেছেন, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। কিন্তু কোনোবারই তিনি কোনো আপস করেননি। সংগ্রামের পথে স্বাধীনতার দিকে সারাদেশের মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা ও নিয়ে যাওয়ার কৃতিত্ব এককভাবে তার।’ ১৩ আগস্ট ২০১৬, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের আয়োজনে ‘বঙ্গবন্ধু স্মৃতি বক্তৃতা পর্ব’ অনুষ্ঠানে।
‘বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাজউদ্দীন আহমদের যে আনুগত্য ও ভালোবাসা, তা তিনি নিজের প্রাণ দিয়ে প্রমাণ করে গেছেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তা জেনে যেতে পারেননি। আরও দুঃখের বিষয়, বাঙালি জাতি তার গুণগ্রাহিতার পরিচয় দিতে আজও সফল হয়নি।’ ১ নভেম্বর ২০১৬, নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনে; তাজউদ্দীন আহমদ স্মারক বক্তৃতায়।
সরদার ফজলুল করিম ও ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ
‘সরদার ফজলুল করিম শিক্ষাটাকে শ্রেণিকক্ষে সীমাবদ্ধ বলে মনে করতেন না। তিনি সাধারণ মানুষকে শিক্ষক বিবেচনা করতেন। তিনি নিজের মতো করে ভাবতেন আর সবাইকে তাদের নিজেদের মতো করে ভাবার অনুপ্রেরণা দিতেন।’ ১০ মে ২০১৬, মোজাফফর আহমেদ চৌধুরী মিলনায়তনে; সরদার ফজলুল করিমের ৯১তম জন্মদিন উপলক্ষে।
‘তিনি নিজে ধার্মিক ছিলেন, কিন্তু বলে গেছেন, বাঙালি সত্তার কথা। অসাম্প্রদায়িক চেতনা জাগিয়ে তুলতে তিনি বড় ভূমিকা রেখেছিলেন। তিনি ভাষাগত জাতীয়তাবাদের কথা বলেছেন। ধর্মীয় সত্তা থেকে জাতিগত সত্তাকে সব সময় আলাদা রেখেছেন।’ ২৮ জুলাই ২০১৬, জাতীয় গণগ্রন্থাগারে; ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর ১৩১তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে।
তবে এমনও কিছু বিষয় ছিল যেগুলো নিয়ে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান কিছু বলতেন না। এ নিয়ে খানিক ক্ষোভও ছিল আমাদের। তবে এ বিষয়েও তার স্পষ্টবাদিতা ছিল মুগ্ধ করার মতো। একটা ঘটনার কথা মনে পড়ছে- বাংলা বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অন্য একটি বিভাগের তুমুল কোন্দল। সমাধান জানতে চাইলাম আনিসুজ্জামান স্যারের কাছে- বললেন, ‘দেখো, আমি তো বিভাগ থেকে বেরিয়েছি অনেক বছর, আমাকে এর মধ্যে টেনো না।’
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান স্যারের হাত থেকে আমার একটা পুরস্কার নেওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। ‘স্যামসন এইচ চৌধুরী ক্যাম্পাস জার্নালিজম অ্যাওয়ার্ড’ প্রদানের ওই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন তিনি। পুরস্কার নেওয়ার সময় ছবি তোলার ফাঁকে শুধু বলেছিলেন, ‘তোমার লেখাটা পড়েছি, ভালো হয়েছে।’ পুরস্কারের অর্থমূল্যের চেয়ে এই অনুপ্রেরণামূলক কথার মূল্য কত বেশি সেটি কেবল আমিই জানি। এরপর বিভিন্ন অনুষ্ঠানের শেষে এগিয়ে দেওয়ার ছলে কথা হয়েছে, বিশেষ প্রতিবেদনের মতামত নেওয়ার জন্য তার কক্ষে গিয়েছি, মুঠোফোনে কথা বলেছি। হয়তো তার কোনো ক্লাস করিনি, তাই বলে ‘স্যারের সরাসরি ছাত্র’ তকমা কি নিতে পারবো না?
কোনো অনুষ্ঠানে অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের উপস্থিতি আমাদের মতো সংবাদকর্মীদের ওপর কিরূপ প্রভাব ফেলতো তার একটা উদাহরণ দিয়ে লেখা শেষ করি। ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৫, সিনেট ভবনে প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁ স্মারক বক্তৃতা দিলেন। কিন্তু সেখান থেকে তাকে উদ্ধৃত করে কিছু লিখতে পারছিলাম না। কেননা তিনি একটা কথাও নিজের বলেননি, উদাহরণ দিয়েছেন হাজারো বইয়ের। না পারতে শিরোনামে লিখে দিলাম— ‘প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁর লেখা পড়ে শোনালেন আনিসুজ্জামান’।
আসিফুর রহমান, নিজস্ব প্রতিবেদক, দ্য ডেইলি স্টার
Comments