প্রাত্যহিক প্রয়োজনীয় একজন আনিসুজ্জামান
করোনায় প্রতিটি দিন আসে হতাশায়। এর মাঝে শূন্যতার সাগরে ফেলে চলে যায় আবু তৈয়ব মহম্মদ আনিসুজ্জামান। এটি তার পারিবারিক নাম। অন্যদিকে বাঙালি মুসলিম সমাজের বড় মানুষদের একজন ছিলেন শেখ আব্দুর রহিম (বাংলা ভাষায় যারা নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জীবনী লিখেছেন তিনি অন্যতম)। সেই শেখ আব্দুর রহিমের নাতিই পরবর্তীতে বাংলাদেশের জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। যিনি আলোকিত করেছেন বাংলা সাহিত্যে সংস্কৃতির আকাশ।
মাত্র ২৫ বছর বয়সে তিনি পিএইচডি করেন ‘বাংলা সাহিত্য ও মুসলিম মানস’ শিরোনামে। অভিসন্দর্ভ তিনি উৎসর্গ করেছেন আরেক জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে। এটাই তাকে বাংলা গবেষণা সাহিত্যে স্থায়ী আসন দিয়েছিল। পরে ‘পুরনো বাংলা গদ্য’, ‘স্বরূপ সন্ধান’, ‘বিপুলা পৃথিবী’, ‘আমার একাত্তর’সহ বহু গ্রন্থ প্রণয়ন করেন।
পরিচিতি পান দেশের শীর্ষ গবেষক, চিন্তাবিদ ও সংস্কৃতিতাত্ত্বিক হিসেবে। বিগত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকেই তার গবেষণা বাঙালি মুসলমানের মানসযাত্রা প্রসঙ্গ বাংলাদেশের সারস্বত সমাজ ও গবেষকদের মধ্যে চিন্তার বীজ বপন করেছিল। বায়ান্নর ভাষা-আন্দোলন থেকে অদ্যাবধি সমাজজীবনের অসংগতি ও সংকটমোচনের জন্য বাঙালি যে সংগ্রাম করে চলছে, তাতে তিনি অংশগ্রহণ ও নেতৃত্ব দিয়েছেন।
তিরাশি বছর বয়সের মাঝে জীবনজুড়ে প্রায় এক শতাব্দীর ভাঙা-গড়া ও বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্য মাইলফলক। এক সাক্ষাৎকারে বলেন: ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে আমি সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছি। মনে হয়েছে, এই আন্দোলনের জন্য আমি প্রাণ পর্যন্ত দিতে পারি। (১৪ জানুয়ারি ২০১৪, প্রথম আলো)
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন মুজিবনগর সরকারের পরিকল্পনা সেলের সদস্য। স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানের বাংলা ভাষ্য প্রণয়নের গুরুদায়িত্ব অর্পিত হয়েছিল তারই ওপর, কেননা তার ওপর প্রভূত আস্থা বিশ্বাস ছিল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বা তাজউদ্দীন আহমদের মতো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের।
সার্বিক চিন্তায় আনিসুজ্জামান ছিলেন বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির অভিভাবকতুল্য সদা সজীব মানুষ। তার জায়গাটা পূরণ করবেন এমন আশা করা যায় না। আসলে কেউ কারো আসন নিতেও পারে না, এটাই চিরাচরিত বাস্তবতা। প্রসঙ্গত মনে পড়ে, ২০১৫ সালে আবুল মনসুর আহমদ স্মৃতি পরিষদ থেকে আমার গবেষণা কাজের পুরস্কার তুলে দিয়ে পরের দিন দেখা করলে বলেন, ‘তোমার (কালের ধ্বনি আবুল মনসুর আহমদ বিশেষ সংখ্যা) কাজটি ভালো হয়েছে, লেগে থাকো। একদিন অনেক বড়ো হবে। আপাতত যা শুরু করেছো, তার ধারাবাহিকতা বজায় রেখো।’ তারুণ্যের কাজের মূল্যায়ন খুব মিস করব স্যার।
এইভাবে প্রাত্যহিক ভাবনায় (আবুল মনসুর আহমদ স্মৃতি পরিষদের স্যার সভাপতি, আমি আহ্বায়ক হিসেবে) গত প্রায় ৬ বছর কাজ করার সুবাদে অনুভব করছি কতটা প্রয়োজনীয় একজন আনিসুজ্জামান।
১. বুদ্ধিজীবীদের তথাকথিত কাঠামোর বাহিরে তিনি ছিলেন। অফিস বাসার তোয়াক্কা না করে যেখানে দেখা হয়েছে সেখানেই কাজ সেরে নিতে পেরেছি।
২. আমার ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, আবুল মনসুর আহমদ, জসীম উদদীন ও আবদুল কাদির (কালের ধ্বনি) গবেষণায় এই অগ্রজকে অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে পেয়েছিলাম।
৩. সাহিত্য সংস্কৃতি সমাজ, ইতিহাসের যেকোনো জটিল সমীকরণের সমাধানে বিজ্ঞ মানুষটি শিক্ষক হিসেবে ছিলেন।
৪. রুচিসম্মত যেকোনো প্রোগ্রামের বিষয়, অনুষ্ঠানসূচী ও সভাপতিত্বের দায়িত্ব নিয়ে পরামর্শ দিতেন এবং সময় মতো উপস্থিত হয়ে আয়োজকদের অবাক করে দিতেন।
৫. দৈনিক পত্রিকার গুরুত্বপূর্ণ নিউজ কিংবা কলামের মতামত ফোনে দিয়ে দিতেন, যেতে হতো না আগ্রহীকে।
৬. কোন শব্দের অর্থ বুঝতেছি না, ছবির সঙ্গে নাম খুঁজে পাচ্ছি না, এইরকম জটিল বিষয়ের সহজ সমাধান করে দিতেন। অপারগ হলে সঙ্গে সঙ্গেই জানিয়ে দিতেন।
৭. জনগণের ভাগ্যলিপি বাংলাদেশের সংবিধান স্যার এর অনূদিত। এই বিষয় যেকোনো জিজ্ঞাসার উত্তর দিতেন। রাষ্ট্রের সঙ্গে সংবিধানের সংঘর্ষ এমন কাজের যথাসাধ্য সমালোচনা করতেন।
গত ১০ বছরে আরও এইরকম বহু বিষয় বলার মতো আছে। আমার বয়স নয় কাজ বিবেচনায় স্যারের ঘনিষ্ঠ হয়েছিলাম। প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত আবুল মনসুর আহমদ স্মারকগ্রন্থ তার প্রমাণ। সর্বশেষ গত মার্চের শুরুতে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর আত্মজীবনীর ভূমিকা লিখে দিয়েছিলেন। (মিল্লাত মাফি মারফৎ)। আরও অনেক কাজ বাকী ছিল আমাদের। মেধা আর পাণ্ডিত্য শূন্যতায় হয়তো নতুন কোনো চিন্তায় এগুতে হবে। বিপুলা পৃথিবীর ইতিহাস নির্মাণ হবে নয়া পথে।
সবচেয়ে স্মরণীয় থাকবে— যেকোনো অনুষ্ঠানে/সভায় অল্প কথায় সেরা কথাটি বলে দিতেন। সৈয়দ শামসুল হকের আলোচনায় যেমন গিয়েছিলেন, তেমনি ফররুখ আহমদ, আল মাহমুদের আলোচনাও উপস্থিত হয়েছেন কীর্তি বিবেচনায়। আর যখনি কল দিয়েছি আন্তরিকতা পেয়েছি, ব্যস্ত থাকলে পরে কল ব্যাক করতেন। স্বল্পভাষী মানুষটি নিয়মানুবর্তিতা, সৌজন্যতাবোধ ও সময়জ্ঞানের জন্য চিরকাল শ্রদ্ধার আসনে থাকবেন।
শেষ করব আনিসুজ্জামান স্যারের ৮০তম জন্মদিনে বাংলা একাডেমিতে দেওয়া ভাষণের অংশ দিয়ে:
...আমার ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকেও যে আমি কিছু শিখিনি, তা নয়। তবে তাদের নিরন্তর ভালোবাসা এবং আমার অধিকাংশ সহকর্মীর সমর্থন আমার শিক্ষকজীবনের চলার পথ সুগম করেছে। আমার সন্তানেরা কখনো আমার সাধ্যাতীত কিছুর দাবি জানিয়ে আমাকে বিব্রত করেনি। পারিবারিক জীবনের সকল দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে আমার স্ত্রী আমাকে নিজের মতো চলার ও কাজ করার সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছে। তারপরও আমার যতটা করার ছিল, আমি তা করতে পারিনি। জীবনের শেষদিকে এসে অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক আফসোস করতেন, ‘আপনি তো আর লেখাপড়া করলেন না!’ তার মতো মানুষের প্রত্যাশা যে আমি পূরণ করতে পারিনি, তা আমার জন্যেও দুঃখের বিষয়। ভেবে দেখেছি, আশানুরূপ কিছু করতে না পারার তিনটে কারণ আছে আমার। সামাজিক অঙ্গীকারপূরণের চেষ্টা, আমার স্বাভাবিক আলস্য এবং অস্বাভাবিক আড্ডাপ্রিয়তা। সামাজিক কর্তব্যবোধ আমার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সেজন্যে সময় দেওয়াটা আমি কখনোই সময়ের অপচয় মনে করতে পারিনে। নিজের আলস্য অবশ্য ক্ষমার অযোগ্য। আমার বন্ধুচক্র বিশাল: তাদের সঙ্গে সময় কাটানো আমার জীবনের প্রশান্তির একটা বড়ে উৎস। তাই যদি বলি, কোনো খেদ নেই, তাহলে মিথ্যে বলা হবে না।
আমি শিক্ষক হতে চেয়েছিলাম—সেক্ষেত্রে প্রাপ্যের অধিক লাভ করেছি। আমি সারাজীবন ছাত্র থাকতে চেয়েছিলাম—আমি যথাসাধ্য শিখতে চেষ্টা করেছি। জীবনে চলার পথে অপ্রত্যাশিত আঘাত যে পাইনি তা নয়, কিন্তু ভালোবাসা পেয়েছি তার চেয়ে অনেক বেশি।
ইমরান মাহফুজ: কবি, গবেষক ও আহবায়ক আবুল মনসুর আহমদ স্মৃতি পরিষদ।
Comments