প্রবাস

ইতালি কি সত্যিই করোনার প্রতিষেধক পেয়ে গেছে?

ইতালির লকডাউন প্রায় ৮০ শতাংশ শিথিল করা হয়েছে। খুলে দেওয়া হয়েছে হোটেল-রেস্তোরাঁসহ হাট-বাজার। মানুষজন কাজে-কর্মে যেতে শুরু করেছে। জনজীবন আগের মতো স্বাভাবিক না হলেও ‘সাধারণ’ হতে চলেছে। করোনায় মৃত্যুর হার, নতুন সংক্রমণের হার শূন্যে নামানো সম্ভব না হলেও নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে। মানুষ এখন বিশ্বাস করতে শুরু করেছে যে করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। কোভিড-১৯ মানে নিশ্চিত মৃত্যু নয়।
লকডাউন শিথিল করায় ইতালিতে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করে খুলতে শুরু করেছে ডিপার্টমেন্টাল স্টোরগুলো। ছবি: রয়টার্স

ইতালির লকডাউন প্রায় ৮০ শতাংশ শিথিল করা হয়েছে। খুলে দেওয়া হয়েছে হোটেল-রেস্তোরাঁসহ হাট-বাজার। মানুষজন কাজে-কর্মে যেতে শুরু করেছে। জনজীবন আগের মতো স্বাভাবিক না হলেও ‘সাধারণ’ হতে চলেছে। করোনায় মৃত্যুর হার, নতুন সংক্রমণের হার শূন্যে নামানো সম্ভব না হলেও নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে। মানুষ এখন বিশ্বাস করতে শুরু করেছে যে করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। কোভিড-১৯ মানে নিশ্চিত মৃত্যু নয়।

জনমানুষের এসব বিশ্বাসের পাশাপাশি আরও একটা গুঞ্জন বেশ জোরে-সোরে শোনা যাচ্ছে। তা হলো— ইতালি কি করোনার প্রতিষেধক পেয়ে গেছে? তা না হলে এত আত্মবিশ্বাস পেল কোথায়? সবকিছু খুলে দেওয়ার সাহস অর্জন করলো কী উপায়ে?

ইতালিসহ ইউরোপের প্রায় সব দেশেই করোনার সংক্রমণ এখন নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে। ধীরে ধীরে সবাই স্বাভাবিক জীবনের দরজা খুলতে শুরু করেছে। কিন্তু, এই ধীরগতির জীবন কবে স্বাভাবিক গতিতে ফিরে আসবে— এ প্রশ্নের উত্তর এখনো অজানা। করোনা মহামারিতে থমকে যাওয়া গোটা দুনিয়া আদৌ আগের মতো স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরবে কি না, কতদিনে ফিরবে, ততদিনে পৃথিবীর অবস্থা, মানব জীবনের অবস্থা কোন পর্যায়ে পৌঁছাবে— এগুলোই এখন বড় প্রশ্ন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা পরবর্তী পৃথিবী হবে এক ‘নতুন পৃথিবী’। অনেক কিছু গোঁড়া থেকে শুরু করতে হবে। বহুসংখ্যক মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়বে। বড় বড় অনেক প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হয়ে যাবে। অর্থনৈতিক তাসের টেক্কা হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে মোড়ল দেশগুলোর। বিশেষ করে মিডিয়া, মুক্তবাজার অর্থনীতি, গ্লোবাল ভিলেজ দর্শন, অভিবাসননীতি— একদম ওলট-পালট হয়ে যাবে।

এসব নিয়ে কথা হয় অভিবাসী সাংবাদিক ও সংকট বিশ্লেষক নিয়াজ মাহমুদের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘করোনা মহামারি নিয়ন্ত্রণে ইউরোপের সরকারগুলোর পাশাপাশি নাগরিকরাও অনেকটা সচেতন এবং আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। যে কারণে নির্দিষ্ট কোনো প্রতিষেধক ছাড়াই মহামারি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়েছে।’

‘ইউরোপের মিডিয়ায় খবর বেরিয়েছে, করোনা আক্রান্ত অনেক প্রবীণ নাগরিক নিজের ভেন্টিলেটর খুলে দিয়েছেন কম বয়সীদের জীবন বাঁচাতে। তারা ভবিষ্যতের কথা ভেবে নিজেরা মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে যুবকদের প্রাণ বাঁচিয়েছেন। আর আমাদের দেশে ঘটেছে, ঘটছে এর উল্টো চিত্র। ভুল বার্তা দিয়েছে। করোনা মোকাবিলার প্রস্তুতি না নিয়েই বলেছে, তারা পুরোপুরি প্রস্তুত’, যোগ করেন তিনি।

বিশ্বের অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে নিয়াজ মাহমুদ বলেন, ‘করোনা ঝড় ইতোমধ্যে বিশ্ব অর্থনীতিকে দারুণভাবে প্রভাবিত করেছে। এরমধ্যে কত মানুষ চাকরি হারিয়েছেন এবং কোম্পানিগুলোর কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে— তা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে, এটা স্পষ্ট যে, বিভিন্ন দেশের জন্য এই ক্ষতি সামাল দিতে অনেক বছর সময় লেগে যাবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আগামী কয়েক মাসে বিশ্বের বড় বড় অর্থনীতির দেশগুলোতে ব্যাপক মন্দা দেখা দেবে। ফ্রান্স, ইতালি, স্পেনসহ ইউরোপের দেশগুলোর পর্যটন খাত থেকে মিলিয়ন মিলিয়ন ইউরো আয় হয়। এগুলো প্রায় বন্ধের মুখে।’

‘দীর্ঘদিন লকডাউনের কারণে প্রভাব পড়েছে দেশগুলোর অর্থনীতির ওপর। করোনার প্রতিষেধক বাজারে না আসা পর্যন্ত পর্যটন খাতে চরম মন্দা বিরাজ করবে। রেস্তোরাঁর ব্যবসার ওপর প্রভাব পড়বে। স্বল্প আয়ের নাগরিকরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। পাশাপাশি নিম্নমুখী প্রবৃদ্ধির হার তো রয়েছেই।’

ফ্রান্স, ইতালির পর্যটন প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আইফেল টাওয়ার, ডিজনিল্যান্ড, লুভে মিউজিয়াম বন্ধ থাকায় মিলিয়ন মিলিয়ন ইউরোর ক্ষতির মুখে পড়ছে ফ্রান্স। একইভাবে ইতালির রাজধানী রোম, পর্যটননির্ভর ভেনিসও মারাত্মক ক্ষতির মুখে রয়েছে। সেখানে বহু মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছেন।’

অভিবাসন ও কাজের বাজার প্রসঙ্গে নিয়াজ মাহমুদ বলেন, ‘করোনায় বিশ্বজুড়ে অভিবাসন ও কাজের বাজারে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্য থেকে বাংলাদেশি শ্রমিকদের দেশে পাঠানো শুরু হয়েছে। অনেক অভিবাসী চাকরি হারিয়ে কষ্টে আছেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ঘোষণা দিয়ে অভিবাসীদের জন্য দরজা বন্ধ করে দিয়েছেন। ইতালি সে দেশের অনিয়মিত অভিবাসীদের কৃষি কাজ, গৃহকাজ ও বয়স্ক সেবার শর্তে নিয়মিত করার প্রক্রিয়া শুরু করলেও দেশটির অধিকাংশ নাগরিকের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ বিরাজ করছে। করোনা সংকটে কর্মহীন হয়ে পড়া মানুষদের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে যেসব সুযোগ-সুবিধার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, তার সিকিভাগও এখনো পূরণ করা হয়নি। জার্মানি ও ফ্রান্স রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থীদের আবেদন গ্রহণ করলেও ‘গৃহীত’ হওয়ার সংখ্যা মাত্র ৩ থেকে ১০ শতাংশ। আগামীতে এ সংখ্যা আরও কমতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।’

‘ফ্রান্সের ১০৪ জন এমপি অনিয়মিত অভিবাসীদের করোনা মহামারি থাকাকালীন নিয়মিত করার জন্য প্রধানমন্ত্রী এদুয়ার্দো ফিলিপকে এক চিঠিতে অনুরোধ করেছিলেন। এ খবরে বাংলাদেশ, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের পাঁচ লাখ অনিয়মিত অভিবাসী আশান্বিত হয়েছিলেন। কিন্তু, প্রেসিডেন্ট মাখোঁ তার সাম্প্রতিক ভাষণে এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত না দেওয়ায় অনিয়মিত অভিবাসীরা ব্যাপক মাত্রায় আশাহত হয়েছেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘ফ্রান্সের উৎপাদনশীল কৃষি খাত সচল রাখার জন্য লাখো কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করছে ফরাসি সরকার। এই সময়ে যাদের কাজে নেই অর্থাৎ ঘরে বসে আছেন তাদেরকে সরাসরি কৃষি কাজের জন্য যোগাযোগ করতে বলা হয়েছিল। এ কাজের জন্য ইতোমধ্যে দুই লাখেরও বেশি আবেদন জমা পড়েছে বলে জানা গেছে। সুতরাং কৃষি খাতে ফ্রান্সের অনিয়মিত অভিবাসীদের নিয়মিত হওয়ার সুযোগ খুবই কম। তবুও বাংলাদেশ, ভারতসহ এশিয়ান অভিবাসীরা আশায় বুক বেঁধে আছেন।’

ইতালিসহ ইউরোপের দেশগুলো লকডাউন খুলে দিতে শুরু করেছে ঠিক। কিন্তু, এর অর্থ এটা নয় যে তাদের হাতে করোনাভাইরাসের প্রতিষেধক চলে এসেছে। বরং বলা যেতে পারে তারা করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধের কৌশল আয়ত্ত করে ফেলেছে। নিরাপদ দূরত্ব বজায়ে রেখে, প্রচলিত ওষুধ ব্যবহার করে কীভাবে সুস্থ থাকা যায়, আক্রান্তদের চিকিৎসা দেওয়া যায়— সেই পদ্ধতি রপ্ত করার মধ্য দিয়েই ইউরোপ স্বাভাবিক জীবনের পথে পা বাড়িয়েছে।

সমালোচকদের ভাষায়, রাজনৈতিক ব্যর্থতার কারণেই ইতালিসহ ইউরোপজুড়ে কোভিড-১৯ মহামারি আকার ধারণ করে। জনজীবন বিপন্ন হয়। এত মানুষের জীবন যায়।

তাদের মতে, চীনের উহানে মহামারি সৃষ্টি হওয়ার পরে ইউরোপের সরকারগুলো ব্যাপক উদাসীনতা দেখিয়েছে। গ্রহণযোগ্য কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। বরং ইতালির প্রধানমন্ত্রী জিউসেপ কোঁতে নাক উঁচু করে বলেছিলেন, ইতালি ইউরোপের মধ্যে সবথেকে বেশি ‘নিরাপদ’ দেশ। এখানে করোনার মহামারি হবে না। ইতালির লকডাউন নিয়ে তাচ্ছিল্যের ভাষায় কথা বলেছিল ফ্রান্স, স্পেন। বেলজিয়ামসহ অনেক দেশ ইতালির মহামারির খবর প্রচার করতে তাদের দেশের মিডিয়াকে বাধাগ্রস্ত করেছিল। তারা জনগণকে মহামারির খবর জানতে দিতে চায়নি।

সমালোচকরা বলেন, এসব অবান্তর কাজ না করে যদি সরকারগুলো আগে থেকে প্রস্তুতি গ্রহণ করতো, ডাক্তার-স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতো, জনগণকে করোনাভাইরাস সম্পর্কে সচেতন করতো, পর্যাপ্ত তথ্য দিতো, তবে এই মহামারি এড়ানো সম্ভব হতো। কিন্তু, সরকারগুলো সময় থাকতে কিছুই করেনি। তাদের রাজনৈতিক ব্যর্থতার কারণেই এত মানুষের জীবন দিয়ে করোনাভাইরাস প্রতিরোধের কৌশল শিখতে হয়েছে ইউরোপকে।

সমালোচকরা মনে করেন, ইউরোপের সরকাররা এখনো যথেষ্ট পরিমাণে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। তারা দেশের অর্থনীতির কথা বলে লকডাউন তুলে নিতে শুরু করেছে। অথচ এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসের কোনো নির্দিষ্ট প্রতিষেধক বাজারে আনা সম্ভব হয়নি। যা নতুন করে ঝুঁকি ডেকে আনতে পারে।

তাদের মতে, ইউরোপের আবহাওয়ায় এখন গ্রীষ্মকাল। আবহাওয়াগত কারণে করোনাভাইরাস দুর্বল হয়ে পড়বে কি না; মাত্র চার-পাঁচ মাসের মাথায় আবার যখন শীতকাল আসবে, সে সময় করোনাভাইরাস আগের রূপে ফিরে আসে কি না— এমন নানা গুঞ্জন ইউরোপের আকাশে-বাতাসে।

তবে, সমালোচকরা যাই বলুক, নির্দিষ্ট কোনো প্রতিষেধক ছাড়া কোভিড-১৯’র মতো ভয়াবহ মহামারি রোধ করার ইতিহাস পৃথিবীতে বিরল। বহু সাধনা করে, বিসর্জন দিয়ে এই প্রাণঘাতী ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব রোধ করার কৌশল আয়ত্ত করতে হয়েছে ইউরোপকে। বাংলাদেশের মতো ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলো ইউরোপীয় এসব দেশের বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ গ্রহণ করে, তাদের কৌশল গ্রহণ করে নিজেদের রক্ষা করার চেষ্টা করতে পারে।

Comments

The Daily Star  | English

8 killed as private car falls into roadside canal in Pirojpur

At least eight people, including four members of a family, died after a private car plunged into a roadside canal in Pirojpur early today

1h ago