প্রায় আড়াই মাস ধরে বন্ধ রেমা চা-বাগান

‘হামরা একবেলা খাই আর দুবেলা উপাসে কাটাই’

Tea-Worker
রেমা চা-বাগানের নারী শ্রমিকেরা। ছবি: স্টার

‘রইজ হামরা রাস্তায় বইসে ভিখ মাঙার মতো ভইলতে থাকি— কেউ চাইল-ডাইল লিয়ে আইসবেক ন নাই। আইলো তো ভালো। ওইদিন খাইতে পারি। আর নাইলে উপাসেই থাকি। হামরাতো একবেলা খাই আর দুবেলা উপাসে কাটাই’— এভাবেই নিজের দুর্দশার কথা বলছিলেন হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার রেমা চা-বাগানের চা-শ্রমিক বিধবা সুরেখা তাঁতি।

অবসরপ্রাপ্ত চা-শ্রমিক মহাবীর কল। কর্মকালে একদিন চা-বাগানের বাবুর (স্টাফ) ভুলে মারাত্মকভাবে হাতে আঘাত পান এবং হাতটি কেটে ফেলতে হয়। পরে তাকে অবসরে যেতে বাধ্য করা হয়। চিকিৎসা করাতে চা-বাগানের মালিক কিছু সহায়তা দিয়েছিলেন। সে সময় নিজের যা ছিল সেগুলোও শেষ। তিনি বলেন, ‘পরে আমি মেয়ের বাড়িতে আশ্রয় নেই। আমার মেয়ের তিন সন্তান। সেই সময় মেয়ের স্বামীও মারা যায়। বর্তমানে চা-বাগান বন্ধ হওয়ায় আমার মেয়ের কাজও বন্ধ হয়ে গেছে। এখন আমরা বেশিরভাগ সময় না খেয়ে দিনানিপাত করছি।’

দেশে চলমান করোনা পরিস্থিতিতে সুরেখা ও মহাবীরের মতো ৩৮৫ স্থায়ী চা-শ্রমিকসহ তাদের পরিবারের দিন কাটছে অনেকটা অনাহারে। গত ৬ মার্চ থেকে রেমা চা-বাগান বন্ধ। প্রায় আড়াই মাস ধরে এই বাগানের চা-শ্রমিকদের কাজ নেই, মজুরি নেই, খাবার নেই, চিকিৎসা নেই। অনাহারেই দিন কাটাচ্ছে তাদের।

বাগানের চা-শ্রমিক দিপালী বাড়াইক বলেন, ‘আমরা চিকিৎসা পাচ্ছি না। মালিক আমাদের দিকে তাকাচ্ছে না। আমরা খেটে খাওয়া মানুষ। তাই ভিক্ষা করতেও জানি না।’

‘এই চা-বাগানে করোনাভাইরাস আসার আগেই না খেয়ে আমাদের মরতে হবে। মাস্কের দরকার নেই। আমার পরিবারের জন্য এখন খাবার অত্যন্ত জরুরি। আমরা মাড়ভাত ও পাতিসানা (চা-পাতার ভর্তা) খেয়ে দিন কাটাচ্ছি। একদিকে করোনাভাইরাসের আতঙ্ক, অন্যদিকে বাড়িতে খাবার নাই। চা-বাগানের বাইরে কাজেও যেতে পারছি না’, যোগ করেন তিনি।

চা-শ্রমিক নেতা অরুণ দাস পাইনকা বললেন, ‘আমাদের বকেয়া বোনাস ও বকেয়া মজুরি এখনো পাইনি।’

তিনি জানান, গত ২ মার্চ চা-শ্রমিকদের খেলার মাঠ দখল করে বাগান ব্যবস্থাপক চারা রোপণ করে হাল চাষের চেষ্টা করলে চা-শ্রমিকদের সঙ্গে বিরোধ হয়। ৩ মার্চ বাগান কর্তৃপক্ষ এসে আবার চাষ দেয়। ৪ ও ৫ মার্চ চা-শ্রমিকরা এর প্রতিবাদে এক ঘণ্টা কর্মবিরতি পালন করে। ৫ মার্চ সকালে চা-শ্রমিক নেতারা এসে সমাধানের আশ্বাস দেয়। কিন্তু, বিরোধের জের ধরে বাগান ব্যবস্থাপক চুনারুঘাট থানায় অভিযোগ করলে ৫ মার্চ বিকালে পুলিশ তদন্ত করতে বাগানে আসে। এতে ক্ষেপে যায় শ্রমিকরা। এরপর ৬ মার্চ বাগান ব্যবস্থাপকের সঙ্গে কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে শ্রমিকদের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।

স্থানীয় ইউপি সদস্য নির্মল দেব বলেন, ‘এ ঘটনায় বাগানের সাবেক পঞ্চায়েত মানিক দাস ও আমাকেসহ ২৫ জনকে আসামি করে বাগান কর্তৃপক্ষ মামলা দায়ের করেছেন। একইসঙ্গে বাগান বন্ধ করে তারা তালা দিয়ে চলে গেছেন।’

সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্টের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ফেডারেশনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট আবুল হাসান বলেন, ‘প্রায় আড়াই মাস ধরে বাগানের চা-শ্রমিকদের কাজ নেই, হাজিরা নেই, রেশন নেই। দেশের জাতীয় দুর্যোগ করোনার সময়ে নিরাপত্তার কথা ভেবে চা-শ্রমিকরা আন্দোলন, মিছিল, সমাবেশ করতে পারছেন না।’

চা-শ্রমিক ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নৃপেন পাল বলেন, ‘আজকে পর্যন্ত রেমা বাগান খোলা হয়নি এবং শিগগির খোলার কোনো সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না। তাহলে কি রেমা বাগানের চা-শ্রমিকরা অনাহারেই দিন কাটাবে?’

সংক্ষুব্ধ নাগরিক আন্দোলনের হবিগঞ্জ জেলার সমন্বয়কারী তোফাজ্জল সোহেল বলেন, ‘বাগানের বয়স্ক শ্রমিকদের অনেকে ভয়াবহ অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। তা নিয়ে বাগান কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থাই নিচ্ছে না। রেমা বাগানের সব চা-শ্রমিককে বাঁচিয়ে রাখার জন্য এখন খাবার দরকার। বাগানের শ্রমিকদের খাবার যোগার করার সামর্থ্য নেই।’

করোনার সময়কে মাথায় রেখেই সারাদেশের প্রগতিশীল সমাজকর্মী ও রাজনৈতিক কর্মীদেরকে রেমা চা-বাগানের শ্রমিকদের পাশে দাঁড়াতে অনুরোধ করেন তিনি।

রেমা চা-বাগানের ম্যানেজার দিলিপ সরকারের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য তার মুঠোফোনে ১০-১৫ বার ফোন দিলেও তিনি রিসিভ করেননি।

চা-বাগানের সুপারভাইজার মুক্তিযোদ্ধা মো. আব্দুল জলিল বলেন, ‘বাগানে একটি মাঠ আছে। শ্রমিকরা আরেকটি মাঠের জন্য দাবি জানায়। কিন্তু, বাগান কর্তৃপক্ষ অন্য মাঠটিতে চা-গাছের নার্সারি লাগাতে চায়। এ নিয়ে বাকবিতণ্ডা হয়ে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে আমাদের কয়েকজন আহত হন।’

তিনি বলেন, ‘গতকাল চা-শ্রমিকরা তিনটি দাবির কথা জানিয়েছেন। এর মধ্যে কাজে না যাওয়া আড়াই মাসের মজুরিও রয়েছে। যা সম্পূর্ণ অনৈতিক।’

‘শ্রমিকরা কোনো ঘোষণা ছাড়াই কাজ বন্ধ রেখেছে। তারা কাজে আসলেই আমরা বাগান চালু করবো। মালিকও এমন নির্দেশনাই দিয়েছেন।’

‘চা-শ্রমিকরা বলছেন, আপনারা বন্ধ করেছেন’— এ কথা জানালে তিনি বলেন, ‘এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা।’

হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামরুল হাসান বলেন, ‘বিষয়টি সমাধানের জন্য আমরা চেষ্টা করছি। একটু সময় লাগছে।’

জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) মোহাম্মদ উল্ল্যা বলেন, ‘আমরা দুই পক্ষকে নিয়ে বসেছিলাম। কিন্তু, কোনো সমাধান হয়নি। তারা যদি আবারও বসতে চায়, আমরা আবার বসে বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা করবো। কারণ, পুলিশ সবার শান্তি চায়। আমরা শান্তির পক্ষে।’

Comments

The Daily Star  | English

Election in first half of April 2026

In his address to the nation, CA says EC will later provide detailed roadmap

14h ago