‘কেউ বোঝে না আমাদের কষ্ট’
ডেমরা বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের প্রভাষক আরাফাত হক এই প্রথম কোনো ঈদে তার সাত বছরের ছেলেটির জন্য নতুন জামা কিনতে পারবেন না।
নন-এমপিওভুক্ত শিক্ষক আরাফাত মার্চ ও এপ্রিলের বেতন পাননি। তবে তার এমপিওভুক্ত সহকর্মীরা যথাসময়ে বেতন পেয়েছেন এবং ঈদুল ফিতরের উত্সব ভাতাও পাবেন।
মান্থলি পেমেন্ট অর্ডার (এমপিও) এর আওতায় শিক্ষকরা রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে মূল বেতনের শতভাগ অর্থ পান। এর পাশাপাশি তারা ভাড়া বাসা ও চিকিৎসা ভাতা হিসেবে কিছু টাকা পান।
আরাফাত বলেন, ‘আমি আত্মীয়-স্বজন আর বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে ঋণ করে সংসার চালাচ্ছি। সামনে তো তাও পারব না। আমরা শিক্ষক, চাইলেই রাস্তায় দাড়িয়ে সাহায্যও চাইতে পারছি না কিংবা সবজি বিক্রি করা শুরু করতে পারছি না।’
বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সভাপতি নজরুল ইসলাম রনির মতে, করোনা মহামারিতে ৩৭ হাজার মাধ্যমিক বিদ্যালয়, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ২ লাখেরও বেশি নন-এমপিও শিক্ষকের পরিস্থিতি এখন প্রায় এমন।
নজরুল ইসলাম বলেন, ‘বেতন না হওয়ায় শিক্ষকরা অমানবিক জীবনযাপন করছেন। দেশের সার্বিক পরিস্থিতি আরও খারাপ হলে তাদের জন্য এটা বিপর্যয় ডেকে আনবে।’
অপরদিকে কর্তৃপক্ষের যুক্তি, তাদের আয়ের একমাত্র উত্স শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে প্রাপ্ত টিউশন ফি। সেই অর্থ সংগ্রহ করতে না পারায় তারা শিক্ষকদের বেতন দিতে পারছে না।
রাজধানীর দক্ষিণ বনশ্রীর নভেলটি স্কুল অ্যান্ড কলেজের শতাধিক শিক্ষক জানিয়েছেন, তারা মার্চ ও এপ্রিল মাসের বেতন পাননি। উত্সব ভাতার পাবেন বলেও আর আশা করছেন না।
প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ মো. রুহুল আমিন জানান, তহবিল সংকটের কারণে তারা শিক্ষকদের বেতন পরিশোধ করতে পারেননি। কারণ তারা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টিউশন ফি সংগ্রহ করতে পারছেন না।
নজরুল ইসলামের মতে, রাজধানীর কয়েকটি নামীদামী বিদ্যালয়েরই উদ্ধৃত তহবিল আছে এবং তারা টিউশন ফির উপর নির্ভর না করেই শিক্ষকদের বেতন দিতে পারে।
বেসরকারি শিক্ষকরা জানান, তারা সাধারণত খুব সামান্য বেতন পান। চাকরির পাশাপাশি তাদের প্রাইভেট টিউশনিও করতে হয় সংসার চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের জোগান দিতে। এখন স্কুল বন্ধ থাকায় এবং শিশুরা বেশিরভাগ বাধ্যতামূলকভাবে বাড়িতেই থাকায় তাদের উপার্জনের দুটি পথই বন্ধ হয়ে আছে।
বিধবা জেসমিন পারভীন পাবনার নাজিফা ব্রাইট মডেল স্কুলের (কিন্ডারগার্টেন স্কুল) একজন শিক্ষিকা। তিনি জানান, স্কুল এবং প্রাইভেট টিউশনি থেকে গত দুমাস ধরে তার আয় পুরোপুরি বন্ধ। ফলে নিদারুণ অর্থে কষ্টে তিনি দিন পার করছেন।
জেসমিন বলেন, ‘যদি করোনাভাইরাস পরিস্থিতি যদি এভাবেই অব্যাহত থাকে তাহলে বেঁচে থাকার জন্য আমার অন্যের কাছে হাত পাততে হবে। এছাড়া আর কোনো বিকল্প থাকবে না আমার। কেউ বোঝে না আমাদের কষ্ট।’
১৭ মার্চ থেকে সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। কয়েক দফায় বেড়ে এই বন্ধের মেয়াদ হয়েছে ৩০ মে পর্যন্ত। গত ২৭ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, পরিস্থিতির উন্নতি না হলে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকতে পারে।
বাংলাদেশ বেসরকারি অনার্স-মাস্টার্স কলেজ শিক্ষক ফোরামের আহ্বায়ক নেকবর হোসেন জানান, ৩৫২টি কলেজের প্রায় ৩ হাজার শিক্ষক একই সংকটে পড়ছেন। ‘আমরা আমাদের জীবন ও মর্যাদা বাঁচাতে বেতনের দাবি জানাচ্ছি।’
বেসরকারি কারিগরি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরাও গত কয়েক মাস ধরে বেতন পাচ্ছেন না।
কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা কনসোর্টিয়ামের সভাপতি আবদুল আজিজ স্বীকার করেছেন যে তারা ৯ হাজারেরও বেশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৩০ হাজার শিক্ষককে বেতন দিতে পারছেন না।
তিনি জানান, পাঁচ শতাংশেরও কম কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা আছে নিজস্ব তহবিল থেকে শিক্ষকদের বেতন দেওয়ার। যেহেতু বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান ভাড়া বাসায় প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করেন তাই তাদের বাসা ভাড়ার পাশাপাশি বিদ্যুৎ ও অন্যান্য বিল দিতে হবে। আর অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তুলনায় এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের টিউশন ফি কম। তাই, তহবিল সংরক্ষণের সুযোগ নেই।
‘নিয়মিত শিক্ষকদের বেতন দিন’
বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন স্কুল ও কলেজ ঐক্য পরিষদের চেয়ারম্যান ইকবাল চৌধুরী ও বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আব্দুর রশিদ বলেছেন, শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি না নিতে পারার কারণে তারা শিক্ষকদের বেতন দিতে পারবেন না।
দেশে প্রায় ৬০ হাজার কিন্ডারগার্ডেন স্কুলে প্রায় ৮ লাখ থেকে ১০ শিক্ষক রয়েছেন জানিয়ে ইকবাল চৌধুরী প্রশ্ন রাখেন, ‘আমরা জানি শিক্ষকরা কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন। কিন্তু বেতন দেওয়ার জন্য আমরাই বা কোথায় টাকা পাব?’
আব্দুর রশিদ আশঙ্কা প্রকাশ করে জানান, কিন্ডারগার্টেনের প্রায় ২০ শতাংশ শিক্ষার্থী ঝড়ে যাবে। এর কারণে তৈরি হওয়া অর্থনৈতিক সঙ্কটের কারণে অনেক শিক্ষককে চাকরি ছাড়তে হতে পারে।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. ফশিউল্লাহ জানান, ৫০০ থেকে ৬০০ কিন্ডারগার্টেন অধিদপ্তরে নিবন্ধিত রয়েছে।
তিনি বলেন, ‘বেশিরভাগ কিন্ডারগার্টেন ব্যবসা করে। তারা কেন শিক্ষকদের বেতন দিতে পারবে না? আমি তাদের অনুরোধ করব শিক্ষকদের নিয়মিত বেতন দেওয়ার জন্য।’
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক সকল বেসরকারি স্কুল ও কলেজের কর্তৃপক্ষকে শিক্ষকদের বেতন দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘কোনো স্কুল বা কলেজ যদি টিউশন ফি নেয় কিন্তু শিক্ষকদের বেতন না দেয় তাহলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না।’
Comments