প্রাকৃতিক নিরাপত্তা প্রাচীর সুন্দরবন

আবারও নিজের বুক পেতে দিয়ে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সময়ে দেশের ত্রাণকর্তা হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করলো সুন্দরবন। ম্যানগ্রোভ বনটি ঘূর্ণিঝড় আম্পানের ক্রোধ নিজেই মোকাবিলা করেছে। এটাই প্রথম নয়, এর আগেও এমন প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে লড়েছে সে।

আবারও নিজের বুক পেতে দিয়ে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সময়ে দেশের ত্রাণকর্তা হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করলো সুন্দরবন। ম্যানগ্রোভ বনটি ঘূর্ণিঝড় আম্পানের ক্রোধ নিজেই মোকাবিলা করেছে। এটাই প্রথম নয়, এর আগেও এমন প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে লড়েছে সে।

সুন্দরবন বাংলাদেশের জন্য প্রকৃতির এক উপহারসরূপ। সাইক্লোনের ভয়াবহতা থেকে অনেকাংশেই আমাদেরকে বাঁচিয়ে দিচ্ছে এটি। তাই, বন ও জীববৈচিত্র্য বিশেষজ্ঞরা এই বনের আশেপাশে সকল ধরনের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক কার্যক্রম বন্ধ করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।

আম্পানের আঘাতে সব মিলিয়ে কি পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা তাৎক্ষনিকভাবে নিরূপণ করা যায়নি। প্রাথমিকভাবে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, বনের বেশ কিছু কেউড়া গাছ ভেঙ্গে গেছে। সুন্দরবনের ভেতরে থাকা স্বাদু পানির জলাধারগুলো লবণাক্ত পানিতে ভরে গেছে।

ভারপ্রাপ্ত প্রধান বন সংরক্ষক আমির হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড়টি প্রচণ্ড আঘাত হানবে ধারণা করে আমরা আমাদের প্রত্যন্ত বন অফিসগুলোর সকল কর্মীদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিয়ে এসেছি। ওই বন অফিসগুলোতে প্রায় ৬০ থেকে ৭০ জন কর্মী কাজ করেন। আমরা তাদের অন্যান্য অফিসে নিয়ে এসেছি যেগুলোর ভালো অবকাঠামো রয়েছে।’

তিনি জানান, তারা উপকূলে অবস্থিত নয়টি অফিসের সকল কর্মীদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিয়েছেন। অফিসের মধ্যে রয়েছে- কোটকা, কোচিখালী, শেলারচর, পাশাকখালী, বাহেরাখালী, পুস্পাকাঠি, নোটাবেকি, কাচিকাটা, কাওয়াখালী।

যেসকল মধু সংগ্রহকারীরা ফিরে আসতে পারেননি তাদের নিকটস্থ বন অফিসে আশ্রয় নিতে বলা হয়েছে বলে যোগ করেছেন তিনি।

আজ বৃহস্পতিবার দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে আলাপকালে আমির হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘সুন্দরবনের ভেতরে ৬৫টি পুকুর আছে। এসব পুকুরের পানি আমাদের বন প্রহরী এবং বাঘ-হরিণসহ সকল বন্য প্রাণীরা পান করে থাকে। এই সব পুকুর লোনা পানিতে ভরে গেছে। এতে করে বন প্রহরী এবং বন্য প্রাণীরা পানযোগ্য পানির অভাবে পরবে। বন্য প্রাণীরা দীর্ঘদিন এসব লোনা পানি পান করলে তাদের শরীরে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা তৈরি হবে। এজন্য দ্রুত পুকুর খনন করে স্বাদু পানির ব্যবস্থা করতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে দেখা যাচ্ছে বনের কিছু কেউড়া গাছ ভেঙ্গে গেছে। বনের ভেতরে আর কি পরিমাণ গাছের ক্ষতি হয়েছে বা বন্য প্রাণীর কি পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তা এই মূহুর্তে বলা যাচ্ছে না। কারণ, নিরাপত্তার জন্য বনের দক্ষিণাঞ্চল থেকে আমাদের সকল কর্মীদের নিয়ে আসা হয়েছে।’

শিগগির ঘূর্ণিঝড়ের ফলে কতটা ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তার নিরূপণ করা শুরু করবে বন বিভাগ।

২০০৭ সালে ঘূর্ণিঝড় সিডরে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল সুন্দরবন।

ঘূর্ণিঝড়টি বনের পূর্ব অংশে, বিশেষত চাঁদপাই রেঞ্জে আঘাত হেনেছে। এই রেঞ্জের মধ্যে আছে কোচিখালী, কোটকা, হিরণ পয়েন্ট এবং দুবলারচর। সূত্র থেকে জানা যায়, ১৯৮৮ সালের ঘূর্ণিঝড়ে বনের উপড়ে যাওয়া গাছ ও ধ্বংসস্তূপগুলো সেই সময়ের ভয়াবহ পরিস্থিতি স্মরণ করিয়ে দেয়।

ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত বন কয়েক বছরের মধ্যেই নিজেকে আবার সবুজ করে তোলে। সিডর ও আইলার মতো গত বছরের দুর্বল ঘূর্ণিঝড় বুলবুল সুন্দরবনের তেমন ক্ষতি করতে পারেনি।

গত ৪০ বছর ধরে সুন্দরবন ঘুরে দেখছেন এবং বাঘ সংরক্ষণে কাজ করছেন খসরু চৌধুরী। তিনি জানান, বনটি আঘাত প্রশমক হিসেবে কাজ করছে।

সুন্দরবনের ভূমিকার বিষয়ে জানতে চাইলে বিশিষ্ট বন ও বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ ড. রেজা খান দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, প্রাচীর হিসেবে কাজ করার কারণে সুন্দরবন দেশকে ঘূর্ণিঝড় থেকে রক্ষা করছে।

সুন্দরবন দেশের জন্য কি করছে তার আর্থিক মূল্য নির্ধারণ করা অসম্ভব জানিয়ে তিনি বলেন, ‘সুন্দরবন না থাকলে পুরো খুলনা বিভাগ মরুভূমিতে পরিণত হতো। সেখানে কোনো মানুষের বাস থাকতো না থাকতো না কোনো গাছগাছালি। কারণ ঘূর্ণিঝড়ের বয়ে আনা নোনা সমুদ্রের পানি সব গাছপালা নষ্ট করে দেয়।’

ড. রেজা সুন্দরবনের আশেপাশে সকল ধরণের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক কার্যক্রম অবিলম্বে বন্ধ করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘সেখানে সরকারের কার্যক্রমের একমাত্র কারণ হওয়া উচিত বন বাঁচানো।’

কয়েক বছর ধরে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে আসা বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল জানান, সুন্দরবন যেকোনো অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তা আরও একবার প্রমাণিত হয়েছে। রামপাল, মোংলা, তালতলী ও কলাপাড়ায় ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম বন্ধে সরকারের আবারও ভাবা উচিত।

প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় উপকূলের মানুষের প্রাণহানি ঠেকাতে তাদের নেওয়া হয় আশ্রয় কেন্দ্রে। সেখানে গাদাগাদি করে থাকা মানুষদের মধ্যে চলমান কোভিড-১৯ এর মতো মহামারি আরও বড় বিপদের হাতছানি দেয়। শরীফ জামিল জানান, জনগণকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিয়ে উন্নয়ন পরিকল্পনা হওয়ার কথা থাকলেও এর বিপরীতটা হওয়ায় সরকারের পরিকল্পনা দেখে খুবই হতাশ হতে হয়।

বাংলাদেশ ও ভারতে যৌথভাবে এই অনন্য ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন আছে। বাংলাদেশে রয়েছে এর ৬ হাজার ১৭ বর্গ কিমি।

Comments

The Daily Star  | English

9 die of dengue

Highest single-day deaths this year

2h ago