বিপদের বন্ধুই প্রকৃত বন্ধু

ওলট-পালট হয়ে গেছে তাদের জীবন। যে মানুষগুলো দৈনিক আয় করে জীবন চালাতেন, তারাই এখন অন্যের সাহায্য প্রত্যাশী!
ছবি: স্টার ফাইল ফটো

ওলট-পালট হয়ে গেছে তাদের জীবন। যে মানুষগুলো দৈনিক আয় করে জীবন চালাতেন, তারাই এখন অন্যের সাহায্য প্রত্যাশী!

‘কাজ নেই, আয় নেই’। দিন এনে দিন খাওয়া মানুষের জন্য এটাই কঠোর বাস্তবতা। ঢাকার দুই কোটি জনসংখ্যার ২০ শতাংশই দিন এনে দিন খাওয়া মানুষ। এই লকডাউনে দুই মাস ধরে তাদের কোনো কাজ নেই। দিনে দিনে তারা দরিদ্র থেকে আরও দরিদ্র হচ্ছে। তারা ভিক্ষা করছেন না, কিন্তু সে পথে এগোনোর খুব বেশি বাকিও নেই।

এই নিম্ন আয়ের মানুষের অংশ দেশের প্রায় ১৩ হাজার সিএনজিচালিত অটোরিকশাচালক। তাদের বেশিরভাগই সরকারি-বেসরকারি সহায়তা তালিকার বাইরে অবস্থান করছেন। সরকারের করোনাকালীন সহায়তা বা ধনীদের আর্থিক সহায়তা— কোনোটিই এই মানুষগুলোকে খুঁজে পায়নি। বেঁচে থাকার জন্য প্রাণান্তর চেষ্টায় হয়তো সম্বল ছিল সামান্য কিছু সঞ্চয় বা আত্মীয়দের কাছ থেকে ধার-দেনা করে নেওয়া কিছু অর্থ।

তবে, অপ্রত্যাশিতভাবে তাদের মধ্য থেকে কিছু মানুষ পাচ্ছেন সহায়তা। ব্যবসায়ী আনিস আহমেদ ও তার স্ত্রী সুহানার ‘সাফ’ নামের একটি স্বল্প পরিচিত বেসরকারি ফাউন্ডেশন এই সংকটের সময় তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। এই ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় প্রায় তিন হাজার চালক তাদের পরিবারকে এই বিপদের দিনে টিকিয়ে রাখতে পারছেন।

পাঁচ জনের পরিবার নিয়ে রাজধানীর শাহজাহানপুর কলোনিতে থাকেন রমজান আলী। গত বৃহস্পতিবার দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, ‘আমি আমার সন্তানদের চোখের দিকে তাকাতে পারিনি। তিন দিন ধরে ঘরে খাবার ছিল না।’

সচ্ছল না হলেও ৪৫ বছর বয়সী এই মানুষটি দৈনিক গড়ে আট শ টাকা আয় করে স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপন করতেন। সাধারণ আয়ের মানুষের কাছে জনপ্রিয় রাইড শেয়ারিং ওভাই-এ সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালাতেন তিনি। ২৬ মার্চ থেকে বন্ধ শুরু হওয়ার দুই সপ্তাহের মধ্যেই তার জীবনে থাকা স্বাচ্ছন্দ্যটুকু জানালা দিয়ে পালিয়ে যায়। জীবনে নেমে আসতে থাকে ঘোর অন্ধকার। রমজান বলেন, ‘দোয়া করি, কোনো বাবা-মাকে যেন তাদের সন্তানদের অনাহারী মুখটা দেখতে না হয়।’

জীবনের চরম কঠিন সেই সময়ে ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে একটি ফোন কল যায় রমজানের নম্বরে। জানতে চাওয়া হয় তার বিকাশ অ্যাকাউন্টে অনুদান হিসেবে তিন হাজার ৭৫০ টাকা পাঠানো হয়েছে, তিনি তা পেয়েছেন কি না। রমজান বলেন, ‘আল্লাহ-ই বাঁচায়, তাই না!’

চট্টগ্রামের সিএনজিচালিত অটোরিকশাচালক মোহাম্মদ রিপন গত বৃহস্পতিবার ফাউন্ডেশনের কাছ থেকে দ্বিতীয় কিস্তির সহায়তা হিসেবে মোট পেলেন সাড়ে সাত হাজার টাকা। তার স্ত্রী আয়েশা বেগম গার্মেন্টসকর্মী হিসেবে কাজ করে যে অতিরিক্ত আয় করেন, তা মিলিয়ে তাদের পাঁচ জনের পরিবারে আর্থিক সংকট খুব একটা হতো না। নতুন এই দম্পতি যা উপার্জন করতেন, তার সবটাই ব্যয় করে ফেলেছিলেন। যার ফলে শিগগির তাদের দেখতে হলো মুদ্রার অপর পিঠ।

সবাই যখন সংকটে, তখন সহায়তা পাওয়া সবচেয়ে কঠিন। টেলিফোনে রিপন বলেন, ‘(বাড়ি) ভাড়া দিতে পারিনি। কিন্তু, এই সহায়তার টাকা দিয়ে অন্তত খেতে পারছি।’ তিনি আরও জানান, দুই মাসের মধ্যে এই প্রথম তিনি নোয়াখালীতে থাকা তার মাকে কিছু টাকা পাঠিয়েছেন।

আরেকজন চালক রফিকুল ইসলাম। বৃদ্ধ বাবা-মার দায়িত্ব তার কাঁধেই। এপ্রিলে তিনি যখন ফোন কল পেলেন, তখন তার ঘরে দিনে কেবলমাত্র একবেলা খাবার খাওয়া শুরু হয়ে গেছে।

ফাউন্ডেশনের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে রফিকুল বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না এমন কিছু্ও ঘটতে পারে। আজ আমার ঘরে খাবার আছে। যার কারণে, রাতে একটু শান্তিতে ঘুমাতে পারছি।’

ফাউন্ডেশন থেকে আর্থিক সহায়তা পাওয়ার পরেও এটা বিশ্বাস করে উঠতে পারছেন না সিলেটের মোহাম্মদ মানিক। তিনি বলেন, ‘আমাদের এই বিপদের সময়ে এটা অনেক বড় উপকার। আমরা এখন ঈদের দিনটাতেও খেতে পারব।’

২৫ বছর বয়সী মানিক বিশ্বাস করেন যে দেশের সংকটময় সময় শেষ হয়ে গেছে। তিনি শিগগির তার সিএনজিচালিত অটোরিকশা নিয়ে বের হতে এবং নিজেই আয় করতে পারবেন।

ওভাই রাইড শেয়ারিং অ্যাপের কয়েক শ চালকের অবস্থা মানিকের মতোই। ফাউন্ডেশনের সময়োপযোগী সহায়তা তাদের বেঁচে থাকার রসদ দিয়েছে।

যোগাযোগ করা হলে সুহানা অ্যান্ড আনিস আহমেদ ফাউন্ডেশনের (সাফ) সহ-প্রতিষ্ঠাতা আনিস আহমেদ হোয়াটসঅ্যাপে লিখেছেন, এখন পর্যন্ত গত দুই মাসে এক কোটি ৮৪ লাখ টাকা দুই হাজার ৯৫৩ জন চালকের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে।

মানুষের জন্য কাজ করা দাতব্য এই প্রতিষ্ঠানটির কাছে নতুন কিছু না। ফাউন্ডেশনটি বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের সঙ্গে মিলে গ্রামীণ অঞ্চলে ২২ হাজার পরিবারকে এক কোটি পাঁচ লাখ টাকার করোনাকালীন সহায়তা দিয়েছে।

ওভাই অ্যাপ আনিস আহমেদের মালিকানাধীন এমজিএইচ গ্রুপের একটি সহযোগী সংস্থা। ওভাই-এর চালকদের তিনি মনে করেন পরিবারের সদস্য। তাই, এভাবেই তিনি ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে চালকদের সহায়তা করে যাচ্ছেন।

এই চালকরা ওভাই-এর কর্মচারী নয়। তারা উবার ও পাঠাও-এর মতোই ওভাই-এর পক্ষ থেকে যাত্রীদের যাতায়াতের ব্যবস্থা করেন। আমাদের দেশে মহামারির মধ্যে চরম বাস্তবতা হলো নিয়োগকর্তারা তাদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরই ঠিকভাবে বেতন দিতে পারছেন না।

এমজিএইচ গ্রুপের মালিক আনিস বলেন, ‘আমরা আরও অনেকভাবেই দাতব্য কাজ করতে পারতাম। কিন্তু, আমরা খুবই সন্তুষ্ট যে আমরা এই পথে এগিয়েছি এবং সঠিক সময়ে কাজটা করতে পেরেছি। আমরা এমন একটি সময় তাদের সহায়তা করেছি, যখন এটা তাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।’

আইনত এই চালকদের প্রতি ওভাই-এর কোনো দায়বদ্ধতা নেই। তবুও, নামিদামি রাইড শেয়ারিং অ্যাপ উবার ও পাঠাও-এর মতো না হয়ে ওভাই এই চরম সংকটের সময়ে সেই সব মানুষদের পাশে দাঁড়িয়েছে, যারা এই ক্রান্তিকালীন সময়ের আগে তাদের সঙ্গে কাজ করেছে।

Comments

The Daily Star  | English

Hamas negotiators begin Gaza truce talks; CIA chief also present in Cairo

Hamas negotiators began intensified talks on Saturday on a possible Gaza truce that would see a halt to the fighting and the return to Israel of some hostages, a Hamas official told Reuters, with the CIA director already present in Cairo for the indirect diplomacy

15m ago