উপকূলের বাতিঘর ‘কমিউনিটি রেডিও’

উপকূলের অনেক প্রত্যন্ত এলাকা, দ্বীপ ও চরাঞ্চলে খবরের কাগজ পৌঁছায় না বললেই চলে। বিদ্যুৎ নেই, নেই টেলিভিশনে খবর দেখার সুযোগও। এমনকি বাংলাদেশ বেতারও শোনা যায় না অনেক জায়গায়। আর লাখো জেলে, যারা নিয়মিত সাগরে মাছ ধরতে যান, তারা থেকে যান প্রায় অন্ধকারে। তাই যখনই কোনো ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস আসে, তখন সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েন প্রান্তিক এই জনগোষ্ঠী।
প্রতীকী ছবি। (সংগৃহীত)

উপকূলের অনেক প্রত্যন্ত এলাকা, দ্বীপ ও চরাঞ্চলে খবরের কাগজ পৌঁছায় না বললেই চলে। বিদ্যুৎ নেই, নেই টেলিভিশনে খবর দেখার সুযোগও। এমনকি বাংলাদেশ বেতারও শোনা যায় না অনেক জায়গায়। আর লাখো জেলে, যারা নিয়মিত সাগরে মাছ ধরতে যান, তারা থেকে যান প্রায় অন্ধকারে। তাই যখনই কোনো ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস আসে, তখন সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েন প্রান্তিক এই জনগোষ্ঠী।

কিন্তু, কমিউনিটি রেডিওর কল্যাণে গত কয়েক বছরে পরিস্থিতির অনেকটা উন্নতি ঘটেছে। যেকোনো দুর্যোগে তারা সময়মতো সঠিক তথ্য পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করছে সুবিধাবঞ্চিত মানুষের কাছে। সাধারণ রেডিও ও মোবাইল ফোনে এই রেডিও শোনা যায়।

দেশে কমিউনিটি রেডিওর যাত্রা শুরু ২০১১ সালে। বর্তমানে ১৯টি কমিউনিটি রেডিও তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এর মধ্যে নয়টিই উপকূলীয় অঞ্চলে, যাদের মোট শ্রোতা প্রায় ৩০ লাখ। যে ৩০ লাখ মানুষের একটা বড় অংশই আগে সময়মতো সঠিক তথ্যটা পেতেন না। এই শ্রোতাদের একটা বড় অংশ জেলে। গবেষণা বলছে, সম্প্রচার এলাকার মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ২৫ শতাংশ মানুষ কমিউনিটি রেডিও শোনেন।

ঘূর্ণিঝড় আম্পানের পূর্বাভাস পাওয়ার পর থেকেই সার্বক্ষণিক সতর্কবার্তা ও প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রচার করেছে কমিউনিটি রেডিওগুলো। আর যেহেতু এই ঝড় করোনা মহামারির সময়ে এসেছে, তাই আবহাওয়া বার্তার সঙ্গে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য বার্তাও প্রচার করা হয়েছে। প্রচার করা হয়েছে স্থানীয় প্রশাসনের নির্দেশনাও। ফলে মানুষ সময়মতো প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি ও নিরাপদ আশ্রয় গ্রহণ করতে পেরেছেন। বেঁচে গেছে অনেক মানুষের প্রাণ, কমেছে সম্পদের ক্ষতি।

আগে এসব মানুষ ঘূর্ণিঝড়ের বিপদ সংকেত সম্পর্কে জানতে পারতেন না। বাতাসের অবস্থা দেখে পরিস্থিতি বুঝতেন। ততক্ষণে ঝড় চলে আসতো। কিন্তু, এখন সাগরে ঘূর্ণিঝড় তৈরির সঙ্গে সঙ্গেই তা প্রচার করতে শুরু করে কমিউনিটি রেডিও। সতর্কবার্তাগুলো স্থানীয় ভাষায় খুব সহজ করে প্রচার করা হয়। বলে দেয়া হয়— কখন, কী করতে হবে। মানুষও ফোন করে জেনে নেন অনেক তথ্য।

ঘূর্ণিঝড় মহাসেন, রোয়ানু, মোরা ও বুলবুলের সময়ও একইভাবে কাজ করেছে তারা।

পাঁচ থেকে সাত নম্বর বিপদ সংকেত দেওয়ার পর যখন বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়, তখন কমিউনিটি রেডিও-ই হয়ে ওঠে মানুষের একমাত্র ভরসা। আগেই উল্লেখ করেছি, এমন সব এলাকায় কমিউনিটি রেডিওর কার্যক্রম চলে যেখানে অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বেতারের ফ্রিকোয়েন্সি পাওয়া যায় না।

আট থেকে ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত দেওয়ার পর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ক অনুষ্ঠান সার্বক্ষণিক চলতে থাকে। ঝড়ের পরেও কোথায়-কী ক্ষতি হয়েছে, কোথায় ত্রাণ পাওয়া যাবে, পানি বিশুদ্ধ করার উপায়সহ নানা বিষয়ে অনুষ্ঠান প্রচার করা হয়।

এসব রেডিও স্টেশনে কাজ করেন স্থানীয় স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা। আছে স্বেচ্ছাসেবী ও শ্রোতা ক্লাবও। স্থানীয় ভাষায় অনুষ্ঠান প্রচার করায় এসব রেডিও অনেক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। মানুষও নির্দ্বিধায় ফোন করে প্রয়োজনীয় তথ্য জেনে নেন।

এই রেডিও যে শুধু ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে বার্তা দিয়ে জনপ্রিয় হয়েছে, তা নয়। এখানে গ্রামীণ সংস্কৃতির মিশেলে স্থানীয় ভাষায় কৃষি, স্বাস্থ্য, নারী অধিকারসহ বিভিন্ন বিষয়ে সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান প্রচার করা হয়ে থাকে। সরাসরি সম্প্রচার অনুষ্ঠানে মানুষ মোবাইল ফোনে যুক্ত হয়ে বিশেষজ্ঞ অতিথির কাছ থেকে সমাধান জানতে পারেন। তাই সমাজ উন্নয়নে আজ এক অনন্য হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে এই কমিউনিটি রেডিও।

আছে অনেক সীমাবদ্ধতাও। সবচেয় বড় সমস্যা ‘আর্থিক’। সামাজিক সংগঠন, ব্যক্তি ও বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠানের সহায়তা বা অনুদানে চলতে হয় তাদের। অনেক সময় কর্মীদের সামান্য বেতন-ভাতা দেওয়াও কঠিন হয়ে পড়ে। তবুও, সামাজিক দায়বদ্ধতা ও ভালো লাগার জায়গা থেকে কাজ করে যান কর্মীরা। পরের সমস্যাটি হচ্ছে— কারিগরি দক্ষ জনবলের অভাব। প্রত্যন্ত অঞ্চলে দক্ষ লোক গড়ে তোলাও কঠিন।

যেহেতু কমিউনিটি রেডিও দুর্যোগে মানুষের জীবন বাঁচাতে সহায়তা করে, জীবনমানের উন্নয়ন ঘটাতে সহায়তা করে এবং সুস্থ সংস্কৃতির বিকাশ ঘটায়, তাই এ খাতে সরকারি বিনিয়োগ দরকার। যে বিনিয়োগ বিফলে যাবে না। কেননা, ঘূর্ণিঝড়ের মতো দুর্যোগে জান-মাল ও অবকাঠামোর যে ক্ষতি হয়, তা পুষিয়ে নিতে সরকারের অনেক টাকা খরচ হয়। কিন্তু, যদি মানুষকে সময়মতো তথ্য দেওয়া যায়, সতর্ক করা যায়, তাহলে ক্ষতির পরিমাণ অনেক কমে আসে। আর সেই তথ্য প্রচারকারী কমিউনিটি রেডিওর উন্নয়নে কত টাকাই বা খরচ হবে।

একইসঙ্গে এটিও নিশ্চিত করতে হবে যে কেউ যাতে এর অপব্যবহার করতে না পারে।

লেখক: জিএম মোস্তাফিজুল আলম, উন্নয়নকর্মী।

[email protected]

 

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

DMCH doctors threaten strike after assault on colleague

A doctor at Dhaka Medical College Hospital (DMCH) was allegedly assaulted yesterday after the death of a private university student there, with some of his peers accusing the physicians of neglecting their duty in his treatment

5h ago