বোরো ধানের দাম: খুশি কৃষক, শঙ্কায় বিশেষজ্ঞরা
সংকটকালীন পরিস্থিতিতে দেশে খাদ্যশস্যের চাহিদা ব্যাপক বৃদ্ধির সম্ভাবনা, আর তা থেকে মুনাফার সুযোগে ধান মজুত করা শুরু করেছেন চালকল মালিক ও পাইকারী বিক্রেতাদের বড় একটি অংশ। এতে চলতি মৌসুমে সদ্য ওঠা বোরো ধান বিক্রি হচ্ছে গত বছরের চেয়ে চড়া দামে।
করোনাভাইরাসের বৈশ্বিক মহামারি মোকাবিলায় দেশজুড়ে চলতে থাকা সাধারণ ছুটি ও লকডাউন পরিস্থিতিতে খাদ্য সংকটের আশঙ্কায় অতিরিক্ত চাল কিনছেন অনেকে।
আর সাধারণ মানুষের এ ক্রয় প্রবণতাকে পুঁজি করতে চালকল মালিক ও পাইকারী বিক্রেতারা গত বছরের চেয়ে মণপ্রতি ২৫০ থেকে ৪০০ টাকা বেশি দামে বিপুল পরিমাণ বোরো ধান কিনছেন।
ধানের বেশি দাম পেয়ে কৃষক খুশি হলেও, বিশেষজ্ঞদের শঙ্কা চালের খুচরা বাজারে এর বিরূপ প্রভাব পড়বে এবং চলতি পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক উপার্জনবঞ্চিত নিম্নআয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যেতে পারে চালের বাজার।
আর তাই চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারকে আরাও বেশি করে ধান কিনে চালের সরকারি মজুত বাড়ানোর পরামর্শ কৃষি অর্থনীতিবিদদের।
কৃষকরা কী বলছেন?
বোরো চাষ বেশি হয় এমন বেশ কয়েকটি জেলার কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে আমাদের প্রতিনিধিরা জানান, চলতি বছর বোরো ধান মণপ্রতি ৬৫০ থেকে ৮০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। যা গতবছর ছিল গড়ে মণপ্রতি ৫০০ টাকা।
সুনামগঞ্জ জেলার ধর্মপাশা উপজেলার মধ্যনগরের কৃষক রতিরঞ্জন দাশ জানান, গত কয়েক বছরের খারাপ ফলন ও ধানের স্বল্পমূল্যের বাজারের পর এবারের বোরো ধানের ফলন খুব ভালো হয়েছে আর দামও ভালো।
তিনি বলেন, ‘ধানের জাত, মান আর আর্দ্রতাভেদে উপজেলার স্থানীয় বাজারগুলোতে প্রতিমণ ধান ৬৫০ থেকে ৭৮০ পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে’।
ময়মনসিংহে ধানের দাম মণপ্রতি সর্বোচ্চ ৮০০ টাকা পর্যন্ত উঠেছে বলে জানান জেলার চরগোবিন্দপুরের কৃষক আলী আসগর।
উত্তরবঙ্গের জেলা নীলফামারীর সদর উপজেলার দলুয়া দোগাছি গ্রামের কৃষক আব্দুল গণি বলেন, ‘বোরো ধানের প্রকারভেদে এবার দাম মণপ্রতি ৬০০ থেকে ৭০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গতবছর তা বিক্রি হয়েছিল ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা দরে।’
তবে মৌলভীবাজার ও নেত্রকোণার কৃষকেরা এখনো ধানের বেশি দাম পাচ্ছেন না।
মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার ভুকশিমইল গ্রামের কৃষক মোসাব্বির আলী বলেন, ‘জেলার স্থানীয় বাজারগুলোতে বোরো বিক্রি হচ্ছে ৫৫০ থেকে ৬০০ টাকা মণ দরে’।
এদিকে নেত্রকোণার হাওরাঞ্চলের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ধান পরিবহনে বেশি খরচ দেখিয়ে তুলনামূলক কম দামেই পাইকাররা ধান কিনছেন বলে জানিয়েছেন জেলার খালিয়াজুড়ি উপজেলার চাকুয়া এলাকার কৃষক দিলীপ তালুকদার।
সিলেট শহরের কাজিরবাজারের চাল ব্যবসায়ী আবিদুর রহমান কয়েস বলেন, ‘নতুন বোরো ধানের চালের দাম মণপ্রতি ১৪০০ থেকে ১৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে এবং ধানের দাম বাড়ার প্রভাবে চালের দামও দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে।’
গতবছরের তুলনায় এ বছর চালের দাম বেশি বলেও জানান তিনি।
চালকল মালিকরা কী বলছেন?
সুনামগঞ্জ জেলার চালকল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আশরাফুর রহমান চৌধুরী বলেন, ‘চালকল মালিক, পাইকারী ব্যবসায়ী, ফড়িয়া, ছোট ব্যাপারী—যাদের হাতে টাকা আছে, সবাই করোনাভাইরাস মহামারির কারণে চালের চাহিদা বাড়বে ভেবে বেশি মুনাফার আশায় প্রচুর ধান কিনছেন’।
কেবল সুনামগঞ্জ জেলাতেই ছোট-বড় সাড়ে ৪ হাজার চালকলে গড়ে ৫০০ মণ অতিরিক্ত ধান কেনা হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
দেশের অন্যতম বড় চালকল রশীদ গ্রুপের ন্যাশনাল সেলস ম্যানেজার মো. তারেক আনাম বলেন, ‘যদিও এবছর বোরো ধানের বাম্পার ফলন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, তবে সাম্প্রতিক যশোর জেলার কিছু কিছু এলাকায় ধানের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তাছাড়া শ্রমিক সংকটের কারণে ধান কাটাও এখনও শেষ হয়নি অনেক এলাকায়।’
তিনি বলেন, ‘মানবিক কারণে ব্যক্তি ও দলীয় পর্যায়ে ত্রাণ হিসেবে চাল দেয়ার কারণে বাজারে স্বাভাবিক চালের যোগানে ভাটা পড়েছে। এছাড়াও অনেকে খাদ্য সংকটের কথা ভেবে ঘরে চাল মজুত করে রাখছে। এসব কারণে, বিক্রেতারা তাদের মজুত পূর্ণ করছেন।’
বাংলাদেশ অটো মেজর হাসকিং মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক কে এম লায়েক আলী বলেন, ‘চুক্তি অনুযায়ী সরকারি চাল গুদামে চাল সরবরাহের লক্ষ্যেই চালকলগুলো ধান কিনছে’।
এছাড়াও, এ বছর চিকন চালের চাষ গতবছরের তুলনায় কম হয়েছে। যে সব চালকল মিনিকেটের মতো চাল বিপণন করে, তারা সারা বছরের যোগান নিশ্চিত করতে চাল মজুত করছেন।
সরকারি পদক্ষেপ প্রয়োজন
যদিও এ বছর সরকার ৮ লাখ টন ধান, ১০ লাখ টন সিদ্ধ চাল ও দেড় লাখ টন আতপ চাল কিনছে যা গত বছরের দ্বিগুণ, তবুও বিশেষজ্ঞরা সরকারি ধান-চাল কেনার মাত্রা আরো বাড়ানো উচিত বলে মনে করছেন।
সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অর্থনীতি ও পলিসি বিভাগের অধ্যাপক জসিম উদ্দিন আহমদ বলেন, ‘চলতি বছরের সম্ভাব্য ধান উৎপাদনের প্রায় ১০ ভাগ কিনছে সরকার। তবে মহামারির এ সময়ে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে এ মজুত আরো বাড়ানো উচিত’।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যে, এবার দেশের ৪৭ দশমিক ৫৪ লাখ হেক্টর জমিতে বোরো ধান চাষ হয়েছে। যা থেকে ২ দশমিক ০৪ কোটি মেট্রিক টন ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে।
অধ্যাপক জসিম উদ্দিন আহমদ বলেন, ‘সরকার চাইলেই এখন নতুন গুদাম বানাতে পারবে না, তবে অব্যবহৃত ভবন ভাড়া নিয়ে সাময়িকভাবে গুদাম হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। সরকারি গুদামে যত বেশি চালের মজুদ থাকবে, চালের বাজার তত বেশি নিয়ন্ত্রণে থাকবে’।
তবে খাদ্য অধিদপ্তরের সরবরাহ, বন্টন ও বিপণন বিভাগের পরিচালক আমজাদ হোসেন বলেন, ‘করোন পরিস্থিতির কারণে আমরা একটা অনিশ্চিত সময় পার করছি। অনেকেই বেশি মুনাফার আশায় ধান কিনে মজুত করছেন। তবে ভবিষ্যতে কী হবে তা নিয়ে এখনই মন্তব্য করা কঠিন, কারণ সবকিছুই নির্ভর করছে এই পরিস্থিতি কতদিন চলবে তার ওপর’।
[আমাদের নীলফামারী সংবাদদাতা ইএএম আসাদুজ্জামান, ময়মনসিংহ সংবাদদাতা আমিনুল ইসলাম ও মৌলভীবাজার সংবাদদাতা মিন্টু দেশোয়ারা এই প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন]
Comments