জীবন যাপন

‘আর কটা দিন মা’

আমার ছোট মেয়ে সায়ন, বয়স ১০ বছর। প্রতি সকালে জামা প্যান্ট বের করে দেয় অফিসে যাওয়ার জন্য। ২৬ মার্চ থেকে ৯ এপ্রিল একই নিয়ম ছিল। ১০ এপ্রিল সকালে হাতিরপুল বাজার থেকে দেশে তৈরি একটি পিপিই, গ্লাভস্, মাস্ক আর চশমা কিনলাম।
প্রতীকী ছবি

আমার ছোট মেয়ে সায়ন, বয়স ১০ বছর। প্রতি সকালে জামা প্যান্ট বের করে দেয় অফিসে যাওয়ার জন্য। ২৬ মার্চ থেকে ৯ এপ্রিল একই নিয়ম ছিল। ১০ এপ্রিল সকালে হাতিরপুল বাজার থেকে দেশে তৈরি একটি পিপিই, গ্লাভস্, মাস্ক আর চশমা কিনলাম।

মেয়েকে বললাম, প্রতিদিন প্যান্ট জামা বের করতে হবে না।

১১ এপ্রিল প্যান্ট শার্টের উপর পিপিই, চশমা, মাস্ক, গ্লাভস্ পরে অফিসে যাওয়া শুরু করলাম।

মেয়ে দেখে বলল, বাবাকে দেখতে ডাক্তারের মত লাগছে।

এরপর সময় যত গড়াল, নিজের নিরাপত্তা বলয় আরও সুদৃঢ় করলাম। আমি বুঝতে পারছি, প্রতিদিন আমি একটা সংক্রামক বোমা হয়ে বাসায় ঢুকছি। বড় দুই ছেলে তেমন একটা কাছে ভিড়ে না।

বউয়ের এক কথা—‘অফিস নিয়েই থাকো, মরলে তো কেউ দেখবে না, আমাদেরও মারবে।’

কোন কথাই আমার কানে যায় না। কারণ, ২৬ মার্চ থেকে আমার অফিসের সবাইকে ঘরে বসে কাজ করার জন্য নির্দেশনা দিয়েছি। তারা ঘরে বসে অনলাইন অনুষ্ঠান চালাচ্ছে, বিজ্ঞাপনদাতাদের কোনো সাড়া নেই রেডিও বিষয়ে।

২৬ মার্চ থেকে দুই জন অফিস সহকারী আর দুই জন প্রযোজকসহ মোট চার জনকে অফিসে থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। পঞ্চম ব্যক্তি আমি শুধুমাত্র প্রতিদিন অফিসে যাচ্ছি আর আসছি।

এই অবস্থাতেও, করোনাকালীন সময়ে নিয়োজিত সেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিদের কাজ নিয়ে আলোচনা, করোনা সংকটকালীন সময়ের সকল আপডেট এবং করোনা ভাইরাসের চিকিৎসার অগ্রগতি সম্পর্কে আলোচনা, করোনা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি ও ডাক্তারের পরামর্শ বিষয়ক আলোচনা, করোনা সচেতনতামূলক প্রোমো ও প্রয়োজনীয় ফোন নম্বর, প্রতিদিনের অনুরোধের গানসহ ছয়টি অনুষ্ঠান রেডিওতে প্রচারের ব্যবস্থা করেছি। নিয়মিত অনুষ্ঠান বন্ধ করে শুধুমাত্র মানুষ যেন আতঙ্কিত না হয়, একটু সুখবর পায়, তার দিকে নজর আমার। যদি এক জন শ্রোতার মনে করোনা ভয়কে জয় করে ইতিবাচক মনোভাব তৈরি হয়, সেটাই হবে আমার প্রাপ্তি।

আমি করোনাকালীন সময়ের সম্মুখ যোদ্ধা নই। আমি একটা পরোক্ষ শক্তি। যদি সম্মুখ যোদ্ধাদের কথা প্রচার করে সবার মনে শক্তি তৈরি করতে পারি, যদি পারি মনোবল বাড়াতে সেই নিতান্ত ক্ষুদ্র প্রচেষ্ঠা চালিয়ে যাচ্ছি।

কিন্তু এই ভাইরাস তো আমাকেও ছাড় দেবে না। যাওয়া-আসার পথে বা অফিসে কোনো এক অসতর্ক মুহূর্তে ঢুকে যাবে শরীরে। ৫৩ বছরের শরীর কি তৈরি করতে পারবে প্রতিরোধের বলয়!

যদি পারে তবে জয়, না পারলে পরাজয়।

তবুও ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের ডাকের মতোই ২৬ মার্চ ২০২০-এ শপথ নিয়েছি, দেশের মানুষের কল্যাণে কিছু একটা করতে। সেই ব্রতেই আজ আমার সেক্টরে এই যুদ্ধে সহযাত্রী চার জন, আমার অফিস সৈনিক।

সেনাপতি হিসাবে যদি একদিন অফিস কামাই করি, ওরা ভাববে আমি ভয় পেয়েছি। ওদের মনোবল ভেঙে যাবে। হয়তো অটোমেশনে রেডিও স্টেশন চলবে, কিছু গান প্রচার হবে কিন্তু গণমাধ্যম কর্মী হিসেবে আমি আমার দায়িত্বে করব অবহেলা। কোন স্বীকৃতি দরকার নেই — করোনা শত্রু আমাকে আক্রমণ করলে আশীর্বাদ করবেন যেন ১৯৭১-এর ‘ক্র্যাক প্লাটুন’-এর মতো লড়তে পারি।

অফিস থেকে বাসায় গিয়ে সোজা বাথরুমে। পিপিই পরিষ্কার, গোসল শেষ করে এক ঘরে দরজা বন্ধ করে থাকি। মেয়ে বার বার কাছে আসতে চায়, দরজায় টোকা দেয়। খাবার থালা ও গ্লাস আলাদা করেছি।

স্ত্রী বলে, ‘ঢং! ফ্ল্যাটের সবাই অফিস বন্ধ করে বাসায়, উনি দায়িত্ব পালন করেন।’

আমি বলি, ‘এ ডটারস্ টেল-এ রেণুকে দেখনি। রেণুর ত্যাগের কথা ভাবো।’

স্ত্রী কোন কথা না বলে চলে যায়। মৌনতাই সম্মতির লক্ষণ মনে হয়। আমার ঘরের বিছানায় মেয়ে এসে শুতে চায়, জোর করেই তাড়িয়ে দেই।

গত ৫ মে, সায়ন তার মাকে বলে ‘বাবার কী হয়েছে? বাবা এত দূরে দূরে থাকে কেন?’

মেয়ের প্রশ্নের উত্তরে মা বলে, ‘জানি না, দেশ উদ্ধারে নেমেছে।’

মেয়েকে বলতে পারি না, ‘মা, একটা সংকট পার করছি, জিতলে বিজয়ী আর হারলে পরাজিত।’

পরাজিত হওয়ার আগে অফিসের আগামীর সব কাজ ঠিক করতে হবে। যতদিন অসংক্রমিত আছি, হাল ছাড়ব না। শ্রোতার কাছে করোনাকালীন সব তথ্যই পৌঁছে দিতে হবে। মাঝে মাঝে অফিসে থাকা কর্মীদের মুখে ভেসে উঠে। দুই মাস বন্দী হয়ে নিজের সুরক্ষা নিয়ে নিরলস কাজ করে যাওয়ার ছাপ। ক্লান্তি নেই, হয়তো অল্প বয়স বা সংসার নামক মায়াজালের টান নেই বলে।

আগামী ২৬ মার্চ ২০২১, স্বাধীনতার ৫০ বছরে সুবর্ণ জয়ন্তীতে আবার জাগবে বাঙালি জীবন আর জীবিকার টানাপোড়েন হয়তো তখনো থাকবে। তবে আশা—'দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা, কারো দানে পাওয়া নয়’।

জাতি হিসেবে আমরা কারো ধন-সম্পদ লুট করে সাম্রাজ্য তৈরি করি নাই, সৃষ্টিকর্তা তা জানেন। আর তাই আম্পানের মতো দুর্যোগ, করোনার মত মহামারি আমাদের পরাস্ত করতে পারেনি, পারবেও না। ঐতিহাসিক বা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা থেকে নয়, কথাগুলো বললাম শুধুমাত্র বাঙালি জাতিসত্তার বিশ্বাস থেকে।

মেয়ের কাছে বলতে পারি না সব কথা, ও হয়তো বুঝবেও না—'কিন্তু মা, তোমার বাবার প্রজন্ম, তার নিচের প্রজন্ম এবং তারও নিচের প্রজন্ম ভীত হয় না।’

বাঙালি জাতি বীরকে সম্মান দেয়, তাই এ জাতিতে বীর জন্মায়—আবার কীটও জন্মায়। যারা বাড়ি থেকে করোনা রোগী, ডাক্তার, নার্সদের বের করে দেয়, করোনা আক্রান্ত বলে রাস্তায় নিজের মাকে ফেলে রাখে। ওদের সংখ্যা কম, ওরা সংখ্যা লঘিষ্ঠ। সংখ্যা গরিষ্ঠ আমরা, আমরাই জিতব।

‘মা, আর কটা দিন তারপর দেখো, আমিই তোমাকে জড়িয়ে ধরব’

‘কপালে চুমু খাব’

‘আর কটা দিন মা...’

 

শামস সুমন: স্টেশন চীফ, রেডিও ভূমি ৯২.৮ এফএম

Comments

The Daily Star  | English

One month of interim govt: Yunus navigating thru high hopes

A month ago, as Bangladesh teetered on the brink of chaos after the downfall of Sheikh Hasina, Nobel Laureate Muhammad Yunus returned home to steer the nation through political turbulences.

6h ago