পরবর্তী সংকট থেকে বাঁচাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা?
কোভিড-১৯ পরবর্তী সম্ভাব্য বৈশ্বিক মহামারিতে আমাদের রক্ষাকারী হিসেবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে গুরুত্ব দিচ্ছি দুটি কারণে। প্রথমত, সাম্প্রতিক পর্যালোচনা থেকে দেখা গেছে যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যথেষ্ট দ্রুতবেগে উন্নত হচ্ছে। যতটা আগে মনে করা হয়েছিল, তার চেয়েও অনেক দ্রুতবেগে। এটি এখন গাড়ি চালাতে পারে; ব্যবসা, কারিগরি, এমনকি চিকিৎসা বিষয়ে তথ্য বিশ্লেষণ করে জটিল সিদ্ধান্ত দিতে পারে; বিশাল তথ্যভান্ডার ঘেঁটে জরুরি বিষয় উদঘাটন করতে পারে; শিল্পদ্রব্যের ডিজাইন ও উৎপাদন নিজে করতে পারে; এমনকি যেসব কাজকে আমরা সৃজনশীল ও নান্দনিক কাজ বলে জানি, সেগুলোও করতে পারে। জটিল অস্ত্রোপচার কিংবা বৈজ্ঞানিক গবেষণা নিজে করার ক্ষমতা অর্জনের মতো লক্ষ্যও এর ধরাছোঁয়ার মধ্যে আছে। মহামারির সংকট মোকাবিলার জন্য এর অগ্রগতিকে আরও দ্রুত করা সম্ভব এবং তাই করা উচিত।
দ্বিতীয় কারণটি হলো— বিশ্ব নেতাদের অধিকাংশসহ আমরা সবাই কোভিড-১৯’র কাছ থেকে যথেষ্ট শিক্ষা পেয়েছি। এর ভয়াবহ অভিজ্ঞতা আশার সঞ্চার করছে যে হয়তো এবার সারাবিশ্ব ঐক্যবদ্ধভাবে এমন সব উদ্যোগ গ্রহণ করবে যাতে এরকম সংকটের পুনরাবৃত্তি না ঘটে। এর মধ্যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে এ কাজের জন্য গড়ে নেওয়ার উদ্যোগও থাকবে। সংকটের সময় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে ব্যবহার করতে যে বিনিয়োগ প্রয়োজন হবে, তা এবারের কোভিড-১৯ দুর্যোগে নানাভাবে ব্যয়িত অর্থের তুলনায় কিছুই নয়।
আমার বিশ্বাস, যদি আমরা চাই তাহলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে সময়মতো পরবর্তী সংকটের জন্য উপযোগী সক্ষমতায় নিয়ে যেতে পারব। আর একইসঙ্গে এর সমালোচকরা যেসব নেতিবাচক সম্ভাবনা নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকেন, একে বিশ্ব সংস্থার নিয়ন্ত্রণে রাখার মাধ্যমে সে উদ্বেগ নিরসনও করতে পারব। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে উদ্বেগগুলো হলো— এটি সবক্ষেত্রে মানুষের চাকরি কেড়ে নেবে, অত্যন্ত কড়া নজরদারি করে ব্যক্তিগত গোপনীয়তার হানি ঘটাবে, ক্ষমতায় আমাদেরকে ছাড়িয়ে যাবে, এমনকি আমাদেরকে ধ্বংসও করতে পারে।
স্বাভাবিক সময়ে সারা দুনিয়ার সর্বত্র জনস্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সংক্রান্ত যত তথ্য কোনো না কোনোভাবে ডিজিটাল তথ্যভান্ডারে যায়, সেগুলোর সমন্বয়ে গড়ে ওঠা বিশাল তথ্যসম্ভার (বিগডেটা) প্রতি মুহূর্তে বিশ্লেষণ করতে থাকবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। যাতে ভাইরাস-সৃষ্ট মহামারি এড়ানো যায়। যেই মাত্র কোনো জায়গায় একজন মাত্র রোগীর দেহেও কোনো ভাইরাসের নতুন কোনো মিউটেশন সংক্রমিত হওয়ার ইঙ্গিত পাবে, তখনি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তা প্রাসঙ্গিক সবাইকে জানিয়ে দেবে। যাতে রোগীকে সঙ্গে সঙ্গে অন্য মানুষের থেকে বিচ্ছিন্ন করা যায়।
অপেক্ষাকৃত সহজতর ক্ষেত্রে এর সঙ্গে তুলনীয় কাজ করা হয়েছে যখন উত্তর কোরিয়ার বর্তমান একনায়কের বড় ভাইকে বিদেশি এক বিমানবন্দরে হত্যা করার সংবাদটি শতভাগ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় গড়া একটি বার্তাসংস্থা সবার আগে প্রকাশ করতে পেরেছে, যাদের কিনা কোনো মানবকর্মী নেই। শনাক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মিউটেশন হওয়া ভাইরাসটির জেনেটিক বৈশিষ্ট্য নির্ণয় করা ও মানবদেহে তার সম্ভাব্য ধ্বংসাত্মক কাজ নির্ণয় করা ছাড়াও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা রোগীর সংস্পর্শে আসা মানুষগুলোকে খুঁজে বের করতেও সাহায্য করবে, যাতে তাদেরকেও বিচ্ছিন্ন করা যায়। পৃথিবীর নানা দেশে এরকম স্বাস্থ্য-গোয়েন্দাগিরি ধরনের কাজ করা যে মানুষ বিশেষজ্ঞদের জন্য অত্যন্ত কঠিন ও বিপজ্জনক হয়ে থাকে, তা বলাই বাহুল্য।
যদি দুর্ভাগ্যক্রমে আটকাবার এমন জালকে ফাঁকি দিয়ে একটিও ভাইরাস বের হয়ে সংক্রমণের উপক্রম করে, তখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এক দিকে এই মিউটেশনটির টিকা আর ওষুধ তৈরির গবেষণা শুরু করবে (মানব বিজ্ঞানীর তত্ত্বাবধানে), অন্যদিকে সংক্রমণ থেকে প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা নেবে। প্রোগ্রাম করা এমন গবেষণা অনেক দ্রুততর হবে। আর এতে সমান্তরালে বহু বিকল্প একসঙ্গে চলতে পারবে। প্রস্তুতির একটি কাজ হবে সংকটে প্রয়োজন হতে পারে এমন সব জিনিসের স্বাভাবিক মজুদকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার রোবোটিক উৎপাদন ব্যবস্থার মাধ্যমে জোরদার করা। জরুরি খাদ্য, ওষুধ, চিকিৎসা সরঞ্জাম, প্রতিরোধী পোশাক ইত্যাদি এর আওতায় আসবে।
যদি সংকট শুরু হয়েই যায়, সামাজিক সংক্রমণের ফলে লকডাউন যদি অনিবার্য হয়ে পড়ে, প্রতিরক্ষার প্রথম ধাপ সঙ্গে সঙ্গে চালু হয়ে যাবে। রোবট-সেবকরা ওই মজুদ জিনিসগুলো নিয়মিতভাবে পৌঁছে দিতে থাকবে কোয়ারেন্টিনকেন্দ্র, হাসপাতাল, মানুষের ঘরে ঘরে, যেখানে যেটি দরকার। মানুষে মানুষে সংস্পর্শ যেন ন্যূনতম থাকে, সেজন্যই এই ব্যবস্থা। চিকিৎসাক্ষেত্রে এমনি ন্যূনতম মানব-স্পর্শ বজায় রাখতে সাহায্য করবে রোবট চিকিৎসক, নার্স ও কর্মীরা, যারা মানব চিকিৎসক ও নার্সদের সহায়তায় থাকবে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আরও অনেক কাজ করবে। যার মধ্যে থাকবে ভাইরাসটির সর্বশেষ কৃতকর্ম কোথায়, কী অবস্থায় দাঁড়িয়েছে তা দৈনন্দিনভাবে দুনিয়াকে জানিয়ে রাখা, পরের দিনগুলোতে তার সম্ভাব্য গতিপ্রকৃতি কেমন হতে পারে, তা তুলে ধরা এবং মানুষকে সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করা। সময়োচিত এসব পদক্ষেপ ও সময়মতো টিকা এসে যাওয়ার ফলে শিগগির সবাই নিরাপদ হবে আর সবকিছু স্বাভাবিক হবে— এমন আশা করা যায়।
তবে, সবচেয়ে খারাপ অবস্থাটি ধরে নিয়ে যদি মনে করি সব মজুদ ফুরিয়ে এসেছে, অথচ লকডাউন তুলে নেওয়ার মতো অবস্থা এখনো তৈরি হয়নি, তাহলে প্রতিরক্ষার দ্বিতীয় ধাপটি শুরু করা ছাড়া উপায় থাকবে না। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকেই তখন কোনোরকমে অর্থনীতি সচল রাখতে কাজ করতে হবে। এমন চিন্তাকে অনেকে ভয় করেন। কারণ, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা অর্থনীতির দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছে আর সব মানুষ কর্মহীন থেকে তার দানে বেঁচে আছে— এটি তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।
তবে, মনে রাখতে হবে, সময়টি স্বাভাবিক নয়। আর এটি হবে খুব অল্প সময়ের সংকটকালীন অর্থনীতিমাত্র। হয় জীবন, নয় জীবিকা— এমন বেঁছে নেওয়ার ভয়ংকর দায়িত্ব থেকে তো এটি রেহাই দেবে। মানুষ নীতিনির্ধারকদের অধীনে বহুকাজে পারদর্শী রোবটরা বিভিন্ন কম্পিউটার প্রোগ্রামের সাহায্যে বিভিন্ন সামগ্রী উৎপাদন করবে দিনরাত। এমন উৎপাদনকারী কিছু কিছু এখনো আছে। বেশি চালু ও সরল একটি উদাহরণ হলো— থ্রি-ডি প্রিন্টার, যা কম্পিউটারে আঁকা ডিজাইন অনুযায়ী যেকোনো আসবাব, যন্ত্রাংশ ইত্যাদি বার বার তৈরি করতে পারে। এ ধরনের বিশেষ সময়ের উৎপাদনকারীগুলোকে সে রকম বিশেষ সময়ের জন্য সব জায়গায় প্রয়োজন মতো তৈরি রাখা হবে। সংকট কেটে গেলে সক্রিয় মানুষরাই বরাবরের মতো অর্থনীতির চাকা নিজ হাতে তুলে নেবে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো— কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব জাতিসংঘের মতো সংস্থার হাতে থাকতে হবে। জাতিসংঘের চেয়েও কার্যকর নতুন কোনো বিশ্ব সংস্থা হলে আরও ভালো। এটি সর্বত্র সংক্রমণ নজরদারির ব্যবস্থা করবে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রযুক্তিগুলো প্রয়োজন অনুযায়ী নানা দেশ যেন পেতে পারে, সেই ব্যবস্থা করবে, আর এর ব্যবহারের বিশ্বজনীন নীতিগুলো ঠিক করে দেবে। বাকি সব কাজ প্রত্যেক দেশ নিজেই করতে পারবে যার যার বিশেষ পরিস্থিতি অনুযায়ী।
বিশ্ব সংস্থার এমন নিয়ন্ত্রণ ও সম্মিলিত গবেষণা উদ্যোগ অচিন্তনীয় কিছু নয়। হ্যাঁ, এ মুহূর্তে এমন কথা বলার উপায় নেই যে আমাদের বিশ্ব ঐক্যবদ্ধ হওয়ার দিকে এগিয়ে চলেছে। সাম্প্রতিককালে, এমনকি করোনা সংকটের মধ্যেই শক্তিশালী দেশের নেতাদের যে বাকযুদ্ধ চলছে আর শুধু নিজের দেশের স্বার্থকে যেভাবে উচ্চকিত করা হচ্ছে, তাতে তেমন বলতে ভরসা হয় না। তবে, হয়তো নেহাত আত্মবিলুপ্তি এড়াবার তাগিদে ও বাঁচার জন্য বিকল্প কোনো উপায় সামনে দেখা যাচ্ছে না বলে শুভবুদ্ধির উদয় হতেও পারে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে সমৃদ্ধ আমাদের জীবনকে পাইলট আর অটো-পাইলটের সহযোগিতার মাধ্যমে চালানো একটি প্লেনযাত্রার উপমায় দেখা যাক। কেউ হয়তো বলতে পারেন, সংকটের সময় অটো-পাইলটই যখন বিমানকে নিরাপদে চালাতে পারে, তাহলে পাইলটের আবশ্যকতা কী? স্বাভাবিক সময়েও অটো-পাইলট চালালেই পারে। কিন্তু, আমাদের মতে পাইলটকে থাকতে হবে। কারণ, আমরা মানুষরা সেভাবেই পছন্দ করি। মানুষের হাতেই আসল নিয়ন্ত্রণ আমরা রাখতে চাই। অটো-পাইলট অবশ্য স্বাভাবিক সময়েও অন্যরকম কিছু কাজ করে। যেমন: বার বার করতে হয়, এমন বিরক্তিকর কাজগুলো থেকে পাইলটকে রেহাই দেয়, ঝাঁকুনি-কাঁপুনির মতো অস্বস্তিকর অবস্থাকে মসৃণ করে উড়োজাহাজ যাত্রাকে আরও উপভোগ্য করে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাও ঠিক তাই করবে। স্বাভাবিক সময়ে আমাদের জীবনের মানকে আরও উন্নত করতে সাহায্য করবে, অথচ জীবন থেকে কোনো গুণ কেড়ে নেবে না।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কি আমাদেরকে শুধু মহামারির সংকট থেকেই বাঁচাবে? মোটেই নয়। এটি যেকোনো স্থানীয় অথবা বিশ্বময় দুর্যোগে একইভাবে আমাদেরকে বাঁচাতে পারবে। তা ছাড়া, এখনো কল্পনাতেও নেই এমন সব সম্ভাব্য মহাবিপদেও হয়তো এটি দরকার হবে। এ প্রযুক্তিকে যথাযথভাবে খাপ খাইয়ে নিয়ে প্রজ্ঞার সঙ্গে তাকে ব্যবহার করতে পারার ওপরেই তখন নির্ভর করবে হয়তো কোটি কোটি মানুষের জীবন-মরণ। যে আয়তনের একটি উল্কার আঘাত একদিন পৃথিবী থেকে সব ডাইনোসরকে বিলুপ্ত করেছিল, সেরকম আরেকটি যে সামনে কোনোদিন আঘাত হানবেনা এ কথা কে বলতে পারে?
ড. মুহাম্মদ ইব্রাহীম, বিজ্ঞান লেখক এবং অধ্যাপক (অবসরপ্রাপ্ত), পদার্থবিদ্যা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
Comments