খুলনার কয়রা উপজেলা

ঈদের দিনেও বাঁধ রক্ষায় কাজ করেছেন স্থানীয়রা

ঘূর্ণিঝড় আম্পানের আঘাতে বাঁধ ভেঙে গেছে। প্লাবিত হয়েছে খুলনার কয়রা উপজেলার ৮০ ভাগ এলাকা। কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা না নিলে তো নিজেদেরকেই প্লাবনের হাত থেকে এলাকাকে রক্ষা করতে হবে। তাই ঈদের দিনেও ভোর থেকে সাত হাজারের বেশি মানুষ মিলে স্বেচ্ছায় বাঁধ রক্ষার কাজ করেছেন।
ঈদের দিনেও বাঁধ রক্ষায় কাজ করেছেন কয়রা উপজেলার স্থানীয়রা। ছবি: স্টার

ঘূর্ণিঝড় আম্পানের আঘাতে বাঁধ ভেঙে গেছে। প্লাবিত হয়েছে খুলনার কয়রা উপজেলার ৮০ ভাগ এলাকা। কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা না নিলে তো নিজেদেরকেই প্লাবনের হাত থেকে এলাকাকে রক্ষা করতে হবে। তাই ঈদের দিনেও ভোর থেকে সাত হাজারের বেশি মানুষ মিলে স্বেচ্ছায় বাঁধ রক্ষার কাজ করেছেন।

আজ সোমবার ভোর ৫টার দিকে ভাটার টানে নদীতে পানি কমে গেলে উপজেলা চেয়ারম্যান আলহাজ্ব শফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে তারা সেখানে কাজ শুরু করেন। পরে বেলা ১১টার দিকে জোয়ারে পানি আসলে কাজ শেষ হয়।

এরপর নদী ভাঙ্গনের পাড়ে দাঁড়িয়েই তারা ঈদের নামাজ আদায় করেন। পরে উপজেলা চেয়ারম্যান সবাইকে সেমাই ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শিমুল কুমার সাহা খিচুড়ি খাওয়ান।

উপজেলা চেয়ারম্যান আলহাজ্ব শফিকুল ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘পানি উন্নয়ন বোর্ডের পক্ষ থেকে কেউ এখনো আমাদের এখানে আসেনি। তাই গ্রামবাসীরা মিলেই বাঁধ রক্ষার কাজ করছেন।’

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, কয়রা উপজেলার বেড়িবাঁধ মেরামত ও সংস্কার হয় না বছরের পর বছর। ২০০৯ সালের ২৫ মে আইলায় বাঁধ ভেঙে যাওয়ার পর ১০ বছরেও উন্নয়ন হয়নি ১২১ কিলোমিটার দীর্ঘ এই বাঁধের। পানি উন্নয়ন বোর্ড খুলনা ও সাতক্ষীরার মধ্যে সীমানা জটিলতার কারণে দুর্ভোগে এ এলাকার মানুষ। ঘূর্ণিঝড় আম্পানের আঘাতে দ্বিতীয়বারের মতো এই বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয়েছে উপজেলার ৮০ ভাগ এলাকা। আইলার মতো দুঃসহ কষ্টের মধ্যে পড়েছে এ উপজেলার মানুষ।

পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্র জানায়, ২০০৯ সালের ২৫ মে উপকূলীয় অঞ্চল ঘূর্ণিঝড় আইলার আঘাতে লন্ডভন্ড হয়ে যায়। খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরাসহ উপকূলের বিভিন্ন স্থানে ৫৯৭ কিলোমিটার বাঁধ জলোচ্ছ্বাসে ভেসে যায়। এর মধ্যে কয়রা উপজেলার ৬০ কিলোমিটার বাঁধ সম্পূর্ণরূপে বিলীন হয়ে যায়। সে সময় ৩ বছর মানুষ লোনাপানিতে আবদ্ধ থাকে। উপজেলার পাবনা বাঁধ, হারেজখালি, পদ্মপুকুর, শিকারিবাড়ি, পাথরখালি মেরামত হয়। কিন্তু, আইলার ১০ বছর কেটে গেলেও কয়রার ক্ষতিগ্রস্ত ছয়টি ইউনিয়নের কপোতাক্ষ ও শাকবাড়িয়া নদীর পানি উন্নয়ন বোর্ডের ১৩/১৪ ও ১৪/২ পোল্ডারের ৬০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধে পর্যাপ্ত মাটি দেওয়া হয়নি। পাউবো কর্তৃপক্ষ মাটি না দেওয়ায় বাঁধগুলোর দুর্বল অবস্থায় রয়েছে। এরপরও গত ১০ বছরে যে বরাদ্দ হয়েছে, তার সিংহভাগই হয়েছে লুটপাট।

কয়রা উন্নয়ন সংগ্রাম সমিতির সাধারণ সম্পাদক ইমতিয়াজ উদ্দিন অভিযোগ করেন, ২০১৮-১৯ এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরে উপজেলার বেড়িবাঁধ সংস্কারে সাড়ে চার কোটি টাকা বরাদ্দ হয়। এ ছাড়াও, ১৮-১৯ অর্থবছরে সাড়ে তিন কোটি টাকা বরাদ্দ হয়। উন্নয়নকাজ চলমান সময়ে সংশ্লিষ্ট এলাকায় কোনো সাইনবোর্ড প্রদর্শন করা হয়নি। অস্বচ্ছতা ও অনিয়ম করেই সংস্কারকাজ বাস্তবায়ন করা হয়েছে। যে কারণে দুর্বল বাঁধ আর মজবুত হয়নি।

উপজেলার বেড়িবাঁধ নির্মাণ সেনাবাহিনীর মাধ্যমে সম্পন্নের দাবি জানান তিনি।

বাঁধ রক্ষায় কাজ করে সেখানেই ঈদের নামাজ আদায় করেছেন কয়রা উপজেলার স্থানীয়রা। ছবি: স্টার

বেড়িবাঁধের প্রশাসনিক জটিলতার কারণে দেখভালেরও অসুবিধা হয় বলে দাবি করেছেন সংশ্লিষ্টরা। বাঁধের জায়গাটি খুলনার হলেও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ডের। ফলে স্থানীয় এমপি, উপজেলা চেয়ারম্যানরাও ঠিকমতো তদারকি করতে পারেন না কাজের।

এই অভিযোগ স্বীকার করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শিমুল কুমার সাহা। তিনি বলেন, ‘সমন্বয় সভায় আমরা তাদের পাই না। যেহেতু তারা অন্য জেলার, তাদের সমন্বয় সভাতেও আমরা থাকি না। ফলে সমস্যা, সম্ভাবনা ও সমাধান নিয়ে আমরা কারও সঙ্গে আলোচনাও করতে পারি না।’

খুলনার কয়রা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান জিএম মহসিন রেজা বলেন, ‘যখনই বেড়িবাঁধ নির্মাণের কাজ হয়েছে, তখন মূল ঠিকাদারকে কখনও এলাকায় দেখা যায়নি। তিনি কাজ পাওয়ার পর নির্দিষ্ট কমিশনে কাজটি অন্য ঠিকাদারের কাছে বিক্রি করে দেন। ওই ঠিকাদার আবার তার কমিশন রেখে কাজটি ছোট ছোট অংশে ভাগ করে অন্য ঠিকাদারদের হাতে দেন। এই হাত বদলের পর মাঠ পর্যায়ে ৪০-৪৫ ভাগ বরাদ্দ পাওয়া যায়। এর সঙ্গে পানি উন্নয়ন বোর্ডের লোকজনও জড়িত থাকে।’

তিনি বলেন, ‘প্রশাসনিক জটিলতার কারণে পাউবোর প্রকৌশলীদের নির্দিষ্ট সময়ে এলাকায় পাওয়া যায় না। সাতক্ষীরায় পাউবোর অফিস হওয়ার কারণে তারাও আমাদের কথা শোনে না।’

খুলনা-৬ আসনের এমপি আক্তারুজ্জামান বাবু বলেন, ‘আইলার থেকেও এবার বেশি ক্ষতি হয়েছে কয়রা উপজেলাবাসীর। বেড়িবাঁধ চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেছে। স্থানীয় মানুষ স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে কাজ শুরু করেছেন। সেনাবাহিনীর সদস্যরাও এসেছে বাঁধ নির্মাণে সহায়তার জন্য। মানুষের ক্ষতি টাকার অংকে হিসাব করা সম্ভব নয়।’

‘এর আগে যারা তদারকি করেছে, সে সময় ঠিকভাবে দেখভাল হয়নি। ফলে এ দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে’, বলেন তিনি।

আম্পানের আঘাতে অন্তত ৩০ কিলোমিটার বাঁধ ভেঙে লোকালয় তলিয়ে গেছে। দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নে শাকবাড়িয়া নদীর আংটিহারা মজিদ গাজীর বাড়ির পাশে, জোড়শিং বাজারের পাশে, কপোতাক্ষ নদের চোরামুখা খেয়াঘাটের কাছে, গোলখালী তসলিম মোল্লার বাড়ির পাশে, উত্তর বেদকাশি ইউনিয়নের কপোতাক্ষ নদের গাজীপাড়া গ্রামে, কাটকাটা বাজারের শাকবাড়ীয়া নদীর তীল, মহারাজপুর ইউনিয়নের দশালিয়া গ্রামে কপোতাক্ষ নদী, কয়রা সদর ইউনিয়নের হরিণখোলা ও গোবরা ঘাটাখালি গ্রামে কপোতাক্ষ নদের আধা কিলোমিটার এলাকা ভেঙে তলিয়ে গেছে। যে কারণে এখন স্থানীয় মানুষরাই স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে বেড়ি বাঁধ নির্মাণে কাজ করছে।

জানতে চাইলে খুলনা পানি উন্নয়ন বোর্ড সাতক্ষীরা-২’র নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুজ্জামান বলেন, ‘কয়রায় ৩০ কিলোমিটার বাঁধ ধ্বংস হয়েছে। মানুষ স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে কাজ শুরু করেছে।’

‘বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম’র বিষয়ে তিনি বলেন, ‘কোনো ধরনের অনিয়ম হয়নি। ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের ফলে বাঁধ ভেঙেছে।’ এ ছাড়া, কয়রায় বাঁধ মেরামতেও প্রশাসনিক কোনো জটিলতা নেই বলেও দাবি করেন তিনি।

Comments

The Daily Star  | English

Banks to freeze accounts of Orion Group chairman, MD, four others

The Bangladesh Financial Intelligence Unit (BFIU) has instructed banks in the country to freeze any accounts owned by Orion Group Chairman Obaidul Karim and its Managing Director Salman Obaidul Karim.

5h ago