ইতালিতে বৈধতার সুযোগ: ভাগ্য বদলাতে পারে ৭ লাখ অবৈধ অভিবাসীর
কোভিড-১৯ মহামারিতে বিপর্যস্ত ইউরোপের দেশ ইতালিতে বসবাসরত অবৈধ অভিবাসীদের বৈধতা দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আগামী ১ জুন থেকে আবেদন গ্রহণ শুরু হবে। যা চলবে ১৫ জুলাই পর্যন্ত।
কৃষি ও গৃহকাজের বিনিময়ে বৈধতা দেওয়া হবে। এর আগে যারা ইতালির ‘স্টে পারমিট’ বা ‘পেরমেচ্ছো দ্য সোজর্ন’ নবায়ন করতে পারেননি বা যারা রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়ে ব্যর্থ হয়েছেন, তারাও এই আইনের আওতায় নতুনভাবে সাধারণ স্টে পারমিটের জন্য আবেদন করতে পারবেন।
গত ২০ মে প্রকাশিত গেজেটে বলা হয়েছে, কৃষি ও গৃহ- এই দুই ধরনের কাজে নিয়োজিত শ্রমিকরা বৈধতার জন্য আবেদন করতে পারবেন।
কৃষিকাজের আওতায় পড়বে, খেত-খামার বা বাগান পরিচর্যা, গবাদি পশু পালন বা এই সংশ্লিষ্ট কাজ, মাছ ধরা বা প্রক্রিয়াজাত করা, কৃষি সরঞ্জাম ও কীটনাশক তৈরি বা সরবরাহের কাজ এবং সবজি, ফল, ফসল প্রক্রিয়াজাত করা।
গৃহকাজের আওতায় পড়বে, শিশু লালন-পালন, বয়স্কদের সেবা, প্রতিবন্ধীদের দেখভালসহ অন্যান্য গৃহকর্ম।
কৃষি ও গৃহকাজের বাইরে যেসব অভিবাসীরা অতীতে বৈধ ছিলেন, অর্থাৎ যাদের স্বল্পমেয়াদি স্টে পারমিট ছিল, কিন্তু নবায়ন করতে পারেননি, তারাও নতুন করে স্টে পারমিটের জন্য আবেদন করতে পারবেন।
এ ছাড়া, যারা রাজনৈতিক আশ্রয় পেয়েছেন বা আবেদন করেছেন, যাদের শিক্ষার জন্য স্টে পারমিট, মানবিক কারণে স্টে পারমিট বা মৌসুমি কাজের জন্য স্বল্পমেয়াদি স্টে পারমিট আছে, তারাও সাধারণ স্টে পারমিটের জন্য আবেদন করতে পারবেন।
কৃষি ও গৃহশ্রমিক হিসেবে বৈধতার জন্য আবেদন করতে হলে অবশ্যই একজন মালিকের অধীনে আবেদন করতে হবে। এক্ষেত্রে ওই মালিক সরকারি তহবিলে পাঁচশ ইউরো জমা দিয়ে তার অধীনে কাজ করা শ্রমিকের বৈধতার জন্য আবেদন করবেন।
যাদের অতীতে স্বল্পমেয়াদী স্টে পারমিট ছিল, তারা সরকারের তহবিলে ১৩০ ইউরো জমা দিয়ে নতুন করে আবেদন করতে পারবেন।
কৃষি ও গৃহশ্রমিক হিসেবে কারা আবেদন করতে পারবেন?
কৃষি ও গৃহশ্রমিক হিসেবে আবেদন করার ক্ষেত্রে শ্রমিককে প্রমাণ করতে হবে যে, তিনি ২০২০ সালের ৮ মার্চের আগে ইতালিতে প্রবেশ করেছেন। অর্থাৎ ৮ মার্চের পরে যারা ইতালিতে প্রবেশ করেছেন বা করছেন, তারা এই আইনের আওতায় পড়বেন না। তারা বৈধতার জন্য আবেদন করতে পারবেন না।
একইভাবে অতীতে যাদের স্বল্পমেয়াদি স্টে পারমিট ছিল, কিন্তু বিভিন্ন কারণে অবৈধ হয়ে পড়েছেন, তাদের মধ্যে থেকে যাদের স্টে পারমিট ২০১৯ সালের ৩১ অক্টোবরের আগে মেয়াদোত্তীর্ণ বা বাতিল হয়েছে, শুধু তারা নতুন স্টে পারমিটের জন্য আবেদন করতে পারবেন। অর্থাৎ ২০১৯ সালের ৩১ অক্টোবরের পরে যারা স্টে পারমিট হারিয়েছেন তারা এই আইনের আওতায় পড়বেন না। তাদের আবেদন গ্রহণযোগ্য হবে না।
অতীতে যাদের ডকুমেন্ট ছিল তাদের কী ধরনের ডকুমেন্ট দেওয়া হবে?
২০১৯ সালের ৩১ অক্টোবরের আগে যাদের স্টে পারমিট বাতিল হয়েছে, তাদের প্রাথমিকভাবে ছয় মাসের জন্য স্টে পারমিট দেওয়া হবে। এই সময়ের মধ্যে তারা যে কোনও একটি চাকরি খুঁজে নিতে পারলে আবার তাদের স্টে পারমিট নবায়ন করা হবে এবং দুই বছর মেয়াদি সাধারণ স্টে পারমিট দেওয়া হবে।
কারা কাজের মালিক হতে পারবেন?
ইতালীয় নাগরিক, ইতালিতে বসবাসকারী ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশের নাগরিক এবং কমপক্ষে পাঁচ বছর মেয়াদি স্টে পারমিট বা স্থায়ী স্টে পারমিটধারী অভিবাসীরা কাজের মালিক হতে পারবেন। তবে, এসব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের আয়-ব্যয়ের হিসাব ও নিয়মিত ট্যাক্স প্রদানের কাগজপত্র থাকতে হবে।
যারা গৃহকাজের জন্য শ্রমিক রাখবে, তাদের বার্ষিক আয় কমপক্ষে ১৮ থেকে ২০ হাজার ইউরো হতে হবে। অর্থাৎ গৃহকর্মী রাখার মতো আর্থিক সঙ্গতি থাকতে হবে।
কারা কাজের মালিক হতে পারবে না?
ফৌজদারি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত কোনো মালিকের আবেদন গ্রহণযোগ্য হবে না। বিশেষ করে যারা অবৈধ অভিবাসী ব্যবসা, যৌন ব্যবসা ও মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত এবং নিম্ন আদালত কর্তৃক সাজাপ্রাপ্ত, তারা কাজের মালিক হিসেবে গ্রহণযোগ্য হবেন না।
স্থানীয় ইম্পস ও প্রেফেত্তুরা অফিসের অনলাইন ফরম পূরণের মাধ্যমে আবেদন করতে হবে। আবেদনের পর যতদিন স্টে পারমিট হাতে না আসবে, ততদিন চাকরির কন্ট্রাক্ট বহাল ও নিয়মিত ট্যাক্স প্রদান করতে হবে। অন্যথায় আবেদন বাতিল বলে গণ্য হতে পারে।
ঘোষিত গেজেট বা আইনটি ইতালির চারটি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে পরিবর্তন, পরিবর্ধন হতে পারে। চার মন্ত্রণালয় হলো— স্বরাষ্ট্র, আইন, অর্থ ও শ্রম মন্ত্রণালয়।
দীর্ঘ আট বছর পর ২০২০ সালে করোনা সংকটের মধ্যে ইতালিতে বসবাসরত অবৈধ অভিবাসীদের জন্য বৈধতার ঘোষণা দেওয়া হলো। এর আগে ২০১২ সালে প্রায় অভিন্ন শর্তে অবৈধ অভিবাসীদের বৈধতা দেওয়া হয়েছিল। এবারের বৈধকরণ আইন তৈরির পেছনে সবচেয়ে জোরালো ভূমিকা পালন করেছেন ইতালির কৃষিমন্ত্রী তেরেসা বেল্লানোভা। অবৈধ অভিবাসীদের বৈধ করা না হলে মন্ত্রী পরিষদ থেকে পদত্যাগ করবেন বলে হুঁশিয়ারিও দিয়েছেন বেল্লানোভা।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, ২০২০ সালের ৮ মার্চের আগে ইতালিতে প্রবেশ করা অবৈধ অভিবাসীর সংখ্যা প্রায় সাত লাখ। এবারের বৈধকরণ ঘোষণায় অবৈধ অভিবাসীদের মধ্যে খুশির আমেজ সৃষ্টি হলেও অনেকের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ দেখা গেছে। যারা অভিবাসীদের অধিকার, শ্রমিকদের অধিকার ও মানবাধিকার নিয়ে কাজ করেন, তারা সরকারের এ ঘোষণাকে স্বাগত জানালেও অনেকেই ঘোষিত আইনের কড়া সমালোচনা করেছেন। তারা গেজেটের ১০৩ নম্বর ধারা সংশোধনের দাবিও তুলেছেন। কোনো কোনো সংগঠন সরকারকে চাপে রাখতে আন্দোলনেরও হুমকি দিয়েছে।
এসব নিয়ে কথা হয় সরকারি দল পিডি’র (পার্তিতো দেমোক্রেতিকো) ব্রেশা মহানগর শাখার নেতা ও এফএবিআই’র (২২ দেশের অভিবাসী সংগঠনের জোট) ভাইস প্রেসিডেন্ট কাউসার জামানের সঙ্গে।
কৃষি ও গৃহকাজের বিনিময়ে বৈধতা দেওয়ার ঘোষণার সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘প্রতি বছর ইতালিতে কৃষিকাজ করার জন্য বিভিন্ন দেশ থেকে প্রায় দেড় লাখ মৌসুমি শ্রমিক আনা হয়। এ বছর কোভিড-১৯ এর কারণে শ্রমিক আনা সম্ভব হয়নি। কৃষিক্ষেত্রে ব্যাপক শ্রমিক সংকট তৈরি হয়েছে। সরকার মূলত এই সংকট কাটানোর জন্য কৃষি ও গৃহকাজে বৈধতার ঘোষণা দিয়েছে।’
ইতালীয় জোট সরকারের ঘোষিত বৈধকরণ আইনকে ‘স্ববিরোধী ও স্বার্থপর আইন’ হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এতদিন সরকারের দায়িত্বশীল মন্ত্রীরা বৈধতার ইস্যুতে মানবতার কথা, নৈতিকতার কথা বলে এসেছেন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে শুধু কৃষি ও গৃহকাজের বিনিময়ে বৈধতার ঘোষণা দিয়ে সরকার স্ববিরোধী ও চরম স্বার্থপর রূপ প্রকাশ করেছে।’
‘এই ঘোষণায় কোনো মানবতা বা নৈতিকতা নেই। এর পুরাটাই স্বার্থ উদ্ধারের চেষ্টায় পূর্ণ’, বলেন তিনি।
সরকারি তহবিলে পাঁচশ ইউরো জমা দেওয়ার বিষয়ে কাউসার জামান বলেন, ‘আমরা মনে করি, এই আইনের কিছু কিছু অংশ মানবতাবিরোধী। অনেক মালিক পাঁচশ ইউরো সরকারি তহবিলে জমা দিয়ে শ্রমিককে বৈধ করার আবেদন করতে রাজি হবে না। এতে দালালচক্র সুবিধা পাবে। তারা বিভিন্ন কৌশলে অভিবাসীদের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার ও হয়রানি করার চেষ্টা করবে।’
‘শুধুমাত্র কৃষি ও গৃহকাজের বিনিময়ে বৈধতা দেওয়ার ঘোষণায় অধিকাংশ অনিয়মিত অভিবাসী নিয়মিত হতে পারবে না। এতে সামাজিক অপরাধ ও বৈষম্য বাড়বে, আইন-শৃঙ্খলার অবনতি হবে। যা সরকারের নীতিনির্ধারকদের ভাবা দরকার ছিল’, বলেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘ঘোষিত আইন সংশোধন করে সব ধরনের কাজের বিনিময়ে বৈধতা দিতে হবে। পাঁচশ ইউরো, একশ ত্রিশ ইউরোর জায়গায় শুধুমাত্র সার্ভিস চার্জের বিনিময়ে বৈধতা দিতে হবে। সেটাই যুক্তিসঙ্গত হবে। এতে ইতালির মানবিক রূপ রক্ষা হবে।’
‘মানবাধিকার সংগঠন, শ্রমিক সংগঠন ও অভিবাসী সংগঠনগুলোর সঙ্গে আলোচনা চলছে। প্রাথমিকভাবে আমরা অনলাইন মিটিংয়ের মাধ্যমে সরকারের কাছে দাবি জানাব। প্রয়োজন হলে রাজপথে আন্দোলন করা হবে’, যোগ করেন তিনি।
বাংলাদেশি অভিবাসীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘কোনো দালাল চক্রের ফাঁদে পা দেবেন না। বাংলাদেশি কমিউনিটিভিত্তিক কিছু দালাল আছে, যারা আপনাকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করবে। বিজ্ঞ মানুষের মুখোশ পরে, নেতার আলখাল্লা গায়ে দিয়ে আপনাকে ভুল তথ্য দেবে। অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করবে। এদের চিহ্নিত করুন এবং এড়িয়ে চলুন।’
‘যে কোনো প্রয়োজনে আপনার শহরের শ্রমিক ইউনিয়নগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করুন। তাদের অভিবাসী ডেস্কে আপনার সমস্যার কথা খুলে বলুন এবং যে মালিকের অধীনে কাজ করছেন, তার কাগজপত্র সঠিক কি না, তা যাচাই করে নিন’, বলেন তিনি।
Comments