আম্পানের ৭ দিন পরও সাতক্ষীরায় প্লাবিত হচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম
সুপার সাইক্লোন ‘আম্পান’ আঘাত হানার পর সাত দিন কেটে গেলেও সাতক্ষীরা জেলার দুই উপজেলার প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ লবণপানিতে বন্দি জীবন কাটাচ্ছেন।
তার ওপর গত মঙ্গলবার রাতে থেকে বৃষ্টি ও সাগরে নিম্নচাপ উপকূলবাসীর কষ্ট আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
স্থানীয় জনগণ স্বেচ্ছাশ্রমে ভাটার সময় মেরামত কাজ করলেও রিং বাঁধ নির্মাণ করতে পারেনি। স্থানীয় ও জনপ্রতিনিধিদের অভিযোগ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) অবহেলা, গাফিলতির কারণে তাদের এই দুভোর্গ।
পরিবেশ উন্নয়ন কর্মীদের মতে, পাউবোর বাঁধে পাইপ দিয়ে চিংড়ি চাষে লবণপানি প্রবেশ করাতে গিয়ে বেড়িবাঁধ দুর্বল হয়ে গেছে।
গত ২০ মে সন্ধ্যায় বাংলাদেশ সীমনায় সাতক্ষীরার শ্যামনগর ও আশাশুনি উপজেলা এবং খুলনার কয়রা উপজেলায় ‘আম্পান’ প্রথম আঘাত হানে। সেসময় চুনি, খোলপেটুয়া ও কপোতাক্ষ নদীতে ভাটা থাকায় মূলত জলোচ্ছ্বাস হয়নি। কিন্তু বাঁধ দুর্বল থাকায় কোথাও কোথাও বাঁধ উপচে পানি প্রবেশ করে।
গতকাল বুধবার শ্যামনগর বুড়িগোয়ানী ও কাশিমাড়ী এলাকায় সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায় জোয়ারে লবণপানি প্রবল বেগে প্রবেশ করছে। কাশিমাড়ী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এস এম এ রউফ ও বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ভবতোষ মন্ডল আশেপাশের মানুষকে নিয়ে বিকল্প রিং বাঁধ দিয়ে লবণপানি প্রবেশ বন্ধের চেষ্টা করতে দেখা যায়।
কিন্তু, আম্পানের পর সেই চেষ্টা সফল হয়নি। বাঁধের যেসব জায়গা ভেঙে গেছে সেখানে পানি ১৫ থেকে ২০ কিলোমিটার ভেতর পর্যন্ত লোকালয়ে চলে গেছে।
বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ভবতোষ মন্ডল বলেন, ‘পূর্ব দুর্গাবাটির একস্থানে ও দাতিনাখালির তিন স্থানে বাঁধ ভেঙে দাতিনাখালি, ভামিয়া, পোড়াকাটলা, বুড়িগোয়ালিনি, কলাবাড়ি, পূর্ব দুর্গাবাটি, টুঙ্গিপাড়াসহ আটটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ভাঙ্গন কবলিত এলাকায় পানি ঢোকায় অন্তত দুই হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। পাশাপাশি তিন শতাধিক চিংড়ির ঘের ভেসে গেছে।
শ্যামনগর উপজেলা দেশের একেবারে দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত। এর দক্ষিণে সুন্দরবন। পশ্চিমে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের দক্ষিণচব্বিশ পরগণা জেলা। শ্যামনগর উপজেলার একটি ইউনিয়ন কাশিমারি। এই ইউনিয়নের গ্রামগুলো হচ্ছে কাশিমারি, ঝাপালি, জয়নগর, ঘোলা, গোবিন্দপুর, শঙ্করকাঠি, খাজুরাটি, খুটিকাটা ও গাঙমারি। এই গ্রামগুলোতে এখনও জোয়ারের পানি থৈথৈ করছে।
ঘূর্ণিঝড় আম্পানের দাপটে বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় এখানকার নয়টি গ্রামের মানুষ পানিবন্দি।
কাশিমারি ইউনিয়নের নয়টি গ্রামে ৫০ হাজারের বেশি মানুষ বসবাস করেন। তাদের মধ্যে ৪০ হাজার খুবই খারাপ অবস্থায় আছে বলে জানিয়েছেন এর চেয়ারম্যান এস এম এ রউফ।
গত পরশু তাকে দেখা যায় কয়েক হাজার মানুষ নিয়ে বাঁধ তদারাকি করছেন। বাঁধের ওপর দাঁড়িয়ে তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘এই ভাঙন আটকানো না গেলে ৫০ হাজারেরও বেশি মানুষ অশেষ দুর্গতির মধ্যে পড়বে।’
তিনি প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, ‘আমরা ত্রাণ চাই না, আমরা স্থায়ী বাঁধ চাই। স্থায়ীভাবে বাঁধ দিতে হবে। তা না হলে এই জনপদ থাকবে না। এখানকার উন্নয়ন ভেসে যাবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমার মেয়াদকালে কয়েক শ কোটি টাকার উন্নয়ন কাজ করেছি। রাস্তাঘাট, অবকাঠামো উন্নয়নের যেসব কাজ হয়েছিল, তাতো সবই ভেসে গেছে। কী হবে এত এত উন্নয়ন কাজ করে? উন্নয়ন টিকিয়ে রাখতে হলে এখানে আগে শক্ত ও মজবুত বাঁধ দিতে হবে।’
সাতক্ষীরা সমিতির সভাপতি ও ফ্রোজন ফুড এক্সপোর্টার এসোসিয়েশনের পরিচালক খলিলউল্লাহ ঝড়ু বলেন, ‘আমি এই এলাকায় কাজ করছি চিংড়ি ও কাঁকড়া চাষিদের বাঁচানোর জন্য।’
অক্ষত বেড়িবাঁধগুলোতে দেখা যায় বাঁধের ভেতর পাইপ দিয়ে নদীর সঙ্গে ঘেরের সংযোগ করে লবণপানি প্রবেশ করানো হচ্ছে। ফলে বাঁধ দুর্বল হয়ে যায়।
সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ডের ১ ও ২ অফিস সূত্রে জানা গেছে, শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ইউনিয়নের নাপিতখালি, জেলেখালি, পদ্মপুকুর ইউনিয়নের কামালকাটি, ঝাপা ও চাউলখোলা, মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের কদমতলা, রমজাননগর ইউনিয়নের গোলাখালী, কাশিমারি ইউনিয়নের ঝাপালি, বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের দাতিনাখালি, পূর্ব দূর্গাবাটি, কালীগঞ্জ উপজেলার মধুরেশপুর ইউনিয়নের চিংড়ি, ভাড়াশিমুলিয়া ইউনিয়নের খায়েরঘাট, আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর ইউনিয়নের চাকলা, কুড়িকাউনিয়া, সুভদ্রকাটি, ঘিলারআইট, হিজলিয়া, হরিশখালী, আশাশুনি সদরে দোয়ারঘাট, শ্রীউল্যা ইউনিয়নের হাজরাখালী, ও সাতক্ষীরা সদর ইউনিয়নের শাকদাহের পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে গেছে।
সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ডের বিভাগ-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী আবুল খায়ের ও বিভাগ-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী ২০ থেকে ২৫ স্থানে বাঁধ ভেঙে গেছে। জরুরিভিত্তিতে বাঁধ মেরামতের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক এস এম মোস্তফা কামাল ডেইলি স্টারকে জানিয়েছেন, জেলার ২৩টি স্থানে ৫৭ কিলোমিটার বাঁধ ভেঙে লোকালয় পানি প্রবেশ করেছে।
Comments