‘বিশ্বাস করতে পারছি না আমি বেঁচে আছি’

তরিকুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

লিবিয়ার মরুভূমি শহর মিজদায় ২৬ বাংলাদেশিসহ ৩০ জন অভিবাসীকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে গত বুধবার। মানব পাচারকারীদের হাতে হওয়া এই নির্মম হত্যাকাণ্ড থেকে অলৌকিকভাবে যারা প্রাণে বেঁচে যান তাদের মধ্যে একজন তরিকুল ইসলাম।

গতকাল রোববার তরিকুল মোবাইলে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘যখন গুলি শুরু হলো, আমি দেখলাম আমার চারপাশের সবাই একের পর এক মাটিতে লুটিয়ে পড়ছে। প্রচুর চিৎকার আর গুলির শব্দের মধ্যে মনে হলো আমার হাতে কিছু এসে লাগল। আমি প্রচণ্ড ব্যথায় রক্তের স্রোতের মধ্যে পড়ে যাই। একসময় আমি জ্ঞান হারাই এবং জ্ঞান ফিরে নিজেকে দেখতে পাই একটি হাসপাতালের বিছানায়।’

অঝোরে কান্না শুরু করার আগে তিনি আরও বলেন, ‘বিশ্বাস করতে পারছি না আমি বেঁচে আছি।’

ভাগ্য বদলাতে দালালের মাধ্যমে লিবিয়া যাওয়া মাগুরার ২২ বছর বয়সী এই তরুণ মুক্তিপণ আদায়কারীদের শিকার হন। তিনি যখন মিজদা গণহত্যার বিবরণ দিচ্ছিলেন তখন তিনি ত্রিপোলি মেডিকেল সেন্টারের একটি বিছানায় শুয়ে আছেন।

তিনি জানান, বুধবার আছরের নামাজের পরে পাচারকারীদের গ্যাং লিডারকে হত্যা করার অভিযোগে গ্যাংয়ের সদস্যরা জিম্মিদের ওপর চড়াও হয়।

‘পাচারকারীরা যখন আরও টাকা দাবি করে তখন তাদের সঙ্গে জিম্মিদের বাকবিতণ্ডা হয়। এর এক পর্যায়ে গ্যাং লিডারকে হত্যা করা হলে অন্য সদস্যরা এসে উপস্থিত হয়।’

‘তারা প্রায় ২৫০ জন ছিল। গুলি করার আগে তারা আমাদের ঘর থেকে (চোরাচালান গুদাম) টেনে বের কররে এনেছিল। তাদের মধ্যে অন্তত ১১ জন বিভিন্ন ধরণের অস্ত্র দিয়ে গুলি চালায়।’

তিনি জানান, গুলির আঘাত কষ্টের। কিন্তু, তার আগের নির্যাতন আরও বেশি কষ্টের ছিল।

তরিকুল বলেন, ‘আমি চিৎ হয়ে ঘুমাতে পারছি না। তারা আমার হাতে দড়ি বেধে ঝুলিয়ে রেখেছিল। প্রতিদিন টাকার জন্য প্লাস্টিকের কিছু একটা দিয়ে আমাকে মারত। আমার সঙ্গে আরও প্রায় পঞ্চাশ জন ছিল এবং তাদের সবাইকেই টাকার জন্য নির্যাতন করা হয়েছে।’

‘তারা আমাদের প্রত্যেকের কাছ থেকে ১২ হাজার ডলার দাবি করেছিল। তারা বলছিল, “টাকা দেবে না হয় মরবে”। আমি গরীব ঘরের ছেলে। আমার পরিবারের পক্ষে তাদের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব ছিল না।’

কথা বলার সময় মাগুরার এই তরুণ বারবার বলছিলেন, ‘আমি বাড়ি যেতে চাই। আমাকে সাহায্য করুন স্যার।’

তরিকুলের বাবা ফুল মিয়া মোল্লা এবং মা আয়েশা বেগম বিনোদপুর উপজেলার নারায়ণপুরে তাদের একমাত্র ছেলের নিরাপদে দেশে ফেরার অপেক্ষায় আছেন।

তরিকুলের মা আয়েশা বেগমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি আমার ছেলেকে ফেরত চাই।’

জানতে চাইলে আয়েশা বেগম বলেন, তারা দুটি গরু ১ লাখ ২০ হাজার টাকায় বিক্রি করে এবং ব্যাংক ও প্রতিবেশীদের কাছ থেকে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে ছেলেকে বিদেশে পাঠিয়েছিল।

আয়েশা জানান, তরিকুল প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে তার বাবার সঙ্গে কৃষি কাজ করতেন।

ছেলেকে ফেরাতে সরকারের সাহায্য চেয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা খুবই গরীব। এখন তো সবকিছুই হারালাম।’

বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই লিবিয়াতে কেউ মূল গন্তব্য হিসেবে যায় না। মূলত ইতালি বা ইউরোপের অন্য কোনো দেশে ঢোকার জন্য লিবিয়াকে ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

ইউএনএইচসিআর জানিয়েছে, ২০১৪ সাল থেকে বিভিন্ন এশিয় ও আফ্রিকান দেশ থেকে প্রায় ২০ লাখ অবৈধ অভিবাসী ভূমধ্যসাগর হয়ে ইউরোপে প্রবেশ করেছে।

তারা অবৈধ হওয়ায় পাচারকারীদের প্রধান লক্ষ্যে পরিণত হয়।

তারিকুল জানান, তিনি যখন বাংলাদেশ ছেড়ে যান তখন তার পরিবার সাড়ে ৩ লাখ টাকা এবং পরে আরও এক লাখ টাকা দিয়েছিল। পরবর্তীতে পাচারকারী এবং দালালরা আরও টাকার দাবি করে।

২০১৯ সালের নভেম্বরে তিনি এক দালালের সঙ্গে বাংলাদেশ ছেড়ে যান।

প্রথমে তাকে নেপালে নেওয়া হয়। সেখান থেকে যান দুবাই। তারা দুবাইতে তিন দিন থাকার পর যান মিশরে। মিশর থেকে বিমানে যান লিবিয়ার বেনগাজিতে।

তারা ছয় মাস বেনগাজিতে থাকার পর যখন তিনি এবং প্রায় আরও ৫০ জন ত্রিপোলির উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন, তখন তাদের একটি গ্যাংয়ের হাতে তুলে দেওয়া হয়। এই গ্যাং তাদেরকে লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপোলি থেকে ১৮০ কিলোমিটার দূরে মিজদা শহরে একটি গুদামে নিয়ে যায়।

এই হত্যাকাণ্ড লিবিয়ার অভিবাসীরা কতটা বিপদের মুখোমুখি তা ফুটিয়ে তুলেছে। দেশটিতে সহিংসতা ও বিচারহীনতার কারণে পাচারকারীদের জন্য স্বর্গরাজ্য হয়ে উঠেছে।

এই গণহত্যায় নিহত ২৬ বাংলাদেশি অভিবাসীকে মিজদাতে দাফন করা হয়েছে। কেননা, লিবিয়ার কর্তৃপক্ষের আশঙ্কায় ছিল, স্থানীয় সন্ত্রাসীরা ত্রিপোলিতে নেওয়ার মরদেহগুলো ছিনিয়ে নিতে পারে।

হামলায় আহত ১১ জন বাংলাদেশিকে ত্রিপোলির একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে যেখানে তাদের চিকিৎসা চলছে।

Comments

The Daily Star  | English
US attack on Iran nuclear sites

Iran denounces US attack as ‘outrageous’

Iran says 'no signs of contamination' after US attacks on key nuclear sites

7h ago