ফ্লয়েডের জন্যে সোচ্চার, আমার বাবা সাংবাদিক কাজলের জন্যে?

মার্কিন পুলিশের বর্বরতার প্রতিবাদে গোটা যুক্তরাষ্ট্র প্রতিবাদের আগুনে উত্তাল। বেশিরভাগ ছোট বড় শহরে সান্ধ্যকালীন কারফিউ দিয়ে আন্দোলনকারীদের দমন-নিপীড়নের দ্বিতীয় সপ্তাহ চলছে। তারপরও আন্দোলন তুঙ্গে। বড় শহরগুলোতে প্রতিবাদকারীরা অহরহ কারফিউ ভাঙছে। মার্কিন পুলিশ এবং ন্যাশনাল গার্ড একসঙ্গে প্রতিবাদকারীদের ওপর সাঁড়াশি আক্রমণ চালাচ্ছে।
Kajal and Floyd.jpg
কারাগারে কাজল ও জর্জ ফ্লয়েড হত্যাকাণ্ড। ছবি: সংগৃহীত

মার্কিন পুলিশের বর্বরতার প্রতিবাদে গোটা যুক্তরাষ্ট্র প্রতিবাদের আগুনে উত্তাল। বেশিরভাগ ছোট বড় শহরে সান্ধ্যকালীন কারফিউ দিয়ে আন্দোলনকারীদের দমন-নিপীড়নের দ্বিতীয় সপ্তাহ চলছে। তারপরও আন্দোলন তুঙ্গে। বড় শহরগুলোতে প্রতিবাদকারীরা অহরহ কারফিউ ভাঙছে। মার্কিন পুলিশ এবং ন্যাশনাল গার্ড একসঙ্গে প্রতিবাদকারীদের ওপর সাঁড়াশি আক্রমণ চালাচ্ছে।

গত ২৫ মে জর্জ ফ্লয়েড (৪৬) নামে একজন কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তি মিনেসোটার মিনিয়াপোলিসে খুন হয়েছেন। সাদা পুলিশ অফিসার ডেরেক চভিন ফ্লয়েডের ঘাড়ে টানা নয় মিনিট হাঁটু চেপে ধরে রাখেন, যতক্ষণ না পর্যন্ত ফ্লয়েড মারা যান। মিনিয়াপোলিসের রাস্তায় দিনেদুপুরে মাত্র ২০ ডলারের একটি বিলের সত্যতা যাচায়ের সূত্র ধরে এই হত্যাকাণ্ড ঘটে। ফ্লয়েড এই ৯ মিনিটে অনেকবার বলেছিলেন, ‘মামা, আই ক্যান্ট ব্রিদ।’

আজ জানতে পারলাম ফ্লয়েডের করোনাও হয়েছিল। গত কয়েকদিনে আমি এই হত্যাকাণ্ডের ভিডিওটি কয়েকবার দেখলাম। ‘আই ক্যান্ট ব্রিদ’ লাইনটিতে এসেই আমার গলা আটকে আসে। গত প্রায় তিনটা মাস নিজেকে, বাবাকে এবং আমার পুরো পরিবারটিকে দেখতে পাই রাষ্ট্রের হাঁটুর নিচে। আমেরিকার পুলিশ যদি পটাশিয়াম সায়ানাইড হয়, আমাদেরটা কি আর্সেনিক বলবেন না? আমাদের হাতে মারেনি এখনো, কিন্তু প্রতিনিয়ত আমাদের ভাতে মারছে। ভাবতে পারেন একটা মধ্যবিত্ত পরিবার বাবা বিহীন কি করে তিনটা মাস চলতে পারে? তার ওপর প্যান্ডেমিক বাস্তবতায় আমাদের সত্যিই অর্থনৈতিক স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।

বাবাকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর প্রথম মাসটা নানারকম আগত জুলুমের চিত্র সারাক্ষণ আমাদের কল্পনার জগতে বিরাজ করতো। এখন জুলুমের নানাদিক আমাদের কল্পনার জগত এবং বাস্তব দুই দুনিয়াতেই ছেয়ে গেছে। চোখ খুললেই দেখি নির্যাতনের জন্য সকল অস্ত্র আমাদের দিকে তাক করা। চোখ বন্ধ করলে দেখি আমাদেরকেও পথে হাঁটু দিয়ে পিষে দিচ্ছে সারাক্ষণ।

বিগত তিনটি মাস আমি আপনাদের কাছে, আমাদের একান্ত ব্যক্তিগত ও অতি মূল্যবান অতীত এবং বর্তমান শেয়ার করেছি। আপনাদের কারণে আমি কখনই একা বোধ করিনি। আমার সঙ্গে আপনাদের মধ্যে অনেকেই আছেন। আশা করছি আপনারা ভালোই বুঝতে পারবেন- আমরা গত একটা মাস কেন এক প্রকার নীরব  ছিলাম। আপনাদের যে লাল গামছার কথা বলেছিলাম, সেই লাল গামছা প্রতিনিয়ত আমাদের শক্ত করে বাঁধছে। কেউ কেউ থামিয়ে দিতে পারে কথা, কেউ কেউ গুটিয়ে নিতে পারে নিজেকে। কিন্তু আমাদের কি সে বিলাসিতা আছে? তিনটা মাস যে মধ্যবিত্ত পরিবারের কর্তা বাড়ি ফিরেন নাই, সেই পরিবারের এরকম বিলাসিতা থাকলে চলে না। আমাদের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক যে পেষণ চলছে, তার থেকে সহসা কি মুক্তি মিলবে? সুতরাং আমাদের কথা বলে যেতেই হবে।

এই পথ অনেক অন্ধকার, হায়েনার চোখ সর্বদা সজাগ। আপনি এবং আমি যদি কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলি, এ আধার কেটে যেতে বাধ্য। ১৯৭১ সালের কথা মনে রাখতে হবে, স্বৈরাচার আন্দোলনের কথা মাথায় রাখতে হবে। আপনি এবং আমি যদি একটা ছোট প্রাচীরও দাঁড় করাতে পারি, মনে রাখবেন আমরা হায়েনার ঘুম হারাম করে দিলাম।

আমার আসলেই প্রচুর লজ্জা লাগে যখন দেখি আজো নানা ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের মাঝে তফাৎ খুব কম। বাংলাদেশে ড্রাকোনিয়ান ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের আওতায় যে পরিমাণ সাংবাদিক নির্যাতন চলছে, ঠিক তেমনি পাকিস্তানে সাংবাদিক নির্যাতনের জন্য একইরকম আইন আছে। ২০১৯ সালে পাকিস্তানে ৬০ জন সাংবাদিককে এই আইনের অধীনে জেল জরিমানা করা হয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় কি জানেন? পাকিস্তানের মতো একটি সামরিক শাসিত এবং উগ্রপন্থা অবলম্বনকারী রাষ্ট্রও তার সাংবাদিকদের কদাচিৎ পিছে হাতমোড়া করে বেঁধে আদালতে উত্থাপন করে । 

কথা সাহিত্যিক এবং চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান তার ‘সময়ের প্রয়োজনে’ ছোটগল্পে এক কৃষককে জিজ্ঞেস করেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধ করছেন কেন? কাদের জন্য করছেন? আমি গত তিনমাস যেই যুদ্ধে আছি, যেই যুদ্ধে আমি আমার আত্মসম্মান এবং মূল্যবোধ খুব সস্তা দামে বিকোতে দিচ্ছি, সেই যুদ্ধটা আমি আসলে কেন করছি? জীবন সংগ্রামে টিকে থাকার তাগিদে হয়তো। নয়তো সময়ের প্রয়োজনে। আমার ৫১ বছরের বাবাকে ৫৩টা দিন অজানা কারাগারে এবং এখন যশোর জেলের চার দেয়ালে বন্দী করে আমাদের ভবিষ্যৎ কি রাষ্ট্র ঘোলা করে দিচ্ছে না? আমরা কি খাই, কোথায় ঘুমাই এর দায়িত্ব কে নেবে? রাষ্ট্র তো কাজলকে পিছে হাতমোড়া করে বেঁধে আরামে ঘুম দিয়েছে, কিন্তু আমরা চারটা নির্ভরশীল প্রাণ তো ঘুম দিতে পারছি না। আমরা বেঁচে থাকার তাগিদে কথা বলা থামাতে পারছি না।

আপনারা আজ হয়তো পারছেন। কিন্তু ভেবে দেখবেন আজকের বিলাসিতা কোনোদিন গলার কাটা হয়ে যেন না বিঁধে। মনে রাখবেন গুটি কয়েক মানুষকে হয়তো দমিয়ে রাখা যায়, কিন্তু পুরো একটা দেশকে কি দমিয়ে রাখা যায়? আমি বাংলাদেশকে মনেপ্রাণে ভালোবাসি। মনে রাখবেন আপনারাই আমার বাংলাদেশ। আপনাদের কাছে অন্যায়ের প্রতিবাদ আশা রাখি।

আমি গত কয়েকদিন ধরে লক্ষ্য করছি, বাংলাদেশের উচ্চ-মধ্যবিত্ত এবং মধ্য-মধ্যবিত্ত জর্জ ফ্লয়েড এবং মার্কিন জাতিগত বিদ্বেষ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরব। নামীদামী চলচ্চিত্রকার থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কেউ বাদ নেই। দিন নেই রাত নেই আমরা জর্জ ফ্লয়েডের শোকে কাতর। কিন্তু আপনারা আপনার নিজের দেশের নানাবিধ জুলুমের প্রতিবাদে নীরব কেন? কেন বাংলাদেশে, যে দেশটা কী না মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জন করেছে, স্বৈরাচার বিতাড়িত করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছে, এইরকম আইন থাকবে সাংবাদিক নির্যাতনের জন্য?

প্রচণ্ড রৌদ পুড়িয়ে যাচ্ছে আমাদের দিন এবং রাত। আপনাদের ভিড়ে আমরা ছায়া পাই। এইটা এমন একটা রৌদ, যে রৌদ সকলের অংশগ্রহণে বসন্তের বাতাস এবং ছায়া দেবে। 

এই প্রতিবাদী বসন্তে অন্তর্জালে দেখা হবে না আমাদের? জর্জ ফ্লয়েডের সঙ্গে বাংলাদেশি কাজল এবং বাংলাদেশি অন্যদেরকেও আপনাদের কথাতে যুক্ত করবেন। ভয় কীসের বলেন তো? আমাদের শোষণকারী এখন পাকিস্তানী না, বহিরাগতও না। আমরা আমরাই তো। দুটো কথা তো বলতেই পারেন, নাকি? কার্টুনিস্ট কিশোরের কথা মনে পড়ছে, উনার কার্টুন দেখে একা-একাই কত হেসেছি। দিদারুলকেও মনে পড়ছে, উনার কাছ থেকেই তো কি করে হাত উঁচু করে হেটে যেতে হয় কদিন আগেই শিখলাম।

জর্জ ফ্লয়েডের আগে আমি কখনো কোনো মানুষকে সরাসরি খুন হতে দেখিনি। একটা তরতাজা মানুষকে ৯ মিনিটে কি করে মেরে ফেললো, এই অভিজ্ঞতা আমাকেও তাড়িত করে। অপরদিকে রাষ্ট্রের হাঁটুর নিচে আমার বাবা কাজল এবং পুরো পরিবার প্রায় তিন মাস রক্ত-মাংসের পিণ্ড হয়ে নিথর পরে আছি। হঠাৎ হঠাৎ আমাদের গোঙানির শব্দ শুনতে কি পাচ্ছেন? আমার বাবা যদি জেলখানায় করোনায় মারা যান, এর দায় কে নেবে? সরকার যেখানে আসামিদের মুক্তি দিচ্ছে করোনাকালীন সময়কে মাথায় রেখে, আমার বাবাকে কেন মুক্তি দিচ্ছে না? এইটা যদি সাংবাদিক নির্যাতন না হয়, তাহলে সাংবাদিক নির্যাতন আর কি হতে পারে? দেশের ভাবমূর্তিটা আসলে কারা নষ্ট করছে?

মনোরম পলক, সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজলের ছেলে

[email protected]

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

One month of interim govt: Yunus navigating thru high hopes

A month ago, as Bangladesh teetered on the brink of chaos after the downfall of Sheikh Hasina, Nobel Laureate Muhammad Yunus returned home to steer the nation through political turbulences.

10h ago