গোঁজামিলের সেমিস্টার পদ্ধতি দেশের প্রধান চার বিশ্ববিদ্যালয়ে

দেশের প্রধান চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সেমিস্টার পদ্ধতির নামে যেভাবে পড়ানো হচ্ছে, তাতে শিক্ষার্থীরা এর কাঙ্ক্ষিত সুফল পাচ্ছেন না।
4-university-1.jpg

দেশের প্রধান চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সেমিস্টার পদ্ধতির নামে যেভাবে পড়ানো হচ্ছে, তাতে শিক্ষার্থীরা এর কাঙ্ক্ষিত সুফল পাচ্ছেন না।

শিক্ষাবিদরা বলছেন, বছরে একাধিক ব্যাচে শিক্ষার্থী ভর্তি না করা, সময়মত অভ্যন্তরীণ পরীক্ষার ফল প্রকাশিত না হওয়া, কোনো শিক্ষক সহযোগী না থাকা, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর অনুপাতে গরমিল এবং শ্রেণিকক্ষ সংকটের মতো বিভিন্ন কারণে শিক্ষার্থীরা এর সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

দেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর থেকে প্রায় আড়াই মাস ধরে বন্ধ রয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বেশিরভাগ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় এ সময়ে অনলাইনে ক্লাস শুরু করলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখনো এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। ফলে সেমিস্টার শেষ করা নিয়ে সামনে আরও বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে বলে মনে করছেন শিক্ষার্থীরা। গত মাসে অবশ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তারা সেশনজট কমাতে শুক্র-শনিসহ ছুটির দিনগুলোতেও বিশ্ববিদ্যালয় চালু রাখবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, মোট ৮৩টি বিভাগ ও ইনস্টিটিউট সেমিস্টার পদ্ধতিতে চলে। এর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪৯টি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৭টি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ১০টি ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সাতটি বিভাগে সেমিস্টার পদ্ধতি চলে। যদিও প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় ও অনেক ক্ষেত্রে বিভাগ-ভেদে এগুলোতে ভিন্ন নিয়ম রয়েছে।

সেমিস্টার পদ্ধতির শিক্ষাব্যবস্থায় দ্রুততম সময়ের মধ্যে ফল প্রকাশ করা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে মানা হলেও, নির্ধারিত সময়ে ফল প্রকাশ না করাই যেন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিয়মে পরিণত হচ্ছে।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সেমিস্টার পদ্ধতির নিয়ম ঘেঁটে দেখা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আট সপ্তাহ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন সপ্তাহ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ১০ সপ্তাহের মধ্যে পরীক্ষার ফল প্রকাশ করার নিয়ম। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এ সংক্রান্ত কোনো নিয়মই নেই।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় থেকে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, ৮৩টি বিভাগের মধ্যে ৭৫টি বিভাগই তাদের সর্বশেষ সেমিস্টারের ফল নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রকাশ করতে পারেনি। বরং এতে তারা সময় নিয়েছে ১৮ থেকে ২২ সপ্তাহ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদ থেকে সদ্য স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করা এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমি আমার এমবিএ পরীক্ষার ফল পেয়েছি ৩৩ সপ্তাহ পরে। এমনকি পুরো পাঁচ বছরে কখনোই চূড়ান্ত পরীক্ষার আগে সব বিষয়ের অভ্যন্তরীণ পরীক্ষার (অ্যাসাইনমেন্ট, মিডটার্ম) ফল পাইনি। ফলে চূড়ান্ত পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে সবারই বেগ পেতে হয়েছে।’

অভ্যন্তরীণ এসব পরীক্ষায় ২৫ থেকে ৫০ শতাংশ নম্বর বরাদ্দ থাকে।

কোনো কোনো শিক্ষার্থীর অভিযোগ, একটি সেমিস্টার পরীক্ষার ফল না জেনেই তাদের পরবর্তী সেমিস্টার পরীক্ষায় অংশ নিতে হয়েছে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘গত ২৬ জানুয়ারি আমাদের পঞ্চম সেমিস্টার পরীক্ষার মাত্র চারদিন আগে আগের সেমিস্টারের ফল প্রকাশিত হয়। ওই সেমিস্টারে দুই বিষয়ে উত্তীর্ণ না হতে পারায় আমি আর পরীক্ষায় বসতে পারিনি। অথচ, সাত মাস আগে চতুর্থ সেমিস্টারের পরীক্ষা হয়েছিল। এখন আবার নতুন করে শুরু করতে হবে।’

চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও একই ধরনের সমস্যার কথা জানিয়েছেন।

একাধিক শিক্ষার্থীর অভিযোগ, সেমিস্টার শুরুর দিকে অনেক শিক্ষক ক্লাস নিতে গড়িমসি করেন, ফলে শেষের দিকে এসে তাদের ওপর চাপ পড়ে। ছয় মাসের সেমিস্টারের শেষ দুই-তিন মাসে অতিরিক্ত ক্লাস করতে হয়, ফলে ক্লাসের মান ঠিক থাকে না।

শিক্ষার্থীরা বলছেন, সেমিস্টার পদ্ধতিতে সেশনজট কমে এসেছে, তারা সময়মত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়ে যাচ্ছেন, কিন্তু জানাশোনা ও শেখার ক্ষেত্রে তাড়াহুড়ো থাকায় সিলেবাসে অনেক কাটছাঁট করা হয়।

শিক্ষাবিদরাও বলছেন, সেমিস্টার পদ্ধতির সব নিয়ম মানলে তা সত্যিই ভালো একটি পদক্ষেপ ছিল। কিন্তু গোঁজামিল পদ্ধতির মাধ্যমে পড়াশোনায় শুধু সেশনজটই কমে এসেছে, শিক্ষার্থীরা শিখছেন না কিছু।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো সেমিস্টার পদ্ধতির জন্য মোটেই উপযোগী নয়। পশ্চিমা ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুকরণে এখানে এই পদ্ধতি চালু হয়েছে। তবে এ জন্য শিক্ষক সহযোগী নিয়োগ, নতুন ক্লাসরুম তৈরি করাসহ যেসব প্রস্তুতির দরকার ছিল, তা নেওয়া হয়নি।’

অধ্যাপক মনজুরুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের দেশে শিক্ষকদের বেশিরভাগ সময় ব্যস্ত থাকতে হয় পরীক্ষা, অ্যাসাইনমেন্ট, টিউটোরিয়ালের খাতা দেখা নিয়ে। যেগুলো বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকদের সহযোগীরা অনেকটাই করে দেন।’

একই বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান বলেন, ‘এখানে সেমিস্টার পদ্ধতির সবচেয়ে অদ্ভুত দিক হচ্ছে ছয় মাসে একটা সেমিস্টার আর শিক্ষার্থী ভর্তি হয় বছরে একবার, যেটা হয়তো পৃথিবীর আর কোনো দেশে খুঁজে পাওয়া যাবে না।’

এ দুজন অধ্যাপকই মনে করেন, সেমিস্টার পদ্ধতিতে পড়ানোর জন্য একটি ক্লাসে যতজন শিক্ষার্থী থাকা উচিত, তার চেয়ে অনেক বেশি সংখ্যক শিক্ষার্থীকে পড়ানো হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের একজন শিক্ষার্থী বলেন, ‘এমনও হয় যে, আমাদের ক্লাস শুরুর আগে এসে কোথায় ক্লাস হবে, সেটা খুঁজে বের করতে হয়।’

সেমিস্টার শব্দের আভিধানিক অর্থ এক শিক্ষাবর্ষের অর্ধেক। অর্থাৎ বছরকে ভাগ করে প্রতি ছয় মাসে একবার করে চূড়ান্ত পরীক্ষা দিতে হয়। এভাবে আটটি সেমিস্টারে স্নাতক ও দুই সেমিস্টারে স্নাতকোত্তর করতে হয়। প্রতি সেমিস্টারে ১৫ সপ্তাহ ক্লাস, এক সপ্তাহ পরীক্ষার প্রস্তুতিকালীন ছুটি ও তিন সপ্তাহ পরীক্ষার জন্য বরাদ্দ আছে। ক্লাসের জন্য নির্ধারিত সময়ের মধ্যে দলভিত্তিক আলোচনা, উপস্থাপনা, শ্রেণি পরীক্ষা, অ্যাসাইনমেন্ট, টার্ম পেপার ও মিডটার্ম পরীক্ষা নেওয়ার কথা।

যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে দেখা গেছে, সেমিস্টার পদ্ধতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য প্রতি সেমিস্টারে শিক্ষার্থী ভর্তি করা। ফলে কেউ পুরো সেমিস্টার বা কোনো একটি বিষয় নির্দিষ্ট সময়ে শেষ করতে না পারলে পরবর্তী ব্যাচের সঙ্গে শেষ করতে পারে। এতে শিক্ষাজীবনের ছয় মাস বাঁচানো সম্ভব।

কিন্তু এই চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো শিক্ষার্থীর এক সেমিস্টার বাদ দেওয়া মানে পুরো বছরের অপচয়। ছয় মাসের বহিষ্কারাদেশ পাওয়া কোনো শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।

সেমিস্টার পরিচলন পদ্ধতির নিয়মগুলো ঘেঁটে দেখা যায়, ফল প্রকাশের ৪৫ দিনের মধ্যে নম্বর কম পাওয়া বা অকৃতকার্য শিক্ষার্থীর মানোন্নয়ন পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ থাকবে অথবা পরবর্তী ব্যাচের সঙ্গে তিনি পরীক্ষা দিতে পারবেন। কিন্তু শিক্ষার্থীবান্ধব প্রথম নিয়মটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অনুসরণ করা হয় না। ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদে আগে সাপ্লিমেন্টারি পরীক্ষা দেওয়া গেলেও সম্প্রতি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট বলছে, ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদে ১৯৭৭-৭৮ শিক্ষাবর্ষ থেকে সেমিস্টার পদ্ধতি আছে। ক্রমবর্ধমান সেশনজট কমিয়ে আনা, শিক্ষার মান উন্নয়ন ও উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে গ্রেড বা ক্রেডিট পদ্ধতিতে পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদে ২০০৬ সালে সেমিস্টার পদ্ধতি চালু হয়।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে ২০০১-০২ শিক্ষাবর্ষে সেমিস্টার পদ্ধতি চালু হলেও, চার বছরের মাথায় তারা আবার বাৎসরিক পদ্ধতিতে ফিরে গেছে।

ওই বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোহাম্মদ আমজাদ হোসেন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আমরা সিলেবাস শেষ করতে পারতাম না বলে আমাদের সেমিস্টার পদ্ধতি থেকে ফিরে আসতে হয়েছে।’

জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘সেমিস্টার পদ্ধতি আমাদের এখানে খুব ভালো চলছে, আমরা অন্য আরও কয়েকটি বিভাগে সেমিস্টার পদ্ধতি চালু করার কথা ভাবছি। তবে এই ব্যবস্থার আরও উন্নতিতে আমরা যেকোনো পরামর্শ গ্রহণ করব।’

অধ্যাপক আখতারুজ্জামান বলেন, ‘আমরা বিভাগগুলোর পরীক্ষার ফল কীভাবে দ্রুত প্রকাশ করা যায়, সেটা দেখছি।’

সদ্য স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করা শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে শিক্ষক-সহযোগী নিয়োগ করা যায় কী না, সেটি নিয়ে নিজেরাও আলোচনা করছেন বলে জানান ঢাবি উপাচার্য।

Comments

The Daily Star  | English

Create right conditions for Rohingya repatriation: G7

Foreign ministers from the Group of Seven (G7) countries have stressed the need to create conditions for the voluntary, safe, dignified, and sustainable return of all Rohingya refugees and displaced persons to Myanmar

1h ago