এমপি পাপুলের পদ থাকবে?

মানবপাচার ও অর্থপাচারের অভিযোগে কুয়েতে গ্রেপ্তার হয়েছেন লক্ষ্মীপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য কাজী শহীদ ইসলাম পাপুল। তাকে রিমান্ডেও নিয়েছে সে দেশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ।
kazi shahid islam papul
কাজী শহীদ ইসলাম পাপুল। ছবি: সংগৃহীত

মানবপাচার ও অর্থপাচারের অভিযোগে কুয়েতে গ্রেপ্তার হয়েছেন লক্ষ্মীপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য কাজী শহীদ ইসলাম পাপুল। তাকে রিমান্ডেও নিয়েছে সে দেশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ।

শহীদ ইসলাম পাপুল শুধু একজন ব্যক্তি বা একজন ব্যবসায়ী নন। তিনি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের আইনসভার সদস্য। ফলে এটি জাতীয় সংসদের জন্যও অস্বস্তির বিষয়।

যদিও যতক্ষণ না তার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হচ্ছে, ততক্ষণ তাকে অপরাধী বলার সুযোগ নেই। কিন্তু তারপরও বিদেশের মাটিতে মানবপাচার ও অর্থপাচারের অভিযোগে একজন আইনপ্রণেতার গ্রেপ্তার হওয়াটাই বড় খবর, লজ্জার খবর। প্রশ্ন উঠেছে, এই ঘটনার পরে এমপি পাপুলের সংসদ সদস্য পদ থাকবে কী না বা তাকে এই পদে রাখাটা নৈতিক বিবেচনায় কতটা সমর্থনযোগ্য?

উল্লেখ্য, ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে লক্ষ্মীপুর-২ (রায়পুর) আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে জয়ী হন পাপুল। শুধু তাই নয়, স্ত্রী সেলিনা ইসলামকেও সংরক্ষিত আসনে সংসদ সদস্য করে আনেন তিনি।

গণমাধ্যমের খবর বলছে, একজন সাধারণ শ্রমিক হিসেবে কুয়েতে যাওয়া পাপুল বর্তমানে কুয়েতের একটি কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক। তার মালিকানাধীন মারাফি কুয়েতিয়া গ্রুপে ১৫ থেকে ২০ হাজার প্রবাসী বাংলাদেশি কাজ করেন বলে ধারণা করা হয়। গালফ নিউজের খবরে বলা হচ্ছে, পাঁচ বাংলাদেশির স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে পাপুলের বিরুদ্ধে মানবপাচার, অর্থপাচার ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের শোষণের অভিযোগ এনেছে প্রসিকিউশন। জানা যাচ্ছে, কুয়েতেই বিচার হবে এই বাংলাদেশি আইনপ্রণেতার। প্রশ্ন উঠেছে, এই ঘটনায় পাপুলের সংসদ সদস্য পদ থাকবে কী না?

বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী বেশ কিছু কারণে সংসদ সদস্য পদ বাতিল হতে পারে, যেমন: কোনো উপযুক্ত আদালত যদি তাকে অপ্রকৃতিস্থ বলে ঘোষণা করেন; তিনি দেউলিয়া ঘোষিত হওয়ার পর যদি দায় থেকে অব্যাহতি লাভ না করেন; তিনি কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব অর্জন করেন কিংবা কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা বা স্বীকার করেন; তিনি নৈতিক স্খলনজনিত কোনো ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে কমপক্ষে দুই বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন; তিনি যদি প্রজাতন্ত্রের কোনো লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত থাকেন; সংসদের অনুমতি ছাড়া তিনি যদি একটানা নব্বই বৈঠকে অনুপস্থিত থাকেন এবং সংবিধানের বহুল আলোচিত ৭০ অনুচ্ছেদের আলোকে তিনি যদি তার দল থেকে পদত্যাগ করেন অথবা সংসদে উক্ত দলের বিপক্ষে ভোট দেন।

দেখা যাচ্ছে, উপরোক্ত একটি কারণও কুয়েতে গ্রেপ্তার এমপি পাপুলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। তার ক্ষেত্রে দুটি সম্ভাবনা রয়েছে; প্রথমত যদি তিনি কুয়েতে দণ্ডপ্রাপ্ত হন এবং সেটি যদি ফৌজদারি দণ্ডবিধিতে দুই বছরের বেশি সাজা হয়, তাহলে তার সংসদ সদস্য পদ যাবে। এখন মুশকিল হলো কুয়েতের আইনে সাজাপ্রাপ্ত হলে বাংলাদেশের সংসদ সদস্যের সদস্য পদ যাবে কী না- সেটি তর্কের বিষয়। আবার যদি তার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ প্রমাণিত হয় এবং তাকে যদি শাস্তি দেওয়া হয় আর সেই শাস্তি যদি বাংলাদেশে প্রচলিত দণ্ডবিধির আলোকে দুই বছরের বেশি পরিমাণ সাজা হয়, তাহলে সেই যুক্তিতে পাপুল সংসদ সদস্য পদ হারাবেন। কিন্তু বিদেশে সাজাপ্রাপ্ত হলে কারো সংসদ সদস্য পদ যাবে কী না, সেটি বাংলাদেশের সংবিধানে উল্লেখ নেই।

বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবর বলছে, এমপি পাপুলের অভিযোগ প্রমাণিত হলে তার সর্বোচ্চ ১৫ বছর জেল হতে পারে। কেননা কুয়েতের আইন অনুযায়ী অর্থ ও মানবপাচার বড় ধরনের অপরাধ হিসেবে বিবেচিত।

দ্বিতীয়ত, সাজাপ্রাপ্ত হওয়ার পর একটানা ৯০ কার্যদিবস সংসদের বৈঠকে অনুপস্থিত থাকলেও এমপি পাপুলের সদস্য পদ চলে যাবে। কিন্তু সেই সাজা যদি দুই বছরের কম হয় এবং স্পিকার যদি তার সংসদে অনুপস্থিতির বিষয়টি অবহিত থাকেন, তাহলে তার সদস্য পদ যাওয়ার কথা নয়। বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ঘটনাটি এক্ষেত্রে একটি বড় উদাহরণ। কারণ তিনি মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় বিচারাধীন থাকায় নবম সংসদে একটানা ৯০ কার্যদিবসের বেশি অনুপস্থিত থাকলেও যেহেতু বিষয়টি স্পিকার অবহিত ছিলেন, ফলে এই অনুপস্থিতির কারণে তার সদস্য পদ বাতিল হয়নি।

সুতরাং কুয়েতের আইনে বিচার হলে এমপি পাপুলের শাস্তি হবে নাকি তিনি খালাস পাবেন, সে বিষয়ে অগ্রিম কোনো মন্তব্য করা উচিত নয়। তবে এটা ঠিক, আইন ও সংবিধানের চেয়ে নৈতিকতা অনেক বড় বিষয়। আইনত তার সদস্য পদ থাকবে কি থাকবে না সেটি বিতর্কের বিষয় এবং সময়ই বলে দেবে। কিন্তু একজন সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে যখন অর্থ ও মানবপাচারের অভিযোগ ওঠে এবং এই অভিযোগে যখন তিনি অন্য কোনো রাষ্ট্রে গ্রেপ্তার হন, তখন তার নিজেরই উচিত সংসদ থেকে পদত্যাগ করা।

মুশকিল হলো, আমাদের জনপ্রতিনিধিদের অভিধানে পদত্যাগ বলে কোনো শব্দ নেই। বরং কারো মন্ত্রণালয়ে বা এখতিয়ারের ভেতরে ভয়াবহ কোনো দুর্ঘটনা বা অনিয়ম হলেও তার দায় নিয়ে কেউ পদত্যাগ করতে চান না। উপরন্তু সেসব ঘটনাকে ‘বিরোধীদের ষড়যন্ত্র’ বলে দাবি করেন। আওয়ামী লীগের প্রয়াত নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত কোনো এক প্রসঙ্গে সংসদ আলোচনায় রসিকতা করে বলেছিলেন: ‘মাননীয় স্পিকার, আমরা দুটি জিনিস ছাড়া আর কিছু ত্যাগ করতে চাই না...।’

সবশেষ খবর হলো, পাপুলের বিরুদ্ধে মানবপাচারের মাধ্যমে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধান করছে বাংলাদেশের দুর্নীতি অনুসন্ধান সংস্থা দুদকও। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি ৫০ কোটি টাকার শেয়ার কিনে এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের পরিচালক হন। একই ব্যাংকে তার স্ত্রী সেলিনা ইসলামের নামেও রয়েছে ৩০ কোটি টাকার শেয়ার। এ ছাড়া, পাপুলের নামে-বেনামে বিপুল অর্থ-সম্পদ অর্জনেরও অভিযোগ রয়েছে।

সুতরাং যার বিরুদ্ধে নিজের দেশেই এরকম দুর্নীতির অভিযোগে রাষ্ট্রীয় সংস্থা তদন্ত করছে এবং অর্থ ও মানবপাচারের অভিযোগে যিনি বিদেশের মাটিতে গ্রেপ্তার হয়ে রিমান্ডে আছেন, তিনি নৈতিক কারণেই আর সংসদ সদস্যের মতো একটি মর্যাদাশীল পদে থাকার অধিকার রাখেন কী না, সেটিই মূল প্রশ্ন। কারণ পাপুলের ঘটনাটি কেবল একজন ব্যক্তি বা একটি পরিবারের ইস্যু নয়। বরং এটি পুরো দেশের ভাবমূর্তির প্রশ্ন; জাতীয় সংসদের মর্যাদার প্রশ্ন। এখন প্রশ্ন হলো, বড় ধরনের অভিযোগে একজন সহকর্মীর বিদেশে গ্রেপ্তার হওয়ার ঘটনায় সংসদের বাকি ৩৪৯ জন সদস্য লজ্জিত বা বিব্রত হবেন নাকি গতানুগতিকভাবে ‘তিনি ষড়যন্ত্রের শিকার’ জাতীয় বক্তব্য দিয়ে তারা কাজী পাপুলের পক্ষে দাঁড়াবেন?

আমীন আল রশীদ: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, রংধনু টেলিভিশন

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

One month of interim govt: Yunus navigating thru high hopes

A month ago, as Bangladesh teetered on the brink of chaos after the downfall of Sheikh Hasina, Nobel Laureate Muhammad Yunus returned home to steer the nation through political turbulences.

9h ago