সরকার একটি দুর্নীতি সহায়ক বাজেট ঘোষণা করেছে: টিআইবি

করোনাভাইরাস মহামারিতে বিপর্যস্ত অর্থনীতিকে সচল করা, রাজস্ব আয় ও বিনিয়োগ বাড়ানো এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির নামে ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে অপ্রদর্শিত বা কালোটাকা সাদা করা ও অর্থপাচারকে সুকৌশলে বৈধতা দেওয়ার অভূতপূর্ব দুর্নীতি সহায়ক সব পদক্ষেপ ঘোষণায় গভীর উদ্বেগ ও ক্ষোভ প্রকাশ করছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।

একইসঙ্গে অনৈতিক, বৈষম্যমূলক ও সংবিধান পরিপন্থী এসব পদক্ষেপ বাতিলের জোর দাবি জানিয়েছে। দীর্ঘদিনের অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা ও স্বার্থান্বেষী মহলের দুর্নীতিতে পর্যুদস্ত স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ ও সুশাসন নিশ্চিতে জোরালো কোনো পদক্ষেপ বাজেটে না থাকা এবং করোনাকালে এ খাতে বরাদ্দ অপর্যাপ্ত হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেছে সংস্থাটি।

টিআইবির বিবৃতিতে বলা হয়েছে, করোনা পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের নামে সরকারের দুর্নীতিবিরোধী অঙ্গীকার ও দেশের সব প্রচলিত আইনকে উপেক্ষা করে বাজেটে আয়কর অধ্যাদেশে নতুন দুটি ধারা সংযোজনের মাধ্যমে জমি, ভবন, ফ্ল্যাট ও অ্যাপার্টমেন্ট কেনা, নগদ অর্থ, ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থ, সঞ্চয়পত্র, শেয়ার ও বন্ডে অপ্রদর্শিত অর্থ বা কালোটাকা সাদা করার অবারিত সুযোগ তৈরি করা হয়েছে। একইসঙ্গে অর্থের বা সম্পদের উৎস নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষের প্রশ্ন তোলার বিধানটিও রহিত করার প্রস্তাব করা হয়েছে।

বাজেটের এমন প্রস্তাবে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘এটি প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত দুর্নীতির প্রতি শূন্য সহনশীলতার সম্পূর্ণ বিপরীত ও অমর্যাদাকর পদক্ষেপ, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। বছরের পর বছর এ ধরনের সুবিধা দিয়ে দেশের অর্থনীতির কোনো উপকার হয়নি, উল্লেখযোগ্য রাজস্ব আদায় হয়নি, কোনো বিনিয়োগ তো নয়-ই। বরং অনৈতিকতা প্রশ্রয় পেয়েছে আর সরকারের দুর্নীতিবিরোধী অবস্থান প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। সংবিধানের ২০ (২) অনুচ্ছেদের পরিপন্থী এই ব্যবস্থা সৎপথে উপার্জনকারী নাগরিকের প্রতি বৈষম্যমূলক। এর মাধ্যমে সরকার প্রকারান্তরে দুর্নীতি ও অবৈধতাকে লাইসেন্স দিয়ে দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হতে জনগণকে উৎসাহ দিচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘এখানেই শেষ নয়, ঘোষিত বাজেটে ওভার ইনভয়েসিং ও আন্ডার ইনভয়েসিং এর মাধ্যমে অর্থপাচার ঠেকাবার নামে ৫০ শতাংশ জরিমানার বিধান আয়কর অধ্যাদেশে যুক্ত করার প্রস্তাব রাখা হয়েছে।’

এমন প্রস্তাবকে অপরিণামদর্শী আখ্যা দিয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘অর্থপাচারের মতো অপরাধকে ৫০ ভাগ কর প্রদানের মাধ্যমে বৈধতা প্রদান গুরু পাপে লঘু দণ্ডের অভিনব উদাহরণ হতে যাচ্ছে, যেন এ ধরনের ঘোরতর অপরাধের জবাবদিহি কর আদায়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এক্ষেত্রে আইনের শাসন আর আন্তর্জাতিক অঙ্গীকারে কী ধরনের প্রভাব পড়বে, তা বাজেট প্রণেতাগণ মোটেই ভেবে দেখেননি। এর ফলে অর্থপাচার নিয়ন্ত্রণের স্থলে বরং এর মহোৎসবের সুযোগ তৈরি হবে। যেভাবেই এসবের ব্যাখ্যা দেওয়া হোক না কেন, এই প্রস্তাবসমূহ দুর্নীতি-সহায়ক, স্ববিরোধী, বৈষম্যমূলক ও সংবিধান-পরিপন্থী। বলা যেতে পারে সরকার একটি দুর্নীতি সহায়ক বাজেট ঘোষণা করেছে।’

শেষ পর্যন্ত সরকার প্রস্তাবিত ধারাগুলো প্রত্যাহার করে নেওয়ার মাধ্যমে এই আত্মঘাতী অবস্থান থেকে সরে আসবে এই আশাবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর শূন্য সহনশীলতার ঘোষণা আর অপ্রদর্শিত আয় এর পোশাকে কালো টাকা ও তার দ্বারা অর্জিত সম্পদ আর অর্থপাচার বৈধতা দেওয়া শুধু পরস্পর বিরোধী নয় বরং সরাসরি দুর্নীতি সহায়ক এবং সরকার প্রধানের অঙ্গীকারের অবমাননাকর।’

বিবৃতিতে বলা হয়, কোভিড-১৯ উদ্ভূত পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য খাতের নাজুক অবস্থা বিবেচনায় খাতটিতে বাজেটে পর্যাপ্ত বরাদ্দ বাড়ানোর অঙ্গীকারসহ দুর্নীতি প্রতিরোধ ও সুশাসন-মুখী কাঠামোগত সংস্কার এবং একটি কার্যকর পথ-নকশা তুলে ধরা হবে এমনটা প্রত্যাশা থাকলেও তা উপেক্ষিতই রয়ে গেছে।

কোভিড-১৯ মোকাবেলায় জরুরি তহবিল হিসেবে ১০ হাজার কোটি টাকার থোক বরাদ্দের বাইরে স্বাস্থ্য খাতের বাজেট বরাদ্দ একেবারেই গতানুগতিক আখ্যা দিয়ে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘এই থোক বরাদ্দ যেন ব্যাপকতর দুর্নীতির সুযোগে রূপান্তরিত হতে না পারে তার পথ-নকশা থাকতে হবে। অন্যদিকে বাজেটের কথামালায় স্বাস্থ্য খাতের কথা বারবার উচ্চারিত হলেও এডহকভিত্তিক কয়েকটি উদ্যোগ ছাড়া সেবার মান বাড়ানো এবং খাতটিতে শিকড় গেড়ে বসা অবিশ্বাস্য রকম দুর্নীতির মূলোৎপাটনে কোনো পরিকল্পনাই নেওয়া হয়নি, যেটি হতাশাজনক ও স্বাস্থ্যসেবার প্রতি উদাসীনতার এবং সময়ের অনুপযোগী প্রাধান্যের প্রতিফলন। যার ফলে, শতাংশের হিসেবে (মোট বাজেটের ৫ দশমিক ১ শতাংশ) বরাদ্দ বিদায়ি বছরের (৫ দশমিক ৮ শতাংশ) চেয়েও বিব্রতকরভাবে কমে গেছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘একইভাবে প্রত্যাশা ছিল করোনা সংকটের কারণে কর্মহীন হয়ে দরিদ্রসীমার নিচে চলে যাওয়া মানুষের জন্য সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতা বাড়ানো এবং কর্মসংস্থান তৈরিতে ব্যাপকভিত্তিক পরিকল্পনা। কিন্তু বাজেট বিভিন্ন শিল্প খাতের জন্য কর ও শুল্ক ছাড়ের ওপর প্রাধান্য দিতেই বেশি মনোযোগী হয়েছে।’

বিবৃতিতে বলা হয়, ঘোষিত বাজেটে বিদ্যুৎ খাতের উদ্বৃত্ত ক্ষমতা বিবেচনায় ফার্নেস তেলভিত্তিক ব্যয়বহুল বিদ্যুৎকেন্দ্র নিরুৎসাহিত করার অংশ হিসেবে তেল আমদানিতে থাকা শুল্ক সুবিধা প্রত্যাহারের বিষয়টি সাধুবাদযোগ্য হলেও ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে অব্যাহত ভর্তুকি বন্ধের কোনো ঘোষণা দেওয়া হয়নি। একইসঙ্গে ক্রমাগত প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও দুর্যোগে ক্ষয়-ক্ষতি বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ ট্রাস্ট ফান্ড বিসিসিটিএফ- এ বর্ধিত মাত্রায় বরাদ্দের প্রয়োজন হলেও মাত্র ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ প্রদান করা হয়েছে। একইভাবে ঘূর্ণিঝড় আম্পান, আম্পান পরবর্তী জলোচ্ছ্বাস ও বন্যায় ক্ষয়-ক্ষতি মোকাবিলায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে কোনো সুনির্দিষ্ট বরাদ্দ প্রদান করা হয়নি বরং মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ কিছুটা কমে গেছে।

টিআইবির প্রত্যাশা, চূড়ান্তভাবে বাজেট পাশের পূর্বে এসব বিষয়ে যথাযথ মনোযোগী হবে সরকার।

Comments

The Daily Star  | English

Central bank at odds with BPO over Nagad’s future

The discord became apparent after Faiz Ahmed Taiyeb, special assistant to the chief adviser with authority over the Ministry of Posts, Telecommunications and IT, sent a letter to the BB governor on May 12 and posted the letter to his Facebook account recently

3h ago