একা বাঁচতে পারবেন?
![](https://bangla.thedailystar.net/sites/default/files/styles/big_202/public/feature/images/ppe_calad_doc_2.jpg?itok=y9oevRnT×tamp=1592048353)
সাম্প্রতিককালে একটি দাবি উঠেছে, কোভিড-১৯ এর চিকিৎসায় চিকিৎসকদের জন্য পৃথক হাসপাতাল চাই। এর আগে, সাংবাদিকদের জন্য বিশেষ হাসপাতাল চাই এমন দাবির কথাও ফেসবুকে চোখে পড়েছে। ইতোমধ্যে পুলিশে করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের চিকিৎসায় আলাদা হাসপাতালের ব্যবস্থা চালু আছে। আর সেনাবাহিনীর জন্য তো সিএমএইচ রয়েছেই। এছাড়া ভিআইপি, সিআইপি, ব্যবসায়ী, এমপি, মন্ত্রীরা তো চাইলেই যেকোনো ভালো হাসপাতালে যেতে পারবে।
শুধু চিকিৎসাই নয়, করোনাভাইরাসের টেস্টের ব্যাপারেও ভিন্ন রকমের ব্যবস্থা দৃশ্যমান হয়েছে।
এ ধরণের ব্যবস্থা বা দাবি কিন্তু উন্নত বিশ্বে নেই। কেন নেই? কারণ সেখানে প্রকাশ্যে (গোপনে যাই থাকুক) মানুষের অধিকারকে সামাজিক মর্যাদার ভিত্তিতে বিভাজন করা হয় না। তাছাড়া চিকিৎসা ব্যবস্থা যেহেতু অপ্রতুল নয় তাই এ ধরনের বণ্টন বা কোটা করার দরকারও পড়ে না।
কিন্তু চিকিৎসা ব্যবস্থা যখন অপ্রতুল থাকে, তখনই আমরা যার যার সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, অনৈতিক ক্ষমতা দিয়ে নিজের সুবিধা প্রাপ্তিকে নিশ্চিত করতে চাই। বৈশ্বিক মহামারির প্রাক্কালে এই দাবি আরও সোচ্চার হয়েছে, এটাই স্বাভাবিক।
এই দাবির মাধ্যমে দুটি বিষয় খুব পরিষ্কারভাবে ধরা পড়ছে।
এক. সবাই নিজের স্বার্থ নিয়ে ভাবছি, মুখে অনেক বড় বড় কথা বললেও সাধারণ মানুষের কথা আমরা কেউই ভাবছি না। আর যেখানে সমাজের বিবেকবান মানুষ হিসাবে স্বীকৃতরাই নিজের সুবিধাটা নিশ্চিত করতে চাইছেন সেখানে এই ভাবনা অন্যদের মাঝে সংক্রমিত হওয়াটাই স্বাভাবিক। এই ধরনের দাবি থেকে সাধারণের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ পেয়ে যায়। এক্ষেত্রে সমষ্টিগতভাবে বা পেশাগতভাবে আমরা দাবিটি তুলছি তার অন্যতম কারণও কিন্তু কাঙ্ক্ষিত সুবিধাকে আরও নিশ্চিত করা এবং তাকে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলা, ভাবটা এমন যেন এটা একটা ন্যায্য দাবি এবং এর প্রতি সমাজের সমর্থন রয়েছে। আসলে বিষয়টি মোটেও তা নয়।
দুই. আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রকৃত চিত্র যারা জানেন তাদের মধ্যে সামর্থ্যবানরা এতদিন বিদেশে চিকিৎসা নিতেন। করোনাকালে চিকিৎসা ব্যবস্থার মূল সংকটের জায়গাটা কিন্তু উন্মোচিত হয়ে গেছে। বড় বড় বিল্ডিং, তাপানুকূল পরিবেশ, সুশোভিত আসবাব, লাভের যোগানদার কিছু যন্ত্রপাতি, মেশিন আর কাঁচের আচ্ছাদন যে কতটা ঠুনকো তা বেশ ভালোভাবেই প্রমাণিত হয়ে গেছে। শুধু একজোড়া দামি ইটালিয়ান জুতো পরলেই স্মার্ট হওয়া যায় না। আপাদমস্তক স্মার্ট হতে হলে ভালো কাপড়-চোপড় লাগে, স্বাস্থ্যবিধি জানত হয়, ভালো হেয়ার স্টাইল লাগে, লাগে ভালো আচরণ, মার্জিত উপস্থাপনা। আর সবকিছুর জন্য লাগে জ্ঞান এবং বিচক্ষণতা। জ্ঞান এবং বিচক্ষণতা আমাদের সবসময়েই ছিল। কিন্তু ব্যবস্থাপনার বিষয়টি চিরকালই অবহেলিত থেকেছে। অব্যবস্থাপনার কথা উঠলে তার সাথে ব্যবস্থাপনার একটা তুলনা করার প্রসঙ্গ আসে। আর যেখানে ব্যবস্থাপনাই নেই সেখানে মানদণ্ড বলে কিছু থাকার কথা নয়। আমার ভাবনা-চিন্তাই আমার মানদণ্ড। চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা চলে আইনের মানদণ্ড, পেশাগত নীতিশাস্ত্র বা এথিক্স এবং সামাজিক মূল্যবোধ বা মরাল দিয়ে। আইনের মানদণ্ড যদি অনুপস্থিত থাকে সেখানে বাকিগুলোর ওপর ভরসা করে সমন্বিত আদর্শ চিকিৎসা সুবিধা পাওয়া সহজ নয়। তখন একেবারেই ব্যক্তিগত সততা বা অসততার ওপর ভরসা করা ছাড়া সাধারণের আর গত্যন্তর থাকে না। একটা হাসপাতালে সব সেবা থাকবে এটা আশা করা যায় না। কিন্তু একটা শহরের মধ্যে সব হাসপাতাল মিলে একটা পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা সুবিধাকে নিশ্চিত করতে পারবে না তা কী করে হয়? কেউ কি জানেন আমাদের হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ফার্মেসিগুলো কীভাবে চলে? কে এদের দেখভাল করে, কীভাবে করে? স্ট্যান্ডার্ড বলে কি কিছু আছে?
আজ করোনাকাল বলে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে ঘিরে সীমাহীন এই উৎকণ্ঠা। তারমধ্যেও কিন্তু থেমে নেই ডাক্তারদেরকে দোষারোপ করার সেই মজ্জাগত অভ্যাস। আসল সমস্যাটা কোথায়, তা নিয়ে সাধারণ মধ্যেও এখনও সেই একই ধারনা। যত দোষ নন্দ ঘোষ, দোষারোপের তীর সবসময়েই ডাক্তারদের দিকে। দুর্নীতির দুর্নিবার মোহে অন্ধ কুশীলবরা কোভিড-১৯ এর মহামারি বিস্তারে নিজেদের ব্যর্থতা আড়াল করতে ডাক্তারদের ঘাড়ে দোষ চাপানোর অপচেষ্টাকে আড়ালে কিংবা প্রকাশ্যে চালু রেখেছে। কিন্তু এসব করে শেষ রক্ষা হবে?
বিশ্ব মহামারির প্রাক্কালে হাসপাতালে বেড এবং চিকিৎসা সামগ্রীর স্বল্পতা দেখা দেবে, এটাই স্বাভাবিক। বিরাজমান চিকিৎসা সুবিধার স্বল্পতা আর চিকিৎসা সুবিধা না থাকা কিন্তু এক বিষয় নয়। বাংলাদেশের মতো দেশে ভেন্টিলেটরের অপ্রতুলতা থাকতে পারে। কিন্তু যখন অধিকাংশ হাসপাতালে হাইফ্লো অক্সিজেনের ব্যবস্থা অনুপস্থিত থাকে, করোনাভাইরাসে টেস্টের কিটসের সংকট থাকে, টেস্ট করার যন্ত্রপাতির স্বল্পতা থাকে তখন পৃথক হাসপাতালে চিকিৎসা সুবিধা নিশ্চিত করে আর কী হবে? বাসা আর হাসপাতালের মধ্যে কি আর খুব বেশি পার্থক্য থাকল? তারচেয়ে বরং এই শহর, বন্দর, গ্রাম জুড়ে এমন স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে তোলার চেষ্টা করি যাতে কোন অসুখ নিয়ে কাউকে ছুটোছুটি করতে না হয়। গড়ে তোলা হোক এলাকাভিত্তিক পূর্ণাঙ্গ স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। আর দায়িত্বটা তাদের হাতেই দিন, যারা এ বিষয়ে জানেন, বোঝেন।
আর আপনি শুধু নিজে বেঁচে থাকতে চাইবেন আত্মীয় পরিজনের কথা ভাববেন না? আপনার কর্মচারী, ড্রাইভার, বুয়া, সিকিউরিটিতে ঠায় দাঁড়িয়ে ডিউটিরত বয়স্ক চাচা, রিক্সাওয়ালা, হাকিম চত্বরের চা ওয়ালা, হকার ছেলেটা যে প্রতিদিন পেপার দিয়ে যেত, আরও কত পরিচিত মানুষ, তাদের কী হবে? তারা কোন হাসপাতালে যাবে?
আপনি একা বেঁচে থেকে, একা একা পারবেন এই পৃথিবীর পথে পথ চলতে?
সজল আশফাক: লেখক-চিকিৎসক, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র
Comments