বিশ্ব পুঁজিবাজার ঘুরে দাঁড়ালেও ধুঁকছে বাংলাদেশের পুঁজিবাজার

Stock exchange
ছবি: ফাইল ফটো

করোনাভাইরাসকে কেন্দ্র করে বিশ্বের পুঁজিবাজারে ধস নামলেও সেগুলো ঘুরে দাঁড়িয়েছে, এক্ষেত্রে একেবারেই ব্যতিক্রম বাংলাদেশের পুঁজিবাজার।

বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে এমনিতেই তলানিতে ছিল, তার ওপর করোনার প্রকোপে ফ্রেব্রুয়ারি মাসের শেষ দিকে যখন বিশ্ব পুঁজিবাজারে ধস নামে তখন এখানেও শুরু হয় দরপতন।

মার্চের শেষদিকে যখন বিশ্ব পুঁজিবাজারের সূচকগুলো উঠতে শুরু করে তখন আমাদের বিনিয়োগকরীদের সৌভাগ্য হয়নি সে উর্ধ্বমুখি ধারা দেখার।

এমনকী, সরকারের পক্ষ থেকে অর্থনীতিকে সচল রাখার জন্য এক লাখ তিন হাজার ১১৭ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করার পরও পুঁজিবাজারে এর প্রভাব দেখা গেল না।

বিশ্লেষকরা বলছেন, বাজার ঘুরে না দাাঁড়ানোর পেছনে বড় কারণ যথেষ্ট পরিমাণে মুদ্রা সম্প্রসারণ নীতি গ্রহণ করা হয়নি।

এছাড়াও দুই মাসেরও বেশির সময় ধরে পুঁজিবাজার বন্ধ রাখা ও ফ্লোর প্রাইস নির্ধারণ করে কৃত্রিমভাবে সূচক ধরে রাখার মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক ও বিদেশি বিনিয়োগাকরীদের মধ্যে বিদ্যমান আস্থা সংকট আরও প্রকট হয়েছে।

পাশাপাশি করোনার প্রকোপ কমানোর ব্যর্থতাও বাজারকে নিম্নমুখি রাখতে ভূমিকা রেখেছে।

ভিআইপিবি অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শহিদুল ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘সরকার যদিও প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে তবে অর্থবাজারে এখনও তারল্য সংকট রয়েছে। ফলে ব্যাংকিং খাতে ঋণের সুদের হার অনেক বেশি।’

ভিআইপিবি আসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি পারফরম্যান্স বিবেচনায় দেশের শীর্ষস্থানীয় সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি, যেটি ১৬০ কোটি টাকারও বেশি অর্থ ব্যবস্থাপনা করে এবং এর সিংহভাগই করে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের মাধ্যমে।

শহিদুল ইসলামের মতে, অপর্যাপ্ত আর্থিক সম্প্রসারণ নীতিই বাজার তলানিতে পড়ে থাকার প্রধান কারণ।

ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ দিকে যখন করোনাভাইরাস বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ছে তখন এক মাসের মধ্যে ভারতের বম্বে স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান সূচক বিএসই সেনসেক্স ৩৫ শতাংশ কমে ২৫,৯৮১ পয়েন্টে নেমে আসে। আমেরিকার এসএন্ডপি ৫০০ সূচক ৩২.৯৬ শতাংশ কমে ৩,৩৩৭ পয়েন্টে নেমে আসে। ইউরোজোনের সামষ্টিক সূচক ইউরো স্টকস-৫০ হারায় ৩৭ শতাংশ এবং সূচক নেমে আসে ২,৩৮৫ পয়েন্টে।

একই সময়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান সূচক ডিএসইএক্স প্রায় ১৭ শতাংশ কমে ৩,৯৭৪ পয়েন্টে নেমে আসে।

এরপর মার্চের শেষদিকে আমেরিকাসহ বিশ্বের প্রায় সব দেশেই প্রণোদনা প্যাকেজ আসতে শুরু করে। গত ২৬ মার্চ আমেরিকার সিনেটে ২ ট্রিলিয়ন ডলারের সহযোগিতা বিল পাশ হয়। যেটি আমেরিকার ইতিহাসে সর্বোচ্চ।

এভাবে প্রণোদনা প্যাকেজ আসতে থাকায় বিশ্বের সব পুঁজিবাজার ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে। মার্চের শেষ অংশ থেকে মঙ্গলবার পর্যন্ত এই প্রায় আড়াই মাসে এসএন্ডপি ৫০০ সূচক ৩৭ শতাংশ বেড়ে ৩,০৬৬ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। একই সময়ে ইউরো স্টকস ৫০ বেড়েছে ৩৫ শতাংশ। আর সেনসেক্স উঠে এসেছে ২৯ শতাংশ পর্যন্ত।

অথচ ডিএসইএক্স এ সময়ে ১ শতাংশ কমে ৩,৯৬০ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে।

একজন মার্চেন্ট ব্যাংকার নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডেইলি স্টারকে বলেন, এবার করোনাভাইরাসের সময় সারা বিশ্বেই যখন পুঁজিাবাজারে লেনদেন হয়েছে তখন দুই মাসেরও বেশি সময় আমাদের লেনদেন বন্ধ ছিল। তার ওপর বিএসইসি গত মার্চ মাসের পাঁচ দিনের শেয়ারের দাম গড় করে একটি দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে যার নিচে শেয়ারের লেনদেন করা যাবে না।

তিনি আরও বলেন, ‘এটি একবার পাকিস্তানে করা হয়েছিল, কিন্তু পরে তা তাদের জন্য বুমেরাং হয়। কারণ, এর কারণে বেশিরভাগ শেয়ারই লেনদেন হচ্ছে না। এ ধরনের কৃত্রিমভাবে শেয়ারের দাম ধরে রাখার নীতি বিনিয়োগকারীদের আস্থাকে আরও ক্ষতিগ্রস্ত করেছে এবং এর ভবিষ্যতও খারাপ।’

তাছাড়া, গ্রামীণফোনের কাছে সরকারের কর আদায় নিয়ে যে টানাপোড়েন চলছে সেটির কোনো সমাধান হয়নি। তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে সাবধানী থাকতে হবে। নইলে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থা সংকট আরও প্রকট হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

‘বন্ডের মুনাফা (ইল্ড) কমাতে হবে নইলে ব্যাংকগুলো বেসরকারি খাতে ঋণ দেওয়ার ঝুঁকি না নিয়ে তারা বন্ডের মতো নিরাপদ বিনিয়োগেই ঝুঁকবে। আর তাতে বেসরকারি খাতে তারল্য সংকটও রয়ে যাবে। পুঁজিবাজারও ঠিক হবে না,’ যোগ করেন শহিদুল ইসলাম।

আমেরিকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ ঘোষণা দিয়েছে, তারা বাজার থেকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের বন্ড কিনবে, হোক সেটি সরকারি আর হোক বেসরকারি, যেন বাজারে তারল্য সরবরাহ বেশি থাকে।

ভারতের উদাহরণ টেনে এই সম্পদ ব্যবস্থাপক বলেন, ‘পার্শ্ববর্তী দেশের বন্ডের ইল্ড হার তিন শতাংশের কাছাকাছি। সেটি আমাদের দেশে সাত থেকে নয় শতাংশ পর্যন্ত আছে। অথচ আমাদের মূল্যস্ফীতি প্রায় সমান। তাহলে আমাদের ব্যাংকগুলো কেন ঋণ দেওয়ার ঝুঁকি নিবে? ফলে বাজারে তারল্য বাড়বে কীভাবে?’

যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি সিআরআর বা নগদ টাকা সংরক্ষণের বাধ্যবাধকতা কিছুটা কমিয়ে ৪ শতাংশে নামিয়ে এসেছে। একই সঙ্গে রেপো হার কমিয়ে ৫ দশমিক ২৫ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। কিন্তু এগুলো এ ধরনের নজিরবিহীন অর্থনৈতিক শ্লথতা থেকে মুক্তি দিতে যথেষ্ট নয়।

বিশ্লেষকদের মতে, দেশের পুঁজিবাজার ঘুরে না দাঁড়ানোর আরেকটি কারণ হলো বেশিরভাগ বিনিয়োগকারীই যখন বাজার পড়ে যায় তখন কিনতে ভয় পান। আর যখন বাজার উচ্চমূল্য হয়ে পড়ে তখনও শেয়ার বিক্রি করতে চান না, আরও বাড়ার আশায়।

পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আমাদের বিনিয়োগকারীরা মনে করেন, দেশের অর্থনীতি আরও খারাপ দিকে যেতে পারে। ফলে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর আয়ও কমবে। যদিও সরকার প্রাক্কলন করেছে যে এবারও জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৮ দশমিক ২ শতাংশ হবে।’

তাছাড়া, যখন সারা বিশ্বে ধীরে ধীরে ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা ও মৃত্যুহার কমে আসছে আমাদের এখানে এখনও তা বাড়ছে। ফলে মানুষ ভয় পাচ্ছেন শেয়ার কিনতে।

Comments

The Daily Star  | English

JP central office vandalised, set ablaze

A group of unidentified people set fire to the central office of Jatiyo Party in Dhaka's Kakrail area this evening

1h ago