প্রবৃদ্ধিমুখী নয়, জনমুখী বাজেট চাই
করোনা প্রাদুর্ভাবে বৈশ্বিক অর্থনীতির মতো বিপর্যস্ত বাংলাদেশের অর্থনীতি। ঠিক এই মুহূর্তে জাতীয় বাজেট ২০২০-২১ ঘোষণা করা হয়েছে। এ বাজেট প্রবৃদ্ধিমুখী না জনমুখী? কারণ বিশ্বের বিভিন্ন অর্থনৈতিক উন্নয়ন সংস্থা বাংলাদেশে প্রবৃদ্ধি ২-৩% হবে বলে প্রাক্কলন করলেও আমরা ৮.২% প্রবৃদ্ধি হবে বলে প্রত্যাশা করেছি।
যদিও রপ্তানি আয় হ্রাস ও দেশীয় স্থানীয় শিল্প উৎপাদন হ্রাস পাওয়ায় এবছর ৫.২% প্রবৃদ্ধি হয়েছে। তবু ২০২০-২১ অর্থবছরে ৮.২% প্রবৃদ্ধি প্রাক্কলন করা হয়েছে। অথচ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হলেই যে কর্মসংস্থান বাড়বে, আয় বৈষম্য হ্রাস পাবে এবং মানুষের জীবনের গুণগত পরিবর্তন হবে, তা নাও হতে পারে।
২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটের আয়তন সংশোধিত বাজেটের তুলনায় ১৩.২৪% বেশি। মোট আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩ লক্ষ ৭৮ হাজার কোটি টাকা। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা, যা বিগত বছরের সংশোধিত বাজেটের তুলনায় ৯.৮২% বেশি। অথচ বিগত অর্থবছরে ৩ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা বিপরীতে জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত আদায় হয়েছে মাত্র ১ লক্ষ ৩৬ হাজার ৪৫৯ কোটি টাকা। তারপরে এত বড় লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, যা অনেকাংশে অবাস্তব।
২০২০-২১ অর্থবছরে সরকারের পরিচালনা ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ লক্ষ ১১ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। অথচ বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) বরাদ্দ ২ লক্ষ ৫ হাজার ১৪৫ কোটি টাকা। অনুন্নয়ন ব্যয়ের মধ্যে সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বাবদ ব্যয় হবে ৬৫ হাজার ৮৬ কোটি টাকা এবং পেনশন বাবদ ব্যয় হবে ২৭ হাজার ৬৩৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ মোট ৯৩ হাজার ৪৯৭ কোটি টাকা ব্যয় হবে সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীদের জন্য। তাছাড়া, পণ্য বা সেবা সরবরাহ ও যন্ত্রপাতি ব্যবস্থাপনা খরচে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৩৪ হাজার ৭৪৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ বিগত অর্থবছরের তুলনায় সরকারি কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতা বাবদ খরচ ৮% এবং ব্যবস্থাপনা খরচ ৭% বৃদ্ধি পেয়েছে। আমরা দেখছি সরকারের মোট বাজেটের ২২.৫৮% ব্যয় হয়ে যাচ্ছে এসব খাতে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ১৯৭২ সালের ৭৮৬ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করা হয়েছিল, যার সিংহভাগই বরাদ্দ ছিল উন্নয়ন কর্মসূচিতে। অথচ বর্তমানে উন্নয়ন কর্মসূচির তুলনায় পরিচালনা ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। অবাক হওয়ার বিষয়- একমাত্র সরকারি কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতা প্রদানের ক্ষেত্রে সংশোধিত বাজেটের পরিমাণ ঘোষিত বাজেটের তুলনায় বেশি ব্যয় হয়।
বাজেটে দীর্ঘ পাঁচ বছর পর সাধারণ মানুষের কর বোঝা লাঘব করে ব্যক্তিশ্রেণির আয়করের ন্যূনতম সীমা ৩ লক্ষ টাকা ও সর্বনিম্ন করহার ৫% নির্ধারণ করেছে। অনলাইনে কর প্রদান জনপ্রিয় করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বেসরকারি খাতের ননলিস্টেড কোম্পানির ২.৫% কর্পোরেট ট্যাক্স হ্রাস করা হয়েছে। এসবই সময়ের দাবি। পাশাপাশি অর্থপাচার রোধে আমদানি বা রপ্তানির সময়ে যে পরিমাণ অর্থ আন্ডার বা ওভার ইনভয়েসিং করা হবে অথবা যে পরিমাণ প্রদর্শিত বিনিয়োগ ভুয়া প্রমাণিত হবে, তার ওপর ৫০% হারে কর আরোপের প্রস্তাব অর্থপাচার রোধে ভূমিকা রাখবে, যা প্রশংসনীয়।
প্রত্যক্ষ কর তথা আয়করের উদ্যোগ প্রশংসনীয় হলেও পরোক্ষ কর তথা ভ্যাটের চাপে মধ্যবিত্ত এবারও জর্জরিত হওয়ার আশংকা রয়েছে। কারণ জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এবার আয়কর থেকে রাজস্ব আয় ৩১.৫০% এবং ভ্যাট থেকে ৩৭.৯৩%, আমদানি শুল্ক থেকে ১৩.০৫% এবং সম্পূরক শুল্ক থেকে ১৭.৫২% লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। অথচ বিগত অর্থবছর আয়কর থেকে ৩৪.২৪% এবং ভ্যাট থেকে ৩৬.৫৫% রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। আয়ের অনুপাতে নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য ক্রয়ে মধ্যবিত্ত তার আয়ের সিংহভাগ ব্যয় করে। আর তাই মধ্যবিত্তের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী ক্রয়ের সময় অতিরিক্ত ভ্যাট দিতে হবে। আর প্রত্যক্ষ করের তুলনায় পরোক্ষ করের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরতা আমাদের রাজস্ব ব্যবস্থার দুর্বলতা প্রকাশ করে। এ কারণেই আমাদের ট্যাক্স-জিডিপি ১০.৮৮ % এবং মধ্যম আয়ের দেশের তুলনায় সর্বনিম্ন।
তাছাড়া, স্থানীয় আমদানি বিকল্প শিল্প, যেমন: সেলফোন উৎপাদন, কমপ্রেসর উৎপাদন, অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র, কৃষি যন্ত্রপাতি উৎপাদন, গাড়ির পার্টস, উড়োজাহাজ ব্যবস্থাপনার ভারি যন্ত্রপাতি, ট্রান্সফরমার, পোল্ট্রি ও ডেইরি খাদ্য প্রস্তুতকরণ ও এ শিল্পের উপকরণের ওপর শুল্ক হ্রাস ও দেশীয় পোল্ট্রি শিল্প রক্ষায় ফিনিশড প্রোডাক্টের ওপর শুল্ক বৃদ্ধি, পাদুকা শিল্পের উপকরণের ওপর শুল্ক হ্রাস করা এবং রপ্তানিমুখী অন্যান্য শিল্পের উপকরণের ওপর শুল্ক হ্রাস করা হয়েছে। এবছর দেশীয় শিল্প প্রতিষ্ঠানের কাঁচামাল ও উপকরণ আমদানি করার ক্ষেত্রে অগ্রিম করের পরিমাণ ৫% থেকে ৪% নির্ধারণ করার পদক্ষেপ প্রশংসনীয়। এতে বোঝা যাচ্ছে সরকার ডোমেস্টিক ডিমান্ড ড্রিভেন গ্রোথ এর লক্ষ্য নিয়ে বাজেট ঘোষণা করেছে। কিন্তু এই লক্ষ্য কি বর্তমান রাজস্ব কাঠামোতে অর্জন সম্ভব? কারণ এবারের বাজেটে ন্যূনতম ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়ীক লেনদেন বছরে ৩ কোটি টাকা হলে তাকে ০.৫% আয়কর দিতে হবে। অথচ অতীতে এই ক্ষেত্রে ০.৩% কর দিতে হত। এতে করে যাদের ব্যবসায়ীক লেনদেন অনেক বেশি কিন্তু মুনাফা কম, যেমনটা আমরা দেখি পুরান ঢাকা ও চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীদের মধ্যে, তারা বিশাল ক্ষতির সম্মুখীন হবেন। তাছাড়া অতীতে যেকোনো কোম্পানি বিদেশ ভ্রমণে অনুমোদন যোগ্য ব্যয় অর্থাৎ যে ব্যয়ে আয়কর দিতে হতো না তার পরিমাণ ছিল ১.২৫%। কিন্তু বর্তমানে তা হ্রাস করে ০.৫% পর্যন্ত করা হয়েছে, এতে করে রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠান তাদের পণ্য বিদেশে বাজারজাতকরণ, বিদেশি বিক্রেতার সঙ্গে আলোচনা, যোগাযোগ ও মেলায় অংশগ্রহণের খরচ হ্রাস করতে বাধ্য হবে। ফলে কর্পোরেট ট্যাক্স হার হ্রাস পেলেও তার সুযোগ কতটা কাজে লাগানো যাবে?
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী, ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) বাংলাদেশ থেকে প্রতি মাসে গড়ে ৩০০ কোটি ডলারের বেশি পণ্য রপ্তানি হয়েছে। তবে এপ্রিলে সেটি হ্রাস পেয়ে ৫২ কোটি ডলারে নেমেছে। ফলে সামগ্রিকভাবে অর্থবছরের দশ মাস শেষে রপ্তানি কমে গেছে ১৮%। করোনাকালে বৈশ্বিক পণ্য রপ্তানি বাজার সংকুচিত হচ্ছে। ঠিক তখন রপ্তানি আয়ে উৎসে কর ০.২৫% থেকে বৃদ্ধি করে ০.৫% বৃদ্ধি করা কতটা যৌক্তিক? তাছাড়া নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য আমদানি করার জন্য স্থানীয় পর্যায়ে খোলা এলসির ওপর ২% হারে ট্যাক্স আরোপ করা হয়েছে। এতে করে স্বাভাবিকভাবে ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়বে।
আমরা দেখতে পাই ভ্যাট আইনে এবছর উপকরণ কর রেয়াত এর সংজ্ঞা প্রদান করা হলেও মূল্য সংযোজন বা মুনাফা অনুপাতে ভ্যাট আরোপ করার কোনো প্রস্তাব নেই। তাছাড়া, ভ্যাট রিফান্ডের সময়সীমা ৯ মাস থেকে হ্রাস করার তেমন কোনো উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়নি। পাশাপাশি, ভ্যাট আইনের ৮৩-এর উপধারা ৪ অনুযায়ী কমিশনারের আদেশ ছাড়াই সাধারণ রাজস্ব কর্মকর্তাকে ব্যবসাস্থল অনুমতিহীন পরিদর্শন ও হিসাব পরীক্ষা করতে দিলে হয়রানির আশঙ্কা থেকে যায়। অতীতে আপিল ও ট্রাইব্যুনালে বিবদমান ভ্যাট নিয়ে আবেদনে পূর্বে ১০% জামানত দিতে হত। কিন্তু বর্তমানে আপিল করা ও ট্যাক্স ট্রাইব্যুনালে যাওয়ার পূর্বেই উভয়ক্ষেত্রে ২০% নির্ধারিত অর্থ জামানত হিসেবে দিতে হবে। ফলে ব্যবসায়ীদের ন্যায়বিচার পাওয়া কঠিন হয়ে যাবে এবং কর নিরূপণে রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হিসেবে বিবেচিত হবে। তবে এত কিছুর মাঝেও বিদ্যুৎ ও গ্যাস বিল উপকরণ ব্যয় হিসেবে গণ্য করা এবং পরিবহন কর রেয়াত ৮০% পর্যন্ত অনুমোদন করার সিদ্ধান্ত প্রশংসনীয়।
দেশীয় বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং অর্থপাচার বন্ধে অপ্রদর্শিত অর্থ আবাসন ও পুঁজিবাজারে সহজ শর্তে বিনিয়োগ করার সুযোগ দেওয়ার কারণে বর্তমান করোনা দুর্যোগের সময়ে অর্থনীতিতে কিছুটা বিনিয়োগ বাড়বে। তবে ক্যাশ, ব্যাংক ডিপোজিট, ফিন্যান্সিয়াল স্কিম, ইনস্ট্রুমেন্ট, সেভিং ইনস্ট্রুমেন্ট ও সার্টিফিকেট-এ অপ্রদর্শিত অর্থ সহজ শর্তে ব্যয় করে বৈধ করার সুযোগ বন্ধ করা প্রয়োজন। আর তা না হলে পুঁজিবাজার ও আবাসন খাতে অপ্রদর্শিত আয় ব্যবহৃত না হয়ে ব্যাংকে সঞ্চয় বাড়বে ও নিয়মিত করদাতারা হতাশ হয়ে পড়বেন।
বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ লক্ষ্যমাত্রা জিডিপির ২৫.৩% অর্জনে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহের লক্ষ্যমাত্রা আগামী অর্থবছরে বাড়িয়ে ১৬.৭০% নির্ধারণ করা হয়েছে। অথচ অতীতে প্রদত্ত ঋণের মেয়াদ হ্রাসকরণসহ, খেলাপি ঋণ আদায় এবং মন্দ ঋণ সনাক্তকরণে কোনো দিকনির্দেশনা বাজেটে নেই। পাশাপাশি, ব্যাংক ও ক্লায়েন্ট নির্ভর সম্পর্কের ভিত্তিতে ঋণ প্রদান করার কারণে প্রণোদনা প্যাকেজের সুবিধাভোগী হতে পারছেন হাতে গোণা কয়েকজন। তারপরেও চালু করা হয়নি কোনো ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিম। রপ্তানিমুখী শিল্প এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতের উদ্যোক্তাদের বর্তমানে অন্যতম প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে চলতি মূলধনের অভাব। এই সংকট মোকাবিলায় ১ লাখ কোটি টাকার ওপর প্রণোদনা ঘোষণা করলেও এই প্রণোদনার সুফল নিশ্চিত করতে ঋণ প্রদান প্রক্রিয়াকে সহজতর করা প্রয়োজন।
করোনা প্রাদুর্ভাব পরবর্তী সময়ে আমরা দেখছি খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে খাদ্য মন্ত্রণালয়ে বাজেটের মোট বরাদ্দের মাত্র ০.৯৬% ও কৃষি মন্ত্রণালয়ে মাত্র ২.৯৮% বরাদ্দ প্রদান করা হয়েছে। তাছাড়া কৃষি অবকাঠামো উন্নয়নে এডিপিতে ২ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে, যা এডিপির মাত্র ১.২%। অথচ আমাদের বড় বড় প্রকল্পের বরাদ্দের কমতি নেই। সড়ক ও বিদ্যুৎ বিভাগ বরাদ্দের শীর্ষে। কারণ সড়ক বিভাগের আওতায় বড় বড় প্রকল্পগুলো। আর বিদ্যুৎ বিভাগের আওতায় রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ও ক্যাপসিটি পেমেন্টের নামে বিদ্যুৎ উৎপাদন না করে চুক্তিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ভাড়া পরিশোধ করতে হয়। অথচ খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা ও সরকারিভাবে আর কৃষিপণ্য সংরক্ষণাগার প্রতিষ্ঠা এবং বীজ সংরক্ষণে বরাদ্দ বৃদ্ধি করা যায় না। যে খাতে দেশের ৪২% মানুষের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করছে, সেই খাতে মোট এডিপির ১.২% বরাদ্দ। বাস্তবতা হলো- কৃষিকে সুরক্ষা দিতে পারলে দেশের একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষা দেওয়া সম্ভব হবে। একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে এড়িয়ে কীভাবে এমন বাজেট ঘোষণা হতে পারে তা একটি প্রশ্ন। তাই জনমুখী চাহিদাকে প্রাধান্য দিতে ১০টি ফাস্টট্র্যাক প্রকল্পের মধ্যে যা অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও জনসাধারণে জীবনযাত্রার সঙ্গে সরাসরি সংশ্লিষ্ট, সেসব প্রকল্প অগ্রাধিকার-ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করা উচিত। অন্যগুলো বর্তমান পরিস্থিতিতে স্থগিত থাকতে পারে।
এডিপিতে স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ বিগত অর্থবছরের তুলনায় মাত্র ০.৯% বৃদ্ধি পেয়েছে এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে বিগত অর্থবছরের তুলনায় বরাদ্দ বৃদ্ধি করা হয়েছে ৪ হাজার ২৭২ কোটি টাকা। এই সামান্য বরাদ্দ নিয়ে স্বাস্থ্যখাতে করোনার মত মহামারিরোধী অবকাঠামো নির্মাণ ও প্রয়োজনীয় মানবসম্পদের নিয়োগ প্রদান কতটুকু সম্ভব? তাছাড়া, সার্বজনীন স্বাস্থ্যবীমা নিয়ে কোনো প্রস্তাব নেই। নেই আপদকালীন সময়ে টেলিমেডিসিনকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে কোনো বরাদ্দ। তারপরও যতটুকু বরাদ্দ রয়েছে, তা বাস্তবায়ন করা গেলে কিছুটা হলেও উন্নতি সম্ভবপর হতো। কিন্তু বাংলাদেশে এডিপি বরাদ্দের ব্যয় ৯ মাসে হয় ৪০%। আর অবশিষ্টাংশ ৬০% হয় পরবর্তী ৩ মাসে।
গত এক দশকে প্রবৃদ্ধি উৎসাহব্যঞ্জক হওয়া সত্ত্বেও ক্রমবর্ধমান বেকারত্বের চাপে জর্জরিত বাংলাদেশ। নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির চেয়ে বিদ্যমান কর্মসংস্থান টিকিয়ে রাখাই এখন চ্যালেঞ্জ। এই মুহূর্তে ব্যবসায় অর্থায়ন অন্যতম প্রধান একটি চ্যালেঞ্জ। কারণ প্রণোদন প্যাকেজের আওতায় ঋণ পাওয়া দুরূহ। একইভাবে বর্তমান বাজেটে রাজস্ব ঘাটতি ও অর্থায়ন একটি চ্যালেঞ্জ। যুদ্ধাস্ত্র তৈরি করলেও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়তে পারে। কিন্তু প্রবৃদ্ধি বাড়লেই যে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জনকল্যাণ বাড়বে বা টেকসই উন্নয়ন হবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের মাধ্যম কর্মক্ষম জনশক্তি। আর এই প্রবৃদ্ধির ভোক্তা জনগণ। যদি জনগণের জীবনমান উন্নয়ন না হয়, তবে কী হবে প্রবৃদ্ধি দিয়ে?
যদি রাজস্ব আয় বাড়ানো না যায়, উন্নয়নমুখী খাতে ব্যয় না বাড়ে ও কর্মসংস্থান টিকিয়ে রাখা না যায় এবং প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় প্রকৃত অংশীজন ঋণ না পায়, তবে কীভাবে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে। এই করোনাকালে যে অসংখ্য মানুষ ঢাকা ছাড়তে বাধ্য হলো, যে রপ্তানিমুখী শিল্প শ্রমিকেরা বেকার হয়ে পড়ল এবং যে কৃষক ফসলের ন্যায্য দাম থেকে বঞ্চিত হলো, তাদের জন্য বাজেট কী নিশ্চিত করতে পারল? তাই কাল্পনিক রাজস্ব আয় বা কাল্পনিক প্রবৃদ্ধি নয়, বরং কর্মসংস্থান বান্ধব লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে দেশ ও মানুষ বাঁচানোর জনমুখী বাজেট চাই।
শামস আরেফিন: গবেষণা সহযোগী ও উপসচিব, ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)
Comments