‘করোনাকালে আরও বেশি গরীব হবার নাগছোং’

লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার তিস্তাপাড় গোবর্ধান এলাকার খইমুদ্দিন মিয়া। থাকেন ছেলের সংসারে। করোনা পরিস্থিতি সৃষ্টির পর থেকেই পাঁচ জনের সংসারে দেখা দেয় টানাপড়েন।
করোনাকালে পরিবারে আয়-রোজগার নেই, সামনের দিন নিয়ে দুঃশ্চিন্তায় লালমনিরহাটের আদিতমারি উপজেলার তিস্তাপাড়ের খইমুদ্দিন মিয়া। ছবি: এস দিলীপ রায়

লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার তিস্তাপাড় গোবর্ধান এলাকার খইমুদ্দিন মিয়া। থাকেন ছেলের সংসারে। করোনা পরিস্থিতি সৃষ্টির পর থেকেই পাঁচ জনের সংসারে দেখা দেয় টানাপড়েন।

ছেলে একটা হোটেলে শ্রমিকের কাজ করত। তিস্তা নদীর ভাঙ্গনে বসতভিটা, আবাদি জমি সবকিছুই হারিয়ে আট বছর আগে আশ্রয় হয়েছে অন্যের জমিতে।

খইমুদ্দিন বলেন, তারা সরকারি ত্রাণ সহায়তা পেয়েছেন কিন্তু অনেক আগেই তা শেষ হয়ে গেছে। ছেলে এখন আয়-রোজগারহীন। দুটি ঘর মেরামতের জন্য চার হাজার টাকা জমিয়েছিলেন কিন্তু তা ঘর মেরামতের কাজে ব্যয় না করে সংসার চালাতে ব্যয় হয়েছে। ঘরগুলো নড়বড়ে, যে কোন সময় ঝড় হলে মাটিতে পড়ে যাবে।

‘তিন বেলা খাবার জোটাতো দূরের কথা হামরাগুলা একবেলা খাবারও ঠিকমতো পাবার নাগছি না,’ বলেন খইমুদ্দিন।

‘ঘরোত একটা টেবিল আছিল সেটাও ব্যাচে খরচ করি আনি খাওয়া হইছে,’ হামরাগুলাতো গরীব মানুষ। করোনাকালে আরো বেশি গরীব হবার নাগছোং।’

একই গ্রামের দিনমজুর নাসের আলী জানান, করোনাকালে তাদের মতো দিনমজুর মানুষের অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। হাতে যা কিছু সঞ্চয় ছিল তা শেষ। অল্প দামে আগাম শ্রম বিক্রি করতে হয়েছে তারপরও সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন।

’হামার তিনটি ছাগল আছিল তারমধ্যে দুটি ছাগল বেচিয়া সংসার চালবার নাগছি,’ তিনি বলেন।

‘এ্যালা প্রতিদিন কাজ কামাই হবার নাগছে না। একদিন কামাই হয়তো দুইদিন বসি বসি থাকা নাগে,’

‘হামরা বসি বসি খাইলে ঋণ করা নাগে আর বড় লোকেরা সারাজীবন বসি খাইলো ওমার টাকা শ্যাষ হবার নয়,’ আক্ষেপের কথা জানিয়ে বলেন, করোনা পরিস্থিতিতে গরীব মানুষ হতদরিদ্রে পরিণত হচ্ছে।

লালমনিরহাট সদর উপজেলার কুলাঘাট গ্রামের দিনমজুর নওশের আলী জানান, করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় বাড়িতে থেকে সংসার চালাতে গিয়ে তাকে দুটি গরুর মধ্যে একটি বিক্রি করতে হয়েছে। তারপরও সংসার চলছে না। গরু প্রতিপালন করে তিনি বছরে ২৫-৩০ হাজার টাকা বাড়তি আয় করে করতেন, যা দিয়ে সংসারের বাড়তি প্রয়োজন মিটিয়ে কিছু টাকা সঞ্চয় করেন। কিন্তু করোনা পরিস্থিতি তার সব হিসেবকে এলোমেলো করে দিয়েছে।

লালমনিরহাট সদর উপজেলার কর্ণপুর গ্রামের ক্ষুদ্র মুদি দোকানদার শিবেন চন্দ্র বর্মণ বলেন, তিনি তার ক্ষুদ্র ব্যবসার পুঁজি হারিয়েছেন। সংসার চালাতে গিয়ে বসতভিটার সাতটি গাছের মধ্যে ৫টি গাছ সাড়ে তেরো হাজার টাকায় বিক্রি করেছেন। সরকারি ন্যায্যমূল্যের চালের কার্ড পেয়েছেন কিন্তু মাসে যে পরিমাণ চাল পান তা দিয়ে পাঁচ জনের সংসার ১০ দিনও চলে না। ‘জানিনা করোনা পরিস্থিতিতে সংসার চালাতে সংসারের আর কি কি জিনিসি বিক্রি করতে হবে,’ তিনি জানান। ‘করোনাকালে আমরা দরিদ্র লোকজন যে পরিমানে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছি তা পুষিয়ে উঠতে অনেকদিন সময় লাগবে,’ তিনি জানান।

‘চড়া সুদে ঋণ নিয়ে সংসার চালাচ্ছি। ঋণের টাকা সুদে আসলে বাড়ছে। করোনা পরিস্থিতি ভালো হলে আয় করে ঋণের টাকা শোধ করতে হবে আর তখনও মন্দ পরিস্থিতি নিয়ে বাঁচতে হবে,’ জানালেন একই গ্রামের  বাইসাইকেল মেকানিক্স হযরত আলী। ’করোনা পরিস্থিতি আমাদের মতো গরীব মানুষকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে দিলো না,’ তিনি জানান।

লালমনিরহাটে চরাঞ্চলে জীবিকায়ন নিয়ে কাজ করে এমন একটি বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থার প্রতিনিধি সোহেল রানা জানান, বিশেষ করে তিস্তা ও ধরলা নদীর চরাঞ্চলের অধিকাংশ পরিবারের দুই-একজন করে সদস্য দেশের বিভিন্ন স্থানে নানা পেশায় কাজ করে আয় করতেন। তাদের আয় দিয়ে সংসারের খরচ চলতো। কিন্তু করোনা পরিস্থিতি দেখা দিলে এসব মানুষ বাড়িতে ফিরে এসেছেন এবং এখনো বাড়িতে অবস্থান করছেন। 

এসব মানুষ এখন কর্মহীন অবস্থায় ঘরে বসে থাকায় সংকট আরও বাড়ছে।  এসব পরিবারের কিছু পরিবার ত্রাণের চাল আলু পেয়েছেন, কিছু পরিবার বিশেষ ওএমএস ও খাদ্য বান্ধক কর্মসুচির সুবিধাভোগ করছেন তবে যে পরিমাণে সহায়তা পাচ্ছেন কিংবা পেয়েছেন তা দিয়ে তাদের সংসার চলছে না।

‘এনজিওগুলো বিভিন্নভাবে খাদ্য সহায়তা করলেও তারা নির্দিষ্ট এলাকায় নির্দিষ্ট পরিমাণে দিচ্ছে,’ জানিয়ে তিনি বলেন, যেহেতু এসব মানুষ দিনমজুর শ্রমিক আর সাধারণ পেশাজীবির তাই তাদের কারিগরী কর্মে কোন দক্ষতা নেই। ‘এই মুহূর্তে এসব মানুষের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থান তৈরি একটি বড় চ্যালেঞ্জ,’ ‘এসব মানুষকে কৃষি উৎপাদনমুখি কাজে লাগানো যেতে পারে আর এজন্য সরকারকে পরিকল্পনা নিতে হবে,’ তিনি জানান।

জেলা প্রশাসক মো. আবু জাফর বলেন, জেলায় এ পযর্ন্ত কর্মহীন অসহায় দুস্থ ১ লাখ ৫৮ হাজার ৫১১ পরিবারের মাঝে ১,৫৬৮ মেট্রিক টন চাল, নগদ ৭৫ লাখ ৪৯ হাজার ৪৪৫ টাকা ও শিশু খাদ্য ৩০ লাখ টাকার বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়া বিশেষ ওএমএস ও খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতায় ২ লাখ ৭১ হাজার ৩০৫ পরিবার সুবিধাভোগ করছে। হাতে পর্যাপ্ত খাদ্য সহায়তা, নগদক্যাশ রয়েছে তাই কোথাও প্রয়োজন হলে তাৎক্ষণিক মোকাবিলা করা যাবে বলে তিনি জানান।

Comments

The Daily Star  | English
government changed office hours

Govt office hours 9am-3pm from Sunday to Tuesday

The government offices will be open from 9:00am to 3:00pm for the next three days -- from Sunday to Tuesday -- this week, Public Administration Minister Farhad Hossain said today

26m ago