রাজশাহীতে করোনা পরীক্ষার অপ্রতুল সুবিধা

চাপ সামলাতে নমুনা সংগ্রহ ‘স্থগিত’

Corona_Booths_Set_Up.jpg
ছবি: সংগৃহীত

রাজশাহীর চারঘাট উপজেলায় মারা যাওয়ার ১৬ দিন আগে গত ৬ জুন মনসুর রহমানের করোনা শনাক্ত হয়। তারও ছয় দিন আগে তিনি পরীক্ষার জন্য নমুনা দিয়েছিলেন। সেই ছয় দিন তিনি সব ধরনের সামাজিকযোগাযোগ রক্ষা করেছেন। করোনা শনাক্ত হওয়ার পরে তাকে হোম আইসোলেশনে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছিল।

মনসুর রহমানের বয়স ৪৮ বছর। তিনি রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের গাড়ি চালক। মে মাসের মাঝামাঝিতে তিনি চারঘাটে তার বাড়িতে আসেন। কাজে যোগ দেওয়ার জন্য তার করোনা পরীক্ষার প্রয়োজন হয়।

চারঘাট উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা আশিকুর রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘তার কোনো উপসর্গই ছিল না। তাকে করোনা মুক্ত বলার আগে অন্তত আরও দুবার পরীক্ষা করানোর দরকার ছিল। প্রথমবার ১৪ দিন পরে এবং এর সাত দিন পরে। কিন্তু তার প্রথমবারের পর আর পরীক্ষা করা সম্ভব হয়নি। কারণ আমাদের বারবার বলা হচ্ছিল, হিসাব করে নমুনা সংগ্রহ করতে। করোনা পরীক্ষার চাপ বেড়ে যাওয়ার কারণে হিসাব করে নমুনা সংগ্রহ করতে বলা হয়।’

তিনি বলেন ‘যেহেতু তার কোনো উপসর্গই ছিল না এবং একই অবস্থায় তিনি প্রায় তিন সপ্তাহ অতিবাহিত করার উপক্রম ছিলেন, সেই কারণে তার নমুনা সংগ্রহ করা আমাদের কাছে কম গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছিল। যেখানে উপসর্গ থাকার পরও অনেকের নমুনাই আমরা সংগ্রহ করতে পারছিলাম না।’

নমুনা পরীক্ষা নিশ্চিত না হলেও ২১ জুন মনসুর ধরে নেন তিনি করোনা মুক্ত হয়েছেন। তিনি বাড়ি থেকে বের হয়ে বাইরে ঘুরেও আসেন। পরদিন সকালে হঠাৎ তার মৃত্যু হয়।

তার মৃত্যুর সুনির্দিষ্ট কারণ সেখানকার চিকিৎসকরা বলতে পারেননি। তারা বলেছেন, মনসুর হৃদরোগে ভুগছিলেন এবং চাকরির প্রয়োজনে ‘করোনা মুক্ত’ সনদের জন্য উদ্বিগ্ন ছিলেন।

মনসুরের মৃত্যুর পরে চারঘাট উপজেলায় কোভিড-১৯ পজিটিভ শনাক্ত রোগীরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। পরবর্তী পরীক্ষার জন্য তারা স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন।

স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা বলেছেন, করোনা পরীক্ষার সুবিধা অপ্রতুল হওয়ার কারণে রাজশাহী বিভাগের জেলাগুলোতে করোনা শনাক্ত করায় মাত্রাতিরোক্ত দেরি হচ্ছে। যেহেতু করোনা শনাক্তের আগে কাউকে কোয়ারেন্টিন বা আইসোলেশনে পাঠানো সম্ভব হচ্ছে না, তাই সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে সংক্রমণের উপসর্গ নেই এমন রোগীদের পরবর্তী ধাপে পরীক্ষা না হওয়ায় তাদের মানসিক স্বাস্থের ওপর প্রভাব পড়ছে।

রাজশাহী, বগুড়া ও সিরাজগঞ্জে সরকারি ব্যবস্থাপনায় মাত্র চারটি আরটি পিসিআর মেশিনের মাধ্যমে প্রতিদিন বিভাগের আটটি জেলার কমপক্ষে ৫৬৪টি নমুনা পরীক্ষা হচ্ছে বলে জানান রাজশাহী বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. গোপেন্দ্র নাথ আচার্য্য।

তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘প্রতিদিন ৫৬৪টি নমুনা পরীক্ষা হলেও অন্তত দেড় হাজার নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে। সেগুলো বিভাগের চারটি পরীক্ষাগারে পাঠানো হচ্ছে। সেগুলোতে না হলে ঢাকায় পাঠানো হচ্ছে। অপ্রতুল পরীক্ষা সুবিধার কারণে অতিরিক্ত চাপ সামলাতে অনেক স্থানে করোনা পরীক্ষা স্থগিত রাখতে হচ্ছে।’

রাজশাহীর সিভিল সার্জন একটি দাপ্তরিক আদেশে ১৮ জুন থেকে পাঁচ দিনের জন্য নয়টি উপজেলায় নমুনা সংগ্রহ স্থগিত রাখার নির্দেশ দেয়।

এ প্রসঙ্গে রাজশাহীর সিভিল সার্জন ডা. এনামুল হক বলেন, ‘রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের একটি চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে তিনি এ রকম আদেশ দিয়েছেন।’

তিনি বলেন, ‘চিঠিতে বলা হয়েছিল, কমপক্ষে পাঁচ দিন নমুনা সংগ্রহ স্থগিত না রাখলে হাসপাতালের পক্ষে পরীক্ষার জন্য নমুনা গ্রহণ করা সম্ভব হবে না। নির্দশনা দেওয়ার পরেও জরুরি ভিত্তিতে আমাদের ৫০টি নমুনা সংগ্রহ করতে হয়েছে। কিন্তু সেগুলো আমরা এখনো কোথাও পরীক্ষা করাতে পারিনি।’

নওগাঁর সিভিল সার্জন ডা. মো. আখতারুজ্জামান জানিয়েছেন, তারা এপ্রিলের পর থেকেই রাজশাহী বিভাগের পরীক্ষাগারগুলো ব্যবহার করতে পারছেন না। সপ্তাহে গড়ে অন্তত ছয় শ নমুনা ঢাকায় পাঠাচ্ছেন।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. জাহিদ নজরুল চৌধুরী বলেন, ‘প্রতিদিন গড়ে এক শটি নমুনা রাজশাহীতে পাঠানো হয়। তবে গত ১২ জুন থেকে রাজশাহীতে নমুনা পরীক্ষা হচ্ছে না। রাজশাহী থেকে ঢাকায় থেকে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে।’

নাটোরের সিভিল সার্জন ডা. মিজানুর রহমান বলেন, তাদের অন্তত তিন শ নমুনা রাজশাহী পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে কিন্তু রিপোর্ট মিলছে না।

রাজশাহী মেডিকেল কলেজের করোনা ল্যাবরেটরির প্রধান ও ভাইরোলজি বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক সাবেরা গুলনাহার বলেন, তাদের ল্যবরেটরিতে প্রতিদিন ১৮৮টি নমুনা পরীক্ষা হচ্ছে। চাপ আছে, তবুও নমুনা গ্রহণ বন্ধ করা হয়নি, পরীক্ষাও থেমে নেই।

তিনি বলেন, ‘তাদের মেশিনটিতে দিনে আরও ১৮৮টি নমুনা পরীক্ষা করা যাবে, কিন্তু তার জন্য প্রয়োজনীয় জনবল নেই। দক্ষ জনবল ও মেশিনের অপ্রতুলতায় ভোগান্তিও বাড়ছে।’

গত ১৯ জুন রাতে পাবনা থেকে করোনা সংক্রমণের উপসর্গ নিয়ে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন হাফিজুর রহমান। ঘণ্টা খানেক পরেই তার মৃত্যু হয়। হাফিজুর রহমানের স্বজনরা জানিয়েছেন, তিনি করোনায় আক্রান্ত কি না নিশ্চিত হতে গত ১৪ জুন পাবনায় নমুনা দিয়েছিলেন। মৃত্যুর চার দিন পরেও হাফিজুর রহমানের নমুনা পরীক্ষার ফলাফল পাওয়া যায়নি।

আরও পড়ুন:

রাজশাহীর ৬ জেলায় নেই আইসিইউ

Comments

The Daily Star  | English

Power grid failure causes outage across 21 districts

According to the Power Grid Bangladesh PLC, the situation has since returned to normal

6h ago