কিট সংকটে করোনা টেস্ট ব্যাহত
দেশে যখন প্রতিদিনিই করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তি ও মৃতের সংখ্যা বাড়ছে তখন করোনা পরীক্ষায় কিটের স্বল্পতা এই মহামারি নিয়ন্ত্রণে প্রধান প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কিটের সংখ্যা বিবেচনায় দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান নিম্নে। দেশে কিটের অভাবে কয়েকটি ল্যাবরেটরিতে ইতোমধ্যে করোনা পরীক্ষা স্থগিত রাখতে হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ক্রান্তিকালে কিটের সংকট ভীষণ উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। কেননা, এর কারণে শুধু আক্রান্ত ব্যক্তিদের শনাক্ত করাই বিলম্বিত হচ্ছে তা নয়, কোনো আক্রান্ত ব্যক্তি সুস্থ হয়ে উঠেছেন কিনা তাও জানা যাচ্ছে না।
ডেইলি স্টারকে তারা বলেন, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দেশের জনসংখ্যার বিচারে যথেষ্ট সংখ্যক মানুষের করোনা পরীক্ষা করছে না। এখনো প্রতিদিন করোনা পরীক্ষা ১৭ হাজারের মধ্যে রয়েছে যা কিনা অন্তত ২০ হাজার হওয়া উচিত।
স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের হিসাবে, গতকাল পর্যন্ত দেশে ৬ লাখ ৬০ হাজার ৪৪৪ নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে।
ওয়ার্ল্ডওমিটারের হিসাবে বাংলাদেশে প্রতি ১০ লাখ লোকের মধ্যে ৪ হাজার ২৯ জনের করোনা পরীক্ষা করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে এই সংখ্যা ৮৯ হাজার ৩৫১ জন, ইতালিতে ৮৩ হাজার ৫৮৫ জন এবং ভারতে ৫ হাজার ৩২৯ জন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকার প্রতি ২৫০ জনে একজনকে পরীক্ষা করতে পারছে। দেশে করোনা মহামারির প্রকৃত চিত্র তুলে ধরতে এই সংখ্যা খুবই নগণ্য।
কিট সংকট
কিট স্বল্পতার কারণে নারায়ণগঞ্জের ৩০০ শয্যা সরকারি হাসপাতালে গত পাঁচ দিন থেকে করোনা পরীক্ষা বন্ধ আছে।
গতকাল হাসপাতালের সুপারিনটেনডেন্ট গৌতম রায় ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘প্রতিদিন ২৮০ নমুনা পরীক্ষার সক্ষমতা আমাদের আছে। চাহিদা অনেক। কিন্তু, কিট সংকটের কারণে আমরা চাহিদা মেটাতে পারছি না।’
তিনি আরও জানান, গত মঙ্গলবার ১ হাজার ৯২০টি কিট এসেছিল। তা দিয়ে সপ্তাহ খানেক চলা যেতে পারে। কর্মকর্তারা আরও কিট চেয়েছেন।
গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দিন আহমেদ মেডিকেল কলেজ তীব্র কিট সংকটের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে চিঠি দিয়েছে।
তলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক আসাদ হোসেন ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘গত মঙ্গলবার আমরা বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়কে অবহিত করেছিলাম। এরপর কিছু কিট পেয়েছি। এখনকার মতো সমস্যার সমাধান হয়েছে।’
কলেজের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের প্রধান ও সহকারী অধ্যাপক এসকে সাইফুল আলম ডেইলি স্টারকে জানান, তারা প্রতিদিন ১৮৮টি নমুনা পরীক্ষা করতে পারেন। কিন্তু, কিট স্বল্পতার কারণে এখন সেই সংখ্যা ৭০ থেকে ৮০ তে নেমে এসেছে।
তিনি আরও জানান, তার টিমের হাতে কয়েকটি ইউরোপীয় কিট এসেছে। কিন্তু, সেগুলো ব্যবহার করার আগে টিমের সদস্যদের প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। ‘আশা করছি, আগামী শুক্রবার সেগুলো ব্যবহার করতে পারবো’, যোগ করেন তিনি।
সম্প্রতি, ক্ষমতাসীন দলের একজন সংসদ সদস্য কিটের অভাবে তিন জেলায় করোনা পরীক্ষা বন্ধ রাখায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
গত সোমবার তার ভেরিফাইড ফেসবুক পেজে লাইভে এসে নোয়াখালী-৪ আসনের সংসদ সদস্য একরামুল করিম অভিযোগ করেন, কিটের অভাবে নোয়াখালী, ফেনী ও লক্ষ্মীপুর জেলায় করোনা পরীক্ষা বন্ধ আছে।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় কমিটির সদস্য একরামুল বলেন, ‘আমি জানি বাংলাদেশে তিনটা-চারটা কোম্পানি-ব্যবসায়ী, প্রায় ১০ লক্ষের মতো কিট তারা এনে রেখেছে। তারা দিতে পারছে না “মিঠু সিন্ডিকেটের” কারণে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের “মিঠু সিন্ডিকেট” যতক্ষণ পর্যন্ত ভাঙা না যাবে এই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কখনোই ভালো অবস্থানে থাকবে না।’
আইইডিসিআরের তথ্যে জানা যায় যে ‘কিটের অভাবে’ জামালপুর ও ঢাকার কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতালে করোনা পরীক্ষা বন্ধ আছে।
বিশেষজ্ঞদের মত, এই মহামারিকালে দেশের বিপুল জনসংখ্যার বিপরীতে করোনা পরীক্ষার সক্ষমতা খুবই অপ্রতুল। এখন করোনা পরীক্ষার ব্যবস্থা প্রতিদিনই বাড়ানো উচিত।
আইইডিসিআর পরামর্শক ও এপিডেমিওলজিস্ট মুশতাক হোসেন ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘প্রতিদিন যে সংখ্যক পরীক্ষা করা হচ্ছে তা খুবই নগণ্য। আমাদের এই সংখ্যা ৫০ হাজারে নেওয়া উচিত।’ কিন্তু, তা পিসিআর মেশিনে করা সম্ভব নাও হতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
তিনি মনে করেন, করোনা পরীক্ষার যন্ত্র আমদানি করা হলেও তা সরবরাহে সমস্যা হতে পারে। ‘তাই আমাদের স্থানীয়ভাবে উৎপাদনে যেতে হবে অথবা পরীক্ষার অন্য কোনো ব্যবস্থা নিতে হবে।’
করোনা প্রতিরোধে গঠিত জাতীয় কারিগরি উপদেষ্টা কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ শহীদুউল্লাহ ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘প্রতিদিন কতজনের পরীক্ষা করা দরকার তা ঠিক করা মুশকিল। আক্রান্তের সংখ্যা দেখে তা ঠিক করতে হবে।’
‘আমরা বলছি এখন প্রতিদিন অন্তত ২০ হাজার নমুনা পরীক্ষা করা দরকার,’ যোগ করেন তিনি।
গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলেছে, ১৭ হাজার ২৪৫ নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে ১৬ হাজার ৪৩০টি পরীক্ষা করা হয়েছে। দেশের ৬৬টি ল্যাবে সেগুলো পরীক্ষা করা হয়েছে।
কিট সংকটের বিষয়ে ডা. মোহাম্মদ শহীদুউল্লাহ বলেন, সরকারকে অন্তত ২ লাখ কিট হাতে রাখতে হবে। কেননা, যে কোনো সময় কিট সরবরাহ ব্যাহত হতে পারে। এছাড়া, অন্যান্য জায়গা থেকেও কিট সংগ্রহ করার বিষয়টি বিবেচনায় রাখতে হবে।
স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা মনে করেন, সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো পিসিআর মেশিনে একদিনে বেশি সংখ্যক নমুনা পরীক্ষা করা যায় না।
ঢাকার একটি পরীক্ষাগার ডিএনএ ল্যাব লিমিটেডের সক্ষমতার উদাহরণ টেনে তারা বলেন, এই প্রতিষ্ঠানটির হাতে ৫০০ কিট রয়েছে। তা দিয়ে তারা তিন দিনের মতো চলতে পারবে। এরপর, তাদের আরও কিট সংগ্রহ করতে হবে।
প্রতিষ্ঠানটির এক শীর্ষ কর্মকর্তা গোবিন্দ চন্দ্র ঘোষ বলেন, ‘কিট সংকট প্রতিদিনই বাড়ছে।’
স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা বলেন, কিটের কোনো সংকট নেই। কিটের অভাবে কোথাও পরীক্ষা বন্ধ হবে না।
স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদ ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘এই মুহূর্তে আমাদের কাছে ১ লাখ ২ হাজার কিট আছে। আরও কিট আসছে। দেশে কিটের কোনো সংকট নেই।’
তিনি আরও বলেন, প্রতিদিনই পরীক্ষার সংখ্যা বাড়ছে। আরও অনেক জেলাকে করোনা পরীক্ষার আওতায় আনা হচ্ছে।
Comments