প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা ও এসডিজি অর্জন: কারিকুলাম নিয়ে ভাবনা
শিক্ষা মানুষের সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার। ব্রিটিশ আমলে প্রাথমিক শিক্ষার গোড়াপত্তন হলেও পরবর্তীতে পাকিস্তান সরকার তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) শিক্ষাক্ষেত্রে তেমন কোনো নজর দেয়নি। কারণ, তারা জানতো, বাঙালিরা শিক্ষিত হলে তাদের মসনদ টিকিয়ে রাখা দুষ্কর হয়ে যাবে।
১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সরকার শিক্ষাক্ষেত্রে নজর বাড়ায়। শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন, সমাজ ও দেশ গঠনে শিক্ষার গুরুত্ব অনুধাবন করে তৎকালীন সরকার ১৯৭২ সালে ড. কুদরাত-এ খুদার নেতৃত্বে শিক্ষা কমিশন গঠন করে এবং পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা হয়।
সরকার ৩৬ হাজার ৬৬৬টি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে সরকারিকরণ করে যুগান্তকারী ভূমিকা নেয়। প্রাথমিক শিক্ষার আরও উন্নয়নে ১৯৯২ সালে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা বিভাগ গঠিত হয়। পরবর্তীতে ২০০৩ সালে এই বিভাগকে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পরিণত করে তৎকালীন সরকার। যার মূল লক্ষ্য ছিল বিদ্যালয়ে শিশুদের ভর্তি হার বৃদ্ধি, শিক্ষায় ছেলে-মেয়ের সমঅধিকার ও গুণগত মান বৃদ্ধি।
সরকার প্রাথমিক শিক্ষাকে এগিয়ে নিতে ২০১৩ সালে ২৬ হাজার বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারিকরণ করে। যার মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষায় নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। জাতিসংঘ বিশ্বের নিরাপত্তা, সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে ২০০০ সালে সহস্রাব্দ উন্নয়ন ঘোষণা করে, যার আটটি লক্ষ্য ছিল। বাংলাদেশ এই লক্ষ্য অর্জনে সাফল্য লাভ করেছে অনেক ক্ষেত্রে। এই উন্নয়ন ধরে রাখতে জাতিসংঘ এসডিজি (টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা) ঘোষণা করে যার ৪ নম্বর অভীষ্টে রয়েছে গুণগত শিক্ষা। গুণগত শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের জ্ঞান ও দক্ষতা বৃদ্ধি, যে কোনো পরিবেশ খাপ খাওয়ানো কৌশল শিখিয়ে শিক্ষার গুণগত মান বাড়ানো ও সঠিক শিক্ষা লাভের সুযোগ তৈরির চেষ্টা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ সরকার এসডিজির ১৭টি অভীষ্টের মধ্যে অন্যতম একটি গুণগত শিক্ষা বিস্তারে কাজ করছে। সাধারণত ৫/৬ থেকে ১১/১২ বছরের ছেলে-মেয়েরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ালেখা করে। প্রাথমিক শিক্ষার ওপর শিশুর সামনের দিনের ভবিষ্যৎ অনেকটা নির্ভর করে। তাই সরকার এসডিজি লক্ষ্য অর্জন ও দেশের ভবিষ্যৎ উন্নয়নে প্রাথমিক শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিয়ে বিনা মূলে বই বিতরণ, উপবৃত্তি, ফিডিং ব্যবস্থা চালু করেছে। নয়টি বিষয়কে পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যার মধ্যে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়, ধর্ম ইত্যাদি বিষয়গুলো রয়েছে।
কিন্তু, এতকিছুর পরেও শিক্ষার্থীরা গুণগত শিক্ষা পাচ্ছে না, এমনটাই মনে করছেন অনেক বিশেষজ্ঞ। কিন্তু, কেন? প্রাথমিকে শিক্ষার্থীর তুলনায় শিক্ষকের সংখ্যা কম, শিশুদের পরিবেশবান্ধব অবকাঠামোর অভাব, শিক্ষকদের সঠিক প্রশিক্ষণ ও ক্লাসে তা বাস্তবায়নের অনীহা, শিক্ষকদের সম্মান ও সুযোগ-সুবিধার ঘাটতি, শিক্ষায় আনন্দময় পরিবেশ তৈরি করতে না পারা, বিদ্যালয়ে পাঠাগার ও হাতে-কলমে শিক্ষার অভাব, দারিদ্র্য ও অভিভাবকদের আন্তরিকতার অভাবকে মোটা দাগে মূল কারণ হিসেবে ধরা যেতে পারে।
বিশ্ব ব্যাংকের একটি প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশের ৬৫ শতাংশ শিক্ষার্থী বাংলাই পড়তে পারে না। ইংরেজি ও গণিতের দুর্বলতা এর চাইতেও বেশি। প্রাথমিকে প্রায় শতভাগ শিশু ভর্তি হলেও মাধ্যমিকে ঝড়ে পড়ছে তারা। ২০১৮ সালে ঝড়ে পড়ার হার ছিল ১৮ শতাংশের বেশি। যার মূলে রয়েছে উপরিউক্ত কারণগুলো। ইউএসএইড’র ফান্ডিংয়ে সেভ দ্য চিলড্রেনের ২০১৮ সালে করা একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ৪৪ শতাংশ শিশু প্রথম শ্রেণিতে পড়লেও তারা কোনো শব্দ পড়তে পারে না। ২৭ শতাংশ শিশু তৃতীয় শ্রেণিতে পড়লেও কোনো কিছু পড়ে অর্থ বুঝতে পারে না। এইসব কারণে শিশুরা একই ক্লাসে বারবার পড়ছে এবং ২০ শতাংশ শিশু স্কুল থেকে ঝরে পড়ছে।
ক্যাম্প ফর পপুলার এডুকেশনের নির্বাহী সদস্য রাশেদা কে চৌধুরী বলেছেন, ‘যদিও প্রাথমিক শিক্ষা সম্পূর্ণ ফ্রি এবং বইও সরকার বিনা মূল্যে বিতরণ করে, তারপরও একটি বড় অংশের শিশুরা যেমন: চর অঞ্চল, হাওড় অঞ্চল, পাহাড়ি এলাকার শিশুরা এই শিক্ষার সুবিধা থেকে বঞ্চিত। খুব সামান্য খাটুনিতে স্কুলে যে কোনো রকমে গা-ছাড়াভাবে পড়ানো, নিম্নমানের শিক্ষক প্রশিক্ষণ, শিশুদের পড়াশোনায় আগ্রহী করে তোলার অক্ষমতাই আসলে শিশুদের স্কুল থেকে ঝরে পড়ার মূল কারণ।’
সরকারিভাবে শিশুদের শিক্ষার অগ্রগতি নিরূপণের লক্ষ্যে প্রতি বছর একটি পরীক্ষা হয়। তাতে দেখা গেছে, পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত ২৫ থেকে ৪০ শতাংশ শিশুর বাংলা, ইংরেজি ও গণিতের প্রাথমিক জ্ঞান নেই। তার মানে তারা বাংলা-ইংরেজি পড়তে এবং গণনা করতে পারে না।
এই কঠিন সত্যের সন্ধানে আমরা কয়েকটি স্কুলে যোগাযোগ করি ও এমন কয়েকটি সংস্থার সঙ্গে কথা বলি যারা বর্তমানে গুণগত শিক্ষা নিশ্চিতকরণে কাজ করছে। তার মধ্যে যাদের কাজ একটু ভিন্ন ধরনের মনে হয়েছে, তাদের মধ্যে অন্যতম হলো— গ্রো ইউর রিডার। আমাদের দেশের অধিকাংশ শিশুই ইংরেজি পড়তে পারে না। এই বিশ্বায়নের যুগে টিকে থাকার জন্য আমাদের সবার দরকার সবার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা। কিন্তু, ইংরেজি মাধ্যম ছাড়া সেটা অনেকটা অসম্ভব। এই প্রতিষ্ঠানটির (গ্রো ইউর রিডার) অনেকগুলো কাজের মধ্যে শিশুদের সঠিক পদ্ধতিতে ইংরেজি পড়ার কৌশল শেখানো একটি। তারা শিশুদের মননকে জাগিয়ে তোলার মাধ্যমে শিশুদের শিক্ষা দিয়ে থাকে।
একেক শিশুর শেখার পদ্ধতি একেক রকম। কেউ লিখে, কেউ এঁকে আবার কেউবা গল্প শুনে শিখতে পছন্দ করে। এই বিষয়গুলোকে মাথায় রেখে তারা নিজস্ব কারিকুলাম ‘রিডিং সিক্রেট’ তৈরি করেছে। রিডিং সিক্রেট কারিকুলামটি এমনভাবে সাজানো, যা শিক্ষকদের জন্য অনুসরণ করা খুবই সহজ। এমনকি শিশুরাও অনায়াসে অন্য শিশুকে এই পদ্ধতিতে ইংরেজি পড়া শেখাতে পারবে। পুরো বইয়ে পর্যায়ক্রমিকভাবে সব কৌশল সাজানো। সঙ্গে ইংরেজি গল্পও আছে। যাতে শিশুরা কেমন শিখছে সেটাও যাচাই করা যায়।
অভিভাবকদের জন্যও রিডিং সিক্রেট বইটি খুবই শিক্ষাসহায়ক হবে। কারণ তারাও শিশুকে ঘরে বসেই ইংরেজি পড়া শেখার প্রাথমিক ধারণা দিতে পারবেন এই কারিকুলাম অনুসরণ করে। গ্রো ইউর রিডার ইতোমধ্যে চারটি প্রাইমারি স্কুলে এই কারিকুলামে ৩৩০ জন শিশুকে ইংরেজি পড়া শিখিয়েছেন। তাতে তারা ইতিবাচক ফলাফল পেয়েছে। তাদের নিজস্ব কারিকুলাম ‘রিডিং সিক্রেট’ প্রয়োগের আগে শিশুদের ইংরেজি পড়ার দক্ষতা এবং আট মাস পরের অবস্থার পার্থক্য দেখেই বোঝা যায় রিডিং সিক্রেট বইটির ইতিবাচক প্রভাব।
এখানে ডায়াগনস্টিক মানে রিডিং সিক্রেট বইটি পড়ানো শুরুর আগের অবস্থা বোঝানো হয়েছে। আর শিশুদের রিডিং দক্ষতাকে মোট ছয়টি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যারা একেবারেই রিডিং পারে না, তারা আর্লি ইমারজেন্ট এবং ধাপে ধাপে দক্ষতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ইমারজেন্ট, আর্লি ফ্লুয়েন্ট, ফ্লুয়েন্ট, ট্রানজিশনাল ও অ্যাডভান্স লেভেলে যাবে। ওপরের গ্রাফটি দেখলে আপনারা বুঝতে পারবেন আর্লি ইমারজেন্ট লেভেলে রিডিং সিক্রেট পড়ানোর আগে ছিল ৬৭ শতাংশ শিশু, কিন্তু, পরে তা কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৪ শতাংশে। অর্থাৎ শিশুদের রিডিং পড়ার দক্ষতা অভূতপূর্ব হারে বেড়েছে। রিডিং সিক্রেট বইটি নিয়ে কয়েকজন শিক্ষকের মন্তব্য এমন, ‘ইংরেজি রিডিং পড়া শেখানোর জন্য একজন শিশুকে শব্দ শুনতে হবে, তারপর অক্ষর চিনতে হবে। কিন্তু, এই সামান্য ভুলটির জন্য অনেক শিশুকে এখনো আমরা রিডিং পড়া শেখাতে পারছি না। যা এই বইটি থেকে আবার আমরা অনুধাবন করেছি।’ দেশের বাইরে যারা শিক্ষা নিয়ে কাজ করেন, তারাও রিডিং সিক্রেট নিয়ে অনেক প্রশংসনীয় মন্তব্য করেছেন। তাদের মধ্যে আছে ইউকিমিডিয়ার মতো প্রতিষ্ঠানও।
গ্রো ইউর রিডার ২০১৬ সাল থেকে কার্যক্রম শুরু করেছে। সারাদেশে মোট ২০টি লাইব্রেরি ও পাঁচ হাজার বইয়ের মধ্যমে তারা ছয় হাজার শিশু পাঠকের মধ্যে আনন্দময় শিক্ষা ছড়িয়ে দিচ্ছে। তারা মনে করে, শুধু বিনা মূল্যে বই দিলেই হবে না, সেই বইয়ের সঠিক ব্যবহার, মানে শিশুরা পড়ছে কি না, তার দায়িত্বও আমাদের নিয়ে হবে। অন্যথায়, এই হাজার হাজার বই শুধু মূল্যহীন কাগজের স্তূপে পরিণত হবে।
মো. শাহিন রেজা, শিক্ষক
Comments