সিলেটে আইসিইউ সুবিধা সাধারণের জন্য দুষ্প্রাপ্য, সামর্থ্যের বাইরে
৭৫ বছর বয়সী সৈয়দ শফিকুল আলম হৃদরোগ এবং জ্বর নিয়ে গত ১১ জুন দিবাগত রাতে ভর্তি হন সিলেটের বেসরকারি নর্থ ইস্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনাভাইরাস রোগীদের জন্য নির্ধারিত ওয়ার্ডে।
পরদিন তার অবস্থা খারাপ হলে তাকে নেয়া হয় কোভিড-১৯ আক্রান্ত ও সন্দেহভাজনদের জন্য নির্ধারিত ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (আইসিইউ)। এখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৪ জুন মৃত্যুবরণ করেন তিনি। পরদিন জানা যায় যে তিনি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ছিলেন।
তার নাতি ফখরুল আলম জানান একদিন সাধারণ ওয়ার্ড এবং দুদিন আইসিইউতে চিকিৎসা খরচ এবং ওষুধ বাবদ খরচ লাখ টাকা ছাড়িয়েছে।
হবিগঞ্জের নবীগঞ্জের সৈয়দ শফিকুল আলমের পরিবারের এ সামর্থ্য থাকলেও খুব কম মানুষের পক্ষেই এই বিপুল ব্যয় বহন সম্ভব।
গত ৮ জুন সিলেটের বেসরকারি হাসপাতালে কোভিড-১৯ চিকিৎসা সংক্রান্ত এক সংবাদ সম্মেলনে জেলার বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়গনস্টিক সেন্টার মালিক সমিতির সভাপতি ডা. নাসিম আহমেদ সাধারণ রোগীদের জন্য বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যয়বহুল জানিয়ে সরকারি হাসপাতালে যাওয়ার পরামর্শ দেন।
কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, পুরো সিলেট বিভাগে কোভিড রোগীদের জন্য ডেডিকেটেড ৪৬টি আইসিইউ শয্যার মধ্যে ৩২টিই বেসরকারি হাসপাতালে। এর মধ্যে নর্থ ইস্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২০টি এবং মাউন্ট এডোরা হাসপাতালের ১২টি আইসিইউ শয্যা রয়েছে। সরকারি হাসপাতালের মধ্যে মাত্র ১৪টি আইসিইউ শয্যা রয়েছে শহীদ শামসুদ্দিন আহমদ হাসপাতালে।
আইসিইউ যখন দুষ্প্রাপ্য
কোভিড-১৯ ভিন্ন সাধারণ রোগীদের চিকিৎসায় সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১৫টি এবং অন্যান্য বেসরকারি হাসপাতালের প্রায় ৪০টির মতো আইসিইউ শয্যা রয়েছে। এগুলোর সবই সিলেট শহরে অবস্থিত। বিভাগের বাকি তিন জেলার কোথাও, এমনকি হবিগঞ্জের শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও নেই আইসিইউ সুবিধা।
গত ৩১ মে রাতে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার বাসিন্দা ৭০ বছর বয়সী এক নারী স্ট্রোক করলে স্বজনরা তাকে প্রথমে শ্রীমঙ্গল স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং পরে মৌলভীবাজার সদর হাসপাতালে নিয়ে যান।
তার আত্মীয় মাজহারুল ইসলাম বলেন, ‘চিকিৎসকরা দ্রুত আইসিইউতে নেওয়ার পরামর্শ দিলে আমরা সিলেট আসি। কিন্তু এখানে সাতটি বেসরকারি হাসপাতাল ঘুরেও তাকে কোথাও ভর্তি করতে পারিনি। কোথাও বলেছে আইসিইউ নেই, কোথাও করোনাভাইরাস আক্রান্ত সন্দেহে ভর্তি করতে চায়নি। এমনকি একটা অক্সিজেন সিলিন্ডারও দেয়নি কেউ।’
সেই রাতে শেষ পর্যন্ত তাকে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা মৃত ঘোষণা করেন।
‘যদি মৌলভীবাজারে আইসিইউ থাকতো, তাহলে তাকে এতটা সময় নষ্ট করে সিলেট আনতে হতো না, এবং হয়তো তাকে বাঁচানো যেত’, বলেন মাজহারুল ইসলাম।
সিলেট বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক কার্যালয়ের সহকারি পরিচালক ডা. আনিসুর রহমান বলেন, ‘এই মুহূর্তে চাইলেও সিলেট বিভাগের অন্য কোনো জেলায় আইসিইউ শয্যা বাড়ানোর সুযোগ নেই, কারণ দক্ষ অ্যানেস্থেসিয়োলজিস্ট ও অন্যান্য লোকবলের সংকট রয়েছে।’
করোনা আক্রান্ত রোগীদের সেবায় সিলেট জেলায় আরও দুটি হাসপাতাল—খাদিমনগর ৩১ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল এবং দক্ষিণ সুরমা ৩১ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল—আইসোলেশন সেন্টার হিসেবে ব্যবহার শুরু হচ্ছে বলে জানান তিনি।
তবে এ দুটিতে কোনো আইসিইউ শয্যা নেই।
প্রয়োজন আরও ডেডিকেটেড আইসিইউ
ওসমানী মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. আ ফ ম নাজমুল ইসলাম বলেন, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে অন্তত ৫ ভাগ রোগী গুরুতর অসুস্থ হন এবং মোট রোগীর প্রায় ২ ভাগকে আইসিইউতে নেওয়ার প্রয়োজন হয়।’
শুক্রবার (২৬ জুন) পর্যন্ত সিলেট বিভাগে মোট কোভিড-১৯ শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ৩৯১০, যার মধ্যে সুস্থ হয়েছেন ৯৭০ এবং মারা গেছেন ৬৩ জন।
আক্রান্তের অন্তত ২ শতাংশের আইসিইউ প্রয়োজন হলে হিসাব বলছে এই মুহূর্তে আক্রান্ত থাকা ২৮৭৭ জনের মধ্যে ৫৭ জনের আইসিইউ প্রয়োজন হতে পারে।
স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্যমতে, গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সিলেট বিভাগে ১২০ জন ডাক্তার, ৮২ জন নার্স এবং ১৬২ জন স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট কর্মচারী কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়েছেন, যার মধ্যে একজন চিকিৎসক এবং একজনের নার্সের মৃত্যু হয়েছে।
এদিকে সিলেটের কোভিড-১৯ সেবায় নির্ধারিত বেসরকারি হাসপাতালের ৩২টি আইসিইউয়ের প্রায় সবকয়টিতে প্রতিদিন রোগী ভর্তি থাকছে। শহীদ শামসুদ্দিন আহমদ হাসপাতালের আইসিইউ শয্যাও খালি পাওয়া দুষ্কর।
স্বাস্থ্য বিভাগ ও বেসরকারি হাসপাতালের কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্যমতে, বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউ শয্যার সবকয়টিতে ভেন্টিলেটর সুবিধা নেই।
সংক্ষুব্ধ নাগরিক আন্দোলন, সিলেটের সমন্বয়ক আব্দুল করিম কিম বলেন, ‘করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরুর প্রথম পর্যায়েই সরকারের উচিত ছিলো আইসিইউ শয্যা ও দক্ষ জনবল বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া।’
তিনি বলেন, ‘বিত্তশালীরা তবুও কিছু সংখ্যক হলেও বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউ ব্যবহার করতে পারবেন, কিন্তু সাধারণ নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষ কোথায় সেবা পাবে? সরকারের উচিত, এখনই সরকারি হাসপাতালের আইসিইউ শয্যার সংখ্যা বাড়ানো।’
Comments