বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু ও চট্টগ্রামের উন্নয়নের গল্প

বাড়ির কাছে খেলার সময় তিন চাকার একটি যান ধাক্কা দেয় শিশু শাওনকে (৫)। এরপর শাওনের বাবা-দাদা মিলে একের পর এক চারটি হাসপাতাল ঘুরেও তাকে কোথাও ভর্তি করাতে পারেননি। অবশেষে তারা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান। সেখানকার ডাক্তাররা শাওনের কাছে গেলেও, তাকে আর বাঁচানো যায়নি। ১৬ জুন ২০২০। ছবি: রাজীব রায়হান

চট্টগ্রাম শহর এখন উড়ালসড়কের নগরী। হাজারো কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে এসব উড়ালসড়কের পেছনে। তিনটি উড়ালসড়কের পর শহরের বুকে পৌনে চার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হচ্ছে দেশের সবচেয়ে দীর্ঘ ১৭ কিলোমিটারের উড়ালসেতু। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটা কাজে লাগবে মাত্র তিন হাজার মানুষের, যারা বিমানবন্দর আসা-যাওয়া করবেন।

ফ্লাইওভারের পাশাপাশি নির্মাণ করা হচ্ছে দেশের প্রথম টানেল। ২০২২ সালের মধ্যে শেষ হলে সম্ভবত এটি হবে উপমহাদেশের প্রথম টানেল। যার ব্যয় প্রায় দশ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি যাবে। এ ছাড়াও, গত অর্ধ দশকে নগরীতে গড়ে উঠেছে বিলাসবহুল পাঁচতারকা হোটেল। নগরীর পতেঙ্গায়, দামপাড়া ও আগ্রাবাদে আরও কয়েকটির নির্মাণকাজ চলছে।

নীতিনির্ধারকরা সকল মনোযোগ ব্যয় করেছেন এসব দৃশ্যমান উন্নয়নের পেছনে। ফলে মনোযোগ পায়নি একটা জাতির সবচেয়ে প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ খাত— ‘স্বাস্থ্যখাত’। করোনায় পর্যুদস্ত হওয়ার পর এখন হাসপাতালে ঠাঁই পেতে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হচ্ছে চট্টগ্রামের সাধারণ মানুষদের। তদবিরের জোরে সৌভাগ্যবানদের ঠাঁই হলেও হাসপাতালের চিকিৎসা অধরা হয়ে আছে হতভাগ্য আমজনতার।

চিকিৎসা পাওয়া তো পরের কথা, করোনার টেস্ট করাতে গিয়েই চট্টগ্রামের মানুষকে অর্ধ মরণদশায় পড়তে হয়। প্রতিদিন মাত্র চার শ নমুনা পরীক্ষা করা হয়। রিপোর্ট দিতে সময় নেওয়া হয় দুই সপ্তাহ থেকে তিন সপ্তাহ। এমনকি প্রাইভেট হাসপাতালে সাড়ে তিন হাজার টাকা দিয়ে টেস্ট করিয়েও মানুষ সময়মতো রিপোর্ট পাচ্ছে না। এ এক ভয়াবহ অবস্থা!

মার্চে চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ‘চট্টগ্রাম দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে আছে’ বলে সংবাদ সম্মেলন করলেও পরিস্থিতি মোকাবিলায় গাল-সর্বস্ব বুলি ছাড়া কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। অবহেলার সেই দায় চট্টগ্রামবাসী শোধ করছেন তাদের জীবন দিয়ে।

মার্চে চট্টগ্রামের নেতারা, যারা বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে আছেন, তারা চট্টগ্রামবাসীকে আশ্বস্ত করেছিলেন প্রস্তুতি নিয়ে। দফায় দফায় সভা করে তারা জানান দিয়েছেন করোনা মোকাবিলার কথা। এপ্রিলে করোনা শনাক্ত হওয়ার পর থেকে দেখা গেলো হাসপাতালগুলো রোগী ভর্তি করাচ্ছে না।

প্রচণ্ড যুদ্ধের মধ্যে আহতরাও চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হয় না। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধেও আহত মানুষ যতটুকু সম্ভব চিকিৎসা পাচ্ছে। কিন্তু, হাসপাতালের শয্যা খালি থাকলেও চট্টগ্রামের মানুষের চিকিৎসা পেতে যেন যুদ্ধের চেয়ে বেশি বেগ পেতে হচ্ছে। মহামারি মোকাবিলায় পৃথিবীর সব দেশ যেখানে স্বাস্থ্যখাতে সকল শক্তি নিয়োগ করছে, সেখানে আমাদের হাসপাতালগুলো সচেতনভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছে ‘রোগী ভর্তি না করানোর’। চট্টগ্রামের ২০টি বেসরকারি হাসপাতালের শয্যা সংখ্যা প্রায় দুই হাজার। যার মধ্যে অধিকাংশ এখন ফাঁকা পড়ে আছে। ফলে চট্টগ্রামে বিনা চিকিৎসায় মানুষকে প্রাণ হারাতে হচ্ছে।

রোগী ফিরিয়ে দেওয়া রুখতে গঠন করা হলো চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ের নেতৃত্বে একটি নজরদারি কমিটি। এ কমিটি কী নজরদারি করেছে সেটা বোঝা মুশকিল। মুমূর্ষু রোগীদেরকে হাসপাতালগুলো ফিরিয়ে দিয়ে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিলেও এ নজরদারি কমিটিকে নড়াচড়া করতেও দেখা গেলো না। দেখা গেলো না একটা হাসপাতালের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে। সবাই যেন ট্রাজেডির শেষ দৃশ্য দেখার আশায় বসে আছেন!

তারপর একে একে আসল নানা হুংকার, প্রজ্ঞাপন ও উচ্চ আদালতের আদেশ যে, বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে করোনা রোগী ভর্তি করাতে হবে। সেই হুংকার, প্রজ্ঞাপন আর আদালতের আদেশ হাসপাতাল পর্যন্ত পৌঁছাল না। একটা রাষ্ট্রকে কেন জনগণের চিকিৎসার জন্য বেসরকারি হাসপাতাল মালিকদের কাছে হাত পাততে হবে? জনগণের দায় তো রাষ্ট্রের। জনগণকে বাঁচানোর কোনো আয়োজন রাষ্ট্রের কেন নেই? কেন চট্টগ্রামে সরকারি ব্যবস্থাপনায় কোনো হাসপাতাল গড়ে উঠলো না স্বাধীনতার ৪৮ বছর পরেও? কেন বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে এককভাবে স্বাস্থ্যখাত নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ দেওয়া হলো?

এসব প্রশ্নের উত্তর খুব সহজ। স্বাস্থ্যখাতকে কেন্দ্র করে যে ‘উচ্চ মুনাফার খেলা’, সেটার ভাগ নিতে ক্ষমতাবানদের যতটা আগ্রহ, ঠিক ততটাই অনাগ্রহ স্বল্পমূল্যে সরকারি হাসপাতালগুলোতে সাধারণ মানুষের জন্য চিকিৎসাসেবার ব্যবস্থা করা। তাহলে তো মানুষকে বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে ঠেলে দেওয়া যাবে না।

১৯৫৭ সালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার পর গত ৬৩ বছরে নগরীতে আর কোনো নতুন সরকারি হাসপাতাল হয়নি। অবিশ্বাস্য ঠেকলেও এটাই নির্মম বাস্তবতা। যত্রতত্র গড়ে উঠেছে মানহীন বেসরকারি হাসপাতাল। সেই হাসপাতালগুলো চিকিৎসা যা দেয়, তার চেয়ে বেশি মনোযোগ থাকে মানুষকে সর্বশান্ত করার।

‘মরার ওপর খাঁড়ার ঘাঁ’ হিসেবে হাজির হলো অক্সিজেনের সিন্ডিকেট। এ সিন্ডিকেট সব অক্সিজেন বাজার থেকে হাওয়া করে চট্টগ্রামের মানুষের বিপদকে আরও দ্বিগুণ করে দিলো। ভ্রাম্যমাণ আদালত এদের বিরুদ্ধে নামলো বটে, কিন্তু তাদের মজুতদারি বন্ধ করতে পারেনি।

তবে, একটা বিষয় উল্লেখ না করলে নয়। সেটা হলো— এই সংকটেও যেভাবে তরুণরা এগিয়ে এসেছে মানুষের সাহায্যে। আইসোলেশন সেন্টার, মিনি হাসপাতাল, ফিল্ড হাসপাতাল ও অক্সিজেন সরবরাহ করতে যেভাবে তরুণরা এগিয়ে এসেছে, তাতে বাংলাদেশ নিয়ে আশাবাদী হওয়া যায়। এতসব সংকটের মধ্যে মানুষই মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।

চট্টগ্রাম দেশের সমৃদ্ধির স্বর্ণদ্বার। দেশের প্রধান সমুদ্র বন্দর এ শহরে। এ অঞ্চলের মানুষ নিজের মাটিতে চিকিৎসা পেয়ে বাঁচতে চায়। যদি মৃত্যুও হয়, তাহলেও নিজ মাটির সোঁদা গন্ধ থেকে যেন বঞ্চিত হতে না হয়— এটাই তাদের প্রত্যাশা।

লেখক: মোস্তফা ইউসুফ, নিজস্ব সংবাদদাতা (চট্টগ্রাম ব্যুরো), দ্য ডেইলি স্টার

Comments

The Daily Star  | English

Had no discussion on ‘humanitarian corridor’ with UN or any entity: Shafiqul Alam

Regarding the reports of involvement of a major power, he said, these are 'pure and unadulterated' propaganda.

1h ago