কাঁচা চা পাতার মূল্যহ্রাসে লোকসানে ক্ষুদ্র চা চাষি

পঞ্চগড়ে জেলার কাঁচা চা পাতার মূল্য নির্ধারণ কমিটির সিদ্ধান্ত অমান্য করে চা কারখানা মালিকদের সিন্ডিকেটের মাধ্যমে অনিয়মতান্ত্রিকভাবে কাঁচা চা পাতার আকস্মিক মূল্য হ্রাসের অভিযোগ উঠেছে। যার ফলে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ক্ষুদ্র পর্যায়ের চা চাষিরা।
ছবি: কামরুল ইসলাম রুবাইয়াত

পঞ্চগড়ে জেলার কাঁচা চা পাতার মূল্য নির্ধারণ কমিটির সিদ্ধান্ত অমান্য করে চা কারখানা মালিকদের সিন্ডিকেটের মাধ্যমে অনিয়মতান্ত্রিকভাবে কাঁচা চা পাতার আকস্মিক মূল্য হ্রাসের অভিযোগ উঠেছে। যার ফলে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ক্ষুদ্র পর্যায়ের চা চাষিরা।

গতকাল বিকেলে বাংলাদেশ স্মল টি গার্ডেন ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের নেতৃবৃন্দসহ চা চাষিরা পঞ্চগড় প্রেসক্লাবের সম্মেলন কক্ষে সাংবাদিকদের কাছে এসব অভিযোগ করেন।

এদিকে আজ সোমবার বিকেলে জেলা প্রশাসক সাবিনা ইয়াসমিনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জেলা কাঁচা চা পাতার মূল্য নির্ধারণ কমিটি’র এক অনলাইন (ভার্চুয়াল) সভায় প্রতি কেজি কাঁচা চা পাতার মূল্য ১৩ টাকা ৫০ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে। একইসঙ্গে চাষিরা স্থানীয় কারখানাগুলোকে সাড়ে চার পাতা পর্যন্ত কাঁচা চা পাতা সরবরাহ করবে বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

বাংলাদেশ চা বোর্ডের নর্দার বাংলাদেশ প্রকল্পের পরিচালক ড. মোহাম্মদ শামীম আল-মামুন বলেন, ‘প্রতি বছর চায়ের নিলাম বাজারে মোট ৪৫ টি করে নিলামে তৈরি চা বিক্রি হয়ে থাকে। চলতি মৌসূমে পাঁচটি নিলামে পঞ্চগড়ের তৈরি চায়ের গড় মূল্য প্রতি কেজি ১৩১ টাকা ৮৭ পয়সা পাওয়া গেছে। সেই হিসেবে প্রতি কেজি কাঁচা চা পাতার মূল্য ১৪ টাকা ৬৫ পয়সা হয়।’

পঞ্চগড়ে প্রতি কেজি কাঁচা চা পাতা উৎপাদন করতে চাষিদের ১৬ টাকা ৭১ পয়সা খরচ হয়। কিন্তু, করোনা পরিস্থিতিতে কারখানা মালিকদের আপত্তির কারণে মূল্য নির্ধারণ কমিটি প্রতি কেজি কাঁচা চা পাতার মূল্য ১৩ টাকা ৫০ পয়সা নির্ধারণ করেছে।

বাংলাদেশ স্মল টি গার্ডেন ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি দ্য ডেইলি স্টারকে আজ সন্ধ্যায় বলেন, ‘নিলাম অনুযায়ী কাঁচা চা পাতার মূল্য ১৪ টাকা ৬৫ পয়সা হওয়ার কথা থাকলেও কারখানা মালিকদের আপত্তির কারণে ১৩ টাকা ৫০ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে। যা এই মৌসুমের শুরুর দরের চেয়ে পঞ্চাশ পয়সা কম। চাষিদের যেহেতু পাতা দেওয়ার বিকল্প পথ নেই তাই নিরুপায় হয়েই এই সিদ্ধান্ত মেনে নিতে হচ্ছে।’

বাংলাদেশ স্মল টি ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আমিরুল হক খোকন গতকাল বলেছিলেন, ‘গত ২৭ ফেব্রুয়ারি চলতি মৌসুমের জন্য জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে ‘কাঁচা চা পাতার মূল্য নির্ধারণ কমিটি’র এক সভায় প্রতি কেজি কাঁচা চা পাতার মূল্য ১৪ টাকা নির্ধারণ করা হয়। মৌসুম চলাকালে কাঁচা চা পাতার পুনমূল্য নির্ধারণ করার প্রয়োজন দেখা দিলে চট্টগ্রাম ও শ্রীমঙ্গলে তৈরি চায়ের নিলাম বাজারে ১৫ টি নিলামের গড় মূল্যের ভিত্তিতে জেলার এই কমিটির (‘কাঁচা চা পাতার মূল্য নির্ধারণ কমিটি’ যার পদাধিকার বলে জেলা প্রশাসক সভাপতি) মূল্য নির্ধারণ করার কথা। কিন্তু এসব নিয়ম অগ্রাহ্য করে চলতি মৌসুমে কাঁচা চা-পাতা উত্তোলন শুরুর পাচঁটি নিলামের পরপরই গত ২৫ জুন আকস্মিকভাবে কারখানা মালিকরা কোনো সভা ছাড়াই প্রতি কেজি কাঁচা চা পাতার মূল্য ১৪ টাকা থেকে কমিয়ে ১২ টাকা নির্ধারণ করে তা কার্যকর করে।’

তিনি আরও বলেন, ‘নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে কম দামে এবং সরবরাহকৃত মোট পাতার ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কর্তন করে মূল্য প্রদান করছে কারখানা কর্তৃপক্ষ। ফলে, কেজি প্রতি কাঁচা চা পাতার মূল্য পড়ছে মাত্র ৬ থেকে ৭ টাকা। যা থেকে বর্তমানে উৎপাদন খরচ ওঠানোই কঠিন হয়ে পড়েছে।’

তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘পঞ্চগড়ের চা কারখানা মালিকরা তাদের উৎপাদিত ভালো মানের চা চোরাইপথে বেশি দামে বিক্রি করছেন। আর নিম্ন মানের চা নিয়ে যাচ্ছে নিলাম বাজারে। ফলে পঞ্চগড়ের উৎপাদিত চা কেজি প্রতি ১৩০ টাকা থেকে ১৩৫ টাকা মূল্যে বিক্রি হচ্ছে। যা অন্যান্য অঞ্চলের উৎপাদিত চায়ের দামের চেয়ে অনেক কম। নিলাম বাজারে পঞ্চগড়ে উৎপাদিত চায়ের গড় নিলাম মূল্য কম দেখিয়ে তাদের ইচ্ছামত কাঁচা চা পাতার দাম নির্ধারিত হচ্ছে। যার ফলে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ক্ষুদ্র পর্যায়ের চা চাষিরা।’

অথচ এই পঞ্চগড়ের মাটিতে উৎপাদিত কাজী এন্ড কাজী টি’র কারখানায় তাদের উৎপাদিত চায়ের নিলাম মূল্য কেজি প্রতি গড়ে ২০০ টাকার উপরে।

তিনি উল্লেখ করেন, ২০১৮ সালে প্রতি কেজি কাঁচা চা পাতার মূল্য ছিল ৩৯-৪০ টাকা, ২০১৯ সালে তা কমে মৌসুমের শুরুতে ২৪.৫০ টাকা ও পরে ১৭ টাকা। তবে এ বছর তা কমে ১২ টাকায় নেমে আসে। অথচ, চা বোর্ডের হিসাব অনুযায়ী কৃষক পর্যায়ে প্রতি কেজি কাঁচা চা পাতার উৎপাদনে খরচ ১৬.৭১ টাকা।

এই বিষয়ে বাংলাদেশ টি ফ্যাক্টরি ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মোশারফ হোসেন মুঠোফোনে এই অভিযোগ অস্বীকার করে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘চায়ের মূল্য নির্ধারণের বিষয়ে কোন সিন্ডিকেট নেই। করোনার প্রাদুর্ভাবের ফলে ক্রেতা সংকটের জন্য তৈরি চায়ের নিলাম বাজারে ধস নেমেছে। এতে কারখানা মালিকদের লোকসান গুনতে হচ্ছে। কারাখানার লোকসান হলে স্বাভাবিকভাবেই এর প্রভাব চা চাষিদের উপরেও পড়বে।’

করানো পরিস্থিতিতে সভা করতে না পারায় বাংলাদেশ টি ফ্যাক্টরি ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন কারখানা মালিক এবং চাষিদের উভয় পক্ষের কথা ভেবে জরুরিভাবে ১২ টাকা কেজিতে কাঁচা চা পাতা ক্রয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানান মোশারফ ।

তিনি বলেন, ‘সিদ্ধান্ত বহির্ভূত কাঁচা চা পাতা উত্তোলনের কারণে মোট সরবরাহকৃত পাতা থেকে কর্তন করতে বাধ্য হচ্ছেন কারখানা মালিকরা। এছাড়া ভালো মানের চা বাইরে বিক্রি করে খারাপ মানের চা নিলাম বাজারে বিক্রির অভিযোগ ভিত্তিহীন।’

স্থানীয় বাজারে নিম্নমানের ডাস্ট টি বিক্রির কথা স্বীকার করেন তিনি।

বাংলাদেশ চা বোর্ডের নর্দার বাংলাদেশ প্রকল্পের পরিচালক ড. মোহাম্মদ শামীম আল-মামুন জানান, ২০০০ সালে পঞ্চগড়ে চা চাষ শুরু হয়। পঞ্চগড় জেলায় বর্তমানে ৭ হাজার ৫৯৮ একর জমিতে চায়ের আবাদ হচ্ছে। প্রতিবছর এখানে চা চাষ বাড়ছে। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত নিবন্ধিত বড় চা বাগান ৮টি ও অনিবন্ধিত বড় চা বাগান ১৮টি। ছোট চা বাগান ৮৯১টি, অনিবন্ধিত পাঁচ হাজার ১৮ টি ক্ষুদ্র চা বাগান রয়েছে। জেলায় চা প্রক্রিয়াজাতের জন্য কারখানা চালু রয়েছে ১৮টি। গত মৌসুমে পঞ্চগড় জেলায় ৯২ লাখ ৪৯ হাজার ৩২৫ কেজি চা উৎপাদন হয়েছে। এবার এক কোটি কেজি ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা কর হচ্ছে।

চা কারখানা স্থাপনের ব্যাপারে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘গত বছর সরকারের উচ্চ পর্যায়ের একটি দল চা কারখানা স্থাপনের সম্ভাব্যতা যাচাই করে পঞ্চগড়ে একটি সরকারি চা কারখানা স্থাপনের প্রস্তাবনা পেশ করেছে।’

Comments

The Daily Star  | English

Fashion brands face criticism for failure to protect labour rights in Bangladesh

Fashion brands, including H&M and Zara, are facing criticism over their lack of action to protect workers' basic rights in Bangladesh, according to Clean Clothes Campaign (CCC)..One year after a violent crackdown by state actors and employers against Bangladeshi garment workers protesting

5m ago