মাসুদ রানা সিরিজের অল্প কিছু চরিত্র ছাড়া বাকি সবই আমার সৃষ্টি: শেখ আবদুল হাকিম

শেখ আবদুল হাকিম। ছবি: সংগৃহীত

কপিরাইট অফিস থেকে মাসুদ রানা সিরিজের ২৬০টি বইয়ের স্বত্ব পেয়েছেন শেখ আবদুল হাকিম। যা কাজী আনোয়ার হোসেনের নামে ছিল। দীর্ঘদিন নিজে লিখে কাজী আনোয়ার হোসেনের নামে বই ছাপা হলেও তিনি কেন তা মেনে নিয়েছেন এবং এতদিন পর এসে কেন বইয়ের স্বত্ব দাবি করছেন? এমন সব প্রশ্নের জবাব জানতে শেখ আবদুল হাকিমের সঙ্গে কথা বলেছে দ্য ডেইলি স্টার

মাসুদ রানা সিরিজের বইগুলো আপনি যখন লিখেছিলেন, তখন কাজী আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে আপনার কী কথা হয়েছিল? আপনি লিখবেন আর সেটা তার নামে ছাপা হবে। এমন কথা হয়েছিল? নাকি অন্য কিছু?

আমার ভাই শেখ আবদুর রহমানকে কাজী সাহেবের (কাজী আনোয়ার হোসেন) বাসায় নিয়ে গিয়েছিলেন হাশেম খান। সেখানে যাওয়ার পর আমার ভাইকে কাজী সাহেব বলেছিলেন, আপনি কি কুয়াশা সিরিজের বই লিখবেন? আমার ভাই তখন রাজি হয়নি। তিনি নিজে লিখতে না চাইলেও সেখানে আমার কথা বলেন। তখন তারা রাজি হয়। ভাই বাসায় ফিরে আমাকে একটা গল্প বলে বলেন, এটা লিখে দিতে পারলে তোকে ১০০ টাকা দেওয়া হবে। ১৯৬৬ বা ৬৭ সালের ঘটনা এটা। তখন তো ১০০ টাকা মানে অনেক টাকা। আর আমার টাকা দরকার। আমি সারারাত জেগে সেটা লিখে পরদিন ভাই যখন অফিসে যাবে তখন তার হাতে লেখাটা তুলে দেই। ভাই অবাক হয়ে বলেন, লিখে ফেলেছিস? আমি বললাম, হ্যাঁ লিখেছি। সন্ধ্যার সময় কিন্তু টাকা চাই। সেদিন সন্ধ্যায় আমার ভাই আমার হাতে টাকা তুলে দেয়। ভাই আমাকে বলেন, কাজী সাহেব এটা পড়েছেন। তার ভালো লেগেছে। এবার একটা কাহিনি তোকে নিজে থেকে বানাতে হবে।

আমি সেটাও লিখে দিয়েছিলাম। পছন্দ করেছেন লেখাটা। এসব লেখার আগে আমার একটা উপন্যাস লেখা ছিল। সেটা কাজী সাহেবকে পড়তে দিয়েছিলাম। আমার উপন্যাসটা পড়ে আমার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন তিনি। আমি ঠিকানা নিয়ে কাজী সাহেবের বাসায় যাই। সেদিন সেখানে রাহাত খান ছিলেন। আমার লেখার অনেক প্রশংসা করলেন কাজী সাহেব। তার প্রশংসা শুনে আমার ‘মাটিতে পা পড়ছে না’ অবস্থা। তিনি আমাকে লিখে যেতে বললেন। লিখতে থাকলাম।

লেখাগুলো কার নামে ছাপা হচ্ছিল?

কাজী সাহেবের নামেই ছাপা হয়েছে। ভেতরে নাম ছিল আমার।

এই শর্তেই আপনি লিখতে রাজি হলেন? আপত্তি করেননি কেন?

না, আমি আপত্তি করিনি। কয়েকটা বই লেখার পর আমি বুঝতে পারলাম আমার লেখার অনেক চাহিদা। তখন আমি বললাম, আমাকে প্রতি লেখার জন্য ৩০০ টাকা দিতে হবে। তিনি রাজি হলেন। তখন ৩০০ টাকা অনেক টাকা। এক পর্যায়ে আমি আর তার জন্য লিখব না জানিয়ে চলে আসি। চলে আসার প্রায় মাস তিনেক পর একদিন তিনি আমার বাড়িতে এসে হাজির। আমার ভাইও ছিলেন সেখানে। কাজী সাহেব আমাকে মাসুদ রানা লেখার প্রস্তাব দিলে আমার ভাই বলেন, ও তো লিখতেই পারে, প্রতি লেখার জন্য ওকে ৫০০ দিলেই তো পারেন। আলোচনার এক পর্যায়ে কাজী সাহেব বললেন, মান-অভিমানের কিছু নেই। আপনি লেখা শুরু করেন। আমি লিখেছি। আমি যে না জেনে লিখেছি তা না। এর মধ্যে আরও অনেক নাটকীয় ঘটনাই ঘটেছে। আমি বেশ কয়েকবার চলে এসেছি সেখান থেকে।

মাসুদ রানা যখন আপনারা লিখতেন, তখন কাজী সাহেব কি এর প্লট বা গল্প বা কাহিনি আপনাদের সঙ্গে আলোচনা করতেন?

সব সময় করতেন না। মাঝে মাঝে করতেন। কাজী সাহেব আমাকে গল্পের একটা মোটামুটি ধারণা দিয়েই দিয়েছেন। কিছু ব্যাপারে তার পরামর্শ অনুযায়ীই কাজ করেছি। সেটা নিয়ে অনেকে বলেন, আমি কাজী সাহেবের ভাষা নকল করেছি। কিন্তু, তা তো আর সম্ভব না। ওনার লেখার ভাষা আমার চেয়ে অনেক বেশি সমৃদ্ধ। আমি সেভাবে পারি না। ফলে, আমার ভাষাটা ওনার সঙ্গে মেলে না। আমি আমার মতো করেই লিখেছি। মাসুদ রানা আমার ভাষাতেই বেশি পরিচিত। কারণ, তিনি তো লিখেছেন ২০টি বই। আর আমি লিখেছি ২৬০টি বই। ওনার সময় বই ছাপা হতো দুই হাজার। আমার আমলে যা ১৮ হাজারে পৌঁছেছিল। এক একটা বই এক লাখ কপি করে বিক্রি হয়েছে। আমাকে তিনি টাকা দিয়েছেন ছয় থেকে সাত হাজারের।

আপনি কি মনে করেন আপনাকে ঠকানো হয়েছে? কাজী আনোয়ার হোসেন বলছেন, আপনার যা পাওয়ার কথা ছিল, সেই পরিমাণ টাকা তিনি দিয়েছেন। আপনার বাইপাস অপারেশনের সময়ও টাকা দিয়েছেন।

তিনি তো অনেক কথাই বলছেন। প্রথমে তো তিনি বলেছিলেন, শেখ আবদুল হাকিম একটাও কুয়াশা লেখেনি। পরে তিনি বলেছেন, শেখ আবদুল হাকিম কুয়াশা এবং মাসুদ রানা সিরিজে লিখেছেন নিয়োগের মাধ্যমে। একবারও কিন্তু তিনি বইয়ের সংখ্যা কম বা বেশি বলেননি। অর্থাৎ, তিনি স্বীকার করে নিয়েছেন যে ২৬০টা বই আমি লিখেছি। তবে, তিনি কোনো নিয়োগপত্র দেখাতে পারেননি।

আপনি বই লিখে যে টাকা তখন পেয়েছেন, তার চেয়ে বেশি পাওয়া উচিত ছিল বলে আপনার দাবি?

না, তা নয়। আমি একটা ঘটনার মাধ্যমে জানতে পেরেছি আমাকে রয়্যালটির টাকা দেওয়া হচ্ছে না।

আপনাকে কী এককালীন টাকা দেওয়ার কথা ছিল, না রয়্যালটি দেওয়ার কথা ছিল?

৩৬-৩৭ বছর ধরে তিনি প্রত্যেক লেখককে রয়্যালটি দেন। আমার কাছে এর প্রমাণ আছে। ২০০৮ সালে এক সাক্ষাৎকারে কাজী সাহেব নিজেই বলেছেন, তিনি প্রত্যেক লেখককে রয়্যালটি দেন। প্রতি তিন মাস পরপর লেখকের টাকা জমা হয়। লেখক যখন খুশি সেই টাকা তুলে নেন।

মাসুদ রানা বা কুয়াশা সিরিজের বই যদি কাজী আনোয়ার হোসেনের নামে না ছেপে আপনার নামে ছাপা হতো, তাহলেও কি একই পরিমাণে চলত বলে আপনি মনে করেন?

না, এত চলত না। কিন্তু, সেটা যদি শুরু থেকেই নিয়মিত করা হত তাহলে হতো। এই গল্প তো আমারই লেখা। কেন চলবে না? এক লাফে হয়তো হতো না। কিন্তু, কিছুদিন পরেই তো হতো।

তাহলে তখন নিজের নামে প্রকাশ করেননি কেন?

তখন তো এতকিছু চিন্তা করিনি। টাকা পেয়েছি, লিখেছি। নাম নিয়ে তো ভাবিনি।

এখন যদি আপনি মাসুদ রানার স্বত্ব পান, তাহলে কি নিজের নামে এই সিরিজের বই বের করবেন?

অবশ্যই।

তখনও কি বই আগের মতোই চলবে বলে মনে করেন?

না, তা চলবে না। আগের বইগুলোর এক একটি খণ্ড এক লাখ করে ছাপা হয়েছে।

এর কোনো প্রমাণ আছে আপনার কাছে?

আছে। এর প্রিন্ট অর্ডার আছে। বইয়ের অষ্টম, নবম এমনকি ১৮তম মুদ্রণ হয়েছে। কিন্তু, আমার কাছে অত কাগজ নেই। আমার কাছে সপ্তম মুদ্রণ পর্যন্ত আছে। এসব হিসাব করলে তাদের কাছে আমি অন্তত ১০ কোটি টাকা পাব। উচ্চ আদালতে গেলে আমি হিসাব দেবো। প্রমাণ ছাড়া কোনো হিসাব দেবো না।

এখন আপনার মূল দাবি কী?

আমি যা বলব এটার ভিন্ন অর্থ করে আমার দুর্বলতা মনে করতে পারে তারা। তবে, আমি চাই কপিরাইট নেওয়ার পর তারা যদি আমার ন্যায্যমূল্য পরিশোধ করে দেয়, তাহলে বইগুলো তাদেরকেই দিয়ে দেবো।

তখন কি বইগুলো আপনার নামে ছাপা হবে? নাকি কাজী আনোয়ার হোসেনের নামে ছাপা হবে?

অবশ্যই আমার নামে ছাপা হবে।

কাজী আনোয়ার হোসেন বলছেন, মাসুদ রানা তার সিরিজ, এর প্রতিটি চরিত্র তার সৃষ্টি।

মাসুদ রানা সিরিজের অল্প কিছু চরিত্র ছাড়া বাকি সবই আমার সৃষ্টি। মাসুদ রানা, রাহাত খান, সোহেল রানা, সোহানাসহ এমন সাত-আটটা চরিত্র তার। এগুলো আমি রাখব না। অন্য নাম দেবো।

আপনার ন্যায্য সম্মানী বলতে কত টাকা আপনি চান? আর কোনো দাবি আছে কি?

চার কোটি টাকা আমি চেয়েছি। তারা যদি আলোচনা করতে চায় তাহলে আমার সঙ্গে বসতে পারে। আমার মূল দাবি, আমার বইগুলো আমার হোক। সেই সঙ্গে আমি যে টাকাটা পাব, সেটাও আদায় করতে চাই।

আরও পড়ুন:

মাসুদ রানা সিরিজ ও প্রতিটি চরিত্র আমার সৃষ্টি: কাজী আনোয়ার হোসেন

Comments

The Daily Star  | English

BDR carnage rooted in 'long-term plot', says investigation commission

It was abetted by intelligence failures, gross negligence, and the involvement of several political figures, according to the commission chief

24m ago