যত গর্জে তত বর্ষে না
দেশে করোনা মহামারি রোধে সরকার গঠিত জাতীয় কমিটি হয়তো যথাযথভাবে কাজ করছে না, নয়তো কমিটির সুপারিশগুলো উপেক্ষিত হচ্ছে।
গত মার্চ মাস থেকে দেশে করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ক্রমাগত বেড়ে যাওয়ায় সরকার কয়েকটি ‘উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন’ ও জাতীয় পর্যায়ে কমিটি গঠন করে। কমিটি কাজ হলো করোনার বিস্তার রোধে সরকারকে পরামর্শ দেওয়া এবং অন্যরা সেসব পরামর্শ বাস্তবায়ন করবে।
অনেকগুলো কমিটিই বৈঠক ডেকেছে অথবা তাদের সুপারিশমালা উপেক্ষিত হয়েছে। কমিটিগুলো এবং সুপারিশমালা বাস্তবায়নে সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাব পরিস্থিতিকে আরও ভয়াবহ করে তুলেছে।
এই অচলাবস্থা কাটাতে সরকার আরও কমিটি গঠন করছে।
ইতোমধ্যে করোনা রোগী সংখ্যা বহুগণ বেড়ে গেছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণপূর্ব এশিয়া অঞ্চলের সাবেক পরামর্শক অধ্যাপক মুজাহেরুল হক দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘মহামারি মোকাবিলায় ২০১৮ সালে একটি আইন করা হয়। এটি হচ্ছে সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন ২০১৮।’
তার মতে, ‘আমরা যদি এই আইন বাস্তবায়ন করতে পারি এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নীতিমালা যথাযথভাবে মেনে চলতে পারি তাহলে আমাদের কোনো কমিটিই দরকার হবে না।’
‘অনেক কমিটির কোনো দায়বদ্ধতা বা জবাবদিহিতা নেই। কিন্তু, সবাই দায়বদ্ধ এবং সবারই জবাবদিহিতা আছে,’ উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘যদি বিশেষজ্ঞের পরামর্শ সরকার প্রয়োজন মনে করে তাহলে একজনের সঙ্গে কথা বললেই হয়।’
দুর্বল সমন্বয় ও উপেক্ষা
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক, মন্ত্রিপরিষদ সচিব, জ্যেষ্ঠ সচিব ও সচিবদের নিয়ে গত ১ মার্চ ২৬-সদস্যের জাতীয় কমিটি গঠন করে সরকার।
এটি সবচেয়ে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি।
প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী তাদের ভূমিকা হলো কর্মকৌশল বাস্তবায়ন ও পর্যালোচনা এবং নতুন নির্দেশনা জারি করা।
গঠনের পর থেকে এই কমিটি তিনবার বৈঠক করেছে এবং সবশেষ বৈঠকটি হয়েছিল গত ৩০ মে।
কমিটির প্রধান হয়েও স্বাস্থ্যমন্ত্রী পোশাক কারখানা খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্তটি নিয়ে কোনো পরামর্শ করেননি।
এ বিষয়ে মন্ত্রী জনসম্মুখে তার অসহায়ত্ব ও হতাশা প্রকাশ করেছেন।
গত ৬ এপ্রিল তিনি বলেছেন, ‘স্বাস্থ্যমন্ত্রী হওয়ায় আমাকে কমিটির সভাপতি করা হয়েছে। তবে আমাদের (স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের) না জানিয়েই কমিটির পক্ষ থেকে সিদ্ধান্তগুলো নেওয়া হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘কারখানা বন্ধ করার, মসজিদে জামাতে নামাজ না পড়ার এবং গণপরিবহন বন্ধ করার সিদ্ধান্তগুলোও আমাদের সঙ্গে আলোচনা না করেই নেওয়া হয়েছে। আমি সাংবাদিকদের প্রশ্নে জবাব দিতে পারি না… কমিটির প্রধান হওয়া সত্ত্বেও আমি কিছু জানি না বলে আমাকে দোষারোপ করা হয়।’
মন্ত্রীদের নিয়ে গঠিত আরেকটি ৩১ সদস্যের উচ্চ পর্যায়ের কমিটি এখনো কোনো বৈঠক করেনি।
স্বাস্থ্যসেবা অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে নিয়ে একটি জাতীয় সমন্বয় কমিটি গঠন করা হয়েছে। স্বনামধন্য মেডিসিন বিশেষজ্ঞ এবিএম আবদুল্লাহ এই কমিটির উপদেষ্টা।
তিনি সম্প্রতি ডেইলি স্টারকে বলেন যে তাকে কখনোই কমিটির বৈঠকে ডাকা হয়নি।
করোনার বিস্তার ও কমিউনিটি ট্রান্সমিশন রোধে এবং হাসপাতালগুলোতে সেবার মান বাড়াতে সুপারিশ দেওয়ার জন্যে গত ১৮ এপ্রিল সরকার ১৭-সদস্যের জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি গঠন করে।
বাংলাদেশ মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিলের সভাপতি মোহাম্মদ শহীদুল্লাহকে প্রধান করে এই কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি নয় বার বৈঠক করে নানান পরামর্শ ও কর্মকৌশলের কথা জানায়।
কিন্তু, তাদের কোনো পরামর্শই কেউ মানেননি।
গত ২৮ মে কমিটি সতর্ক করে বলেছিল যে ২৬ মার্চ শুরু হওয়া ‘সাধারণ ছুটি’ ৬৬ দিন পর তুলে দেওয়ার আগে কিছু সুনির্দিষ্ট শর্ত মেনে না চললে কোভিড-১৯ রোগীর সংখ্যা আরও অনেক বেড়ে যাবে।
কিন্তু, সরকার আপাতদৃষ্টিতে অর্থনীতির চাকা চালু রাখতে ঈদের আগে ১০ মে থেকে সীমিত আকারে শপিংমলসহ অন্যান্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
এর একদিন পর গণপরিবহন পরিষেবাও চালু হয়।
‘সাধারণ ছুটির’ পর আবারও সবকিছু খুলে দেওয়ায় করোনা শনাক্ত ও মৃতের সংখ্যা ক্রমাগতভাবে বাড়তে থাকে।
১০ জুন কমিটির নবম বৈঠকে বিভিন্ন এলাকায় করোনা রোগীর সংখ্যা বিবেচনা করে সে সব এলাকা দ্রুত পুরোপুরিভাবে লকডাউন করে দেওয়া প্রয়োজনীয়তার কথা জানায়।
সরকার এই প্রস্তাবে সাড়া দেয় ধীর গতিতে। পরীক্ষামূলকভাবে রাজধানীর পূর্ব রাজাবাজারকে লকডাউন করা হয়। এরপর আগামীকাল থেকে পুরান ঢাকার ওয়ারীকে লকডাউন করা হবে।
আট সদস্যের একটি জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বিভাগীয় পরামর্শকদের দল এই সমস্যার কিছু কৌশলগত সমাধান দিয়েছেন।
গত সপ্তাহে এই দলের একজন সদস্য অধ্যাপক শাহ মনির হোসেন ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আমরা স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিষয়গুলো বিবেচনায় রেখে সিদ্ধান্ত দিয়েছি। তারা অন্যান্য বিষয় যেমন অর্থনীতি ও জীবনজীবিকার কথা বিবেচনায় নিয়েছেন। তাই অনেক সময় সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় আমাদের পরামর্শের কোনো প্রতিফলন দেখা যায়নি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি বলব না যে আমাদের সব সিদ্ধান্তই উপেক্ষিত হয়েছে। আমি এটাও বলব না, আমাদের সিদ্ধান্ত পুরোপুরি গ্রহণ করা হয়েছে।’
সে সময় কমিটির পরামর্শ ছিল শপিংমল ও পোশাক কারখানা না খুলে দেওয়ার। পাশাপাশি ঈদের বন্ধে জনচলাচলের ওপর কড়া নিষেধাজ্ঞার কথাও বলা হয়েছিল।
তিনি বলেন, ‘এসব পরামর্শ উপেক্ষিত হয়েছিল। এটা স্বাস্থ্য বিভাগের কোনো সিদ্ধান্ত ছিল না। এটা ছিল প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত। এখন এর ফল আমরা দেখতে পাচ্ছি।’
এরপরও সরকারের কমিটি গঠন করা থেমে থাকেনি।
গত ২৭ জুন স্বাস্থ্যসেবা অধিদপ্তর করোনা মোকাবিলায় ব্যাবস্থা নিতে আরও ১০টি কোর কমিটি গঠন করেছে।
এসব কমিটিকে একীভূত করতে স্বাস্থ্যসেবা অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে প্রধান করে একটি সমন্বয় কমিটি গঠন করা হয়।
এর কয়েকদিন পর করোনা নিয়ন্ত্রণ ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ১৫ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে।
কাজী জেবুন্নেসা বেগমের নেতৃত্বে এই কমিটি করোনার বিস্তার রোধ, যে কোনো নতুন পরিস্থিতি মোকাবিলা ও বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে করোনা রোগীদের সেবা বাড়াতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনাগুলো বাস্তবায়ন করবে।
Comments